শুভ জন্মদিন জামাল নজরুল ইসলাম

অরুণ কুমার
ফাইল ছবি

স্টিফেন হকিং তখন সুস্থ। পুরোদমে গবেষণা করছেন কৃষ্ণবিবর নিয়ে। মহাবিশ্বের সৃষ্টি, ধ্বংস, অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে কত ভাবনা তাঁর মাথায়। কিন্তু সব ভাবনাই কি তাঁর নিজস্ব? না, বিজ্ঞান একজনের ভাবনায় চলে না। অতীত-বর্তমানের বিজ্ঞানীদের নানান কাজের সঙ্গে নিজের ভাবনা মিশিয়ে নতুন তত্ত্ব দাঁড় করান বিজ্ঞানীরা। ৬০-৭০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা বিগ ব্যাং নিয়ে মাতামাতি করেছেন। মহাবিশ্বের শুরু কীভাবে, সেটার খোঁজ এই বিগ ব্যাংই দেয়। সেই সময় হকিংয়ের একজন বাঙালি বন্ধু ছিলেন। প্রায়ই হকিংয়ের বাড়িতে যাতায়াত তাঁর।

সেই বন্ধুর বাড়িতেই নিয়মিত পরিবার-পরিজন নিয়ে আড্ডা দিতে যেতেন হকিং। হকিং কৃষ্ণবিবর নিয়ে কাজ করছেন, মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি কী সেটা বিস্তারিত জানারও প্রয়োজন পড়ে তাঁর। এটা নিয়ে ভালো কোনো বই ছিল না। সেই কাজটিই করে দেখালেন হকিংয়ের সেই বাঙালি বন্ধু তাঁর দ্য আল্টিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স বইটিতে, যেটি অনুবাদ হয়েছিল জাপানি, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, যুগোস্লাভ ভাষায়। সেই বন্ধুর কাজের কথা, তাঁর বইটির কথা হকিং অনেক লেখাতেই উল্লেখ করেছেন। সেই বন্ধুটি হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগে জামাল নজরুল ইসলাম দীর্ঘদিন লন্ডনে ছিলেন। একে একে লিখছেন রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি, অ্যান ইনট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল কসমোলজি, স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ, দ্য ফার ফিউচার অব দ্য ইউনিভার্সসহ বিখ্যাত সব ইংরেজি বই। কিন্তু বাংলায় মাত্র একটা বই—কৃষ্ণবিবর। ১৯৮৫ সালে বইটি প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। সে সময় বাংলা ভাষায় কৃষ্ণবিবর নিয়ে এত গভীর বর্ণনা আর কোনো বইয়ে ছিল না।

কৃষ্ণবিবরই বইটির প্রধান উপলক্ষ। তবে জামাল নজরুল ইসলাম শুরু করেছেন একেবারে গোড়া থেকেই—বৈদ্যুতিক বলের ধর্ম দিয়ে। একে একে উঠেছে নক্ষত্রের জন্মপ্রক্রিয়া, মৃত্যুর ধরন, মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও পরিণতির নানা বিবরণ।

শুধু বই দিয়েই জামাল নজরুল ইসলামের সঠিক মূল্যায়নটা হয় না। ২০০০ সালে একটা ভয়ংকর গুজব ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। বলা হয়েছিল ৫ মে নাকি পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এ গুজবের কারণও ছিল। ৫ বিজ্ঞানীরা হিসাব কষে দেখেছিলেন, ওই দিন সৌরজগতের সব কটি গ্রহ একই সরলরেখায় অবস্থান করবে। ফলে তীব্র মহাকর্ষীয় টানে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষ লাগাতে পারে। এতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেছিলেন বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা বলে কথা! কেউ সেটা ফেলে দিতে পারলেন না। দুনিয়ার বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী পর্যন্ত চুপ রইলেন। ফলে গোটা দুনিয়ায় চরম আতঙ্ক ভর করল। কিন্তু কথা বললেন একজন বিজ্ঞানী। তিনি হিসাব কষে দেখিয়ে দিলেন বিজ্ঞানীরা যা ভাবছেন, তেমনটি ঘটার সম্ভবনা নেই। তিনি জামাল নজরুল ইসলাম। তাঁর কথায় স্বস্তি ফিরে এল গোটা দুনিয়ায়। ৫ মে তে দেখা গেল, সৌরজগতের সবগুলো গ্রহ একই সরলরেখায় অবস্থান করেছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা যে ভয় পাচ্ছিলেন সেটা ঘটল না। তার মানে জামাল নজরুল ইসলামই ঠিক বলেছেন।

জামাল নজরুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ঝিনাইদহে। তাঁর বাবা তখন সরকারি মুন্সেফ। আজকাল মুন্সেফ বলে কিছু নেই। মুন্সেফ এখন হয়েছে সহকারী জজ। জামাল নজরুল ইসলামের বয়স যখন মাত্র এক বছর, তখন তাঁর বাবা বদলি হয়ে কলকাতায় চলে যান। একটু বড় হওয়ার পর তাঁকে ভর্তি কারানো হয় কলকাতা মডেল স্কুলে। সেখান থেকে পরে ভর্তি করানো হয় শিশু বিদ্যাপীঠে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ওই স্কুলেই পড়েন তিনি। তারপর আবার ফিরে আসেন মডেল স্কুলে। কিন্তু এবার সেখানে বেশি দিন পড়া হলো না তাঁর। বাবার চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামে চলে আসেন জামাল নজরুল ইসলাম।

চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। সে জন্য ভর্তি পরীক্ষাও দিলেন। ভর্তি পরীক্ষায় এতটাই ভালো করলেন, ডাবল প্রমোশন দেওয়া হলো তাঁকে। ফলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তে হলো না তাঁকে। একবারে ভর্তি হলেন ষষ্ঠ শ্রেণিতে। এই স্কুলে পড়ার সময়ই গণিতের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয় জামাল নজরুল ইসলামের। স্কুলের বইয়ের পাশাপাশি অতিরিক্ত অঙ্ক আর জ্যামিতি সমাধান করতে থাকেন। এভাবেই নবম শ্রেণি পর্যন্ত চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে কাটল তাঁর। তারপর জামাল নজরুল ইসলাম চলে গেলেন পশ্চিম-পাকিস্তানে।

সেখানে গিয়ে জামাল নজরুল ইসলাম ভর্তি হলেন লরেন্স কলেজে। এই কলেজ থেকেই তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পাস করেন। এই সিনিয়র আর হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ আবার কী জিনিস? এখনকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজগুলোতে দুটো লেভেল আছে। ও লেভেল এবং এ লেভেল। তখনকার সিনিয়র কেমব্রিজ আজকের ও লেভেলের সমান ছিল। আর হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ ছিল এখনকার এ লেভেলের সমান। জামাল নজরুল ইসলাম লরেন্স কলেজে পড়ার সময় গণিতের সমাধান করতে ভালোবাসতেন।

হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজে বেশ উচ্চপর্যায়ের গণিত ছিল তখন। তাই ভয়ে কেউ গণিত নিতেই চাইত না। জামাল নজরুল ইসলামের সহপাঠীদেরও কেউ গণিত নেননি হায়ার। শুধু তিনি একাই নিয়েছিলেন!

লরেন্স কলেজে পড়াশোনা শেষ করে জামাল নজরুল ইসলাম ফের চলে যান কলকাতায়। সেখানে এবার ভর্তি হন বিখ্যাত সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। ওই কলেজে বিএসসি অনার্স পড়েন।

এখানে পড়ার সময়ও চলে তাঁর গণিতচর্চা। কলেজে ফাদার গোরে নামে একজন শিক্ষক ছিলেন। গণিতের জটিল বিষয়গুলো তিনি ছাত্রদের খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন। এ কারণেই জামাল নজরুল ইসলামের প্রিয় শিক্ষকে পরিণত হন ফাদার গোরে। অন্যদিকে গণিতের প্রতি জামাল নজরুল ইসলামের অসীম ঝোঁক ও ভালোবাসা ফাদার গোরেকে মুগ্ধ করে। তাই জামাল নজরুল ইসলামও তাঁর প্রিয় ছাত্রে পরিণত হন।

জামাল নজরুল ইসলামের বিএসসি শেষ হয় ১৯৫৭ সালে। এরপর তিনি চলে যান লন্ডনে। ভর্তি হন বিশ্ববিখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৫৭ সালে। তারপর কেমব্রিজ থেকেই মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬০ সালে। ১৯৬৪ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৮২ সালে ডিএসসি অর্থাৎ ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি লাভ করেন জামাল নজরুল ইসলাম।

১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডে ডক্টরাল-উত্তর ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে কাজ করেছেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। এই প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান নাম ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোনমি। ১৯৭১ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ভিজিটিং সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। এই প্রতিষ্ঠানটির খুব জনপ্রিয় একটা নাম আছে। ক্যালটেক। ১৯৭২ সালে জামাল নজরুল ইসলাম চলে যান ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি সিনিয়র গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।

১৯৭৩ সালে জামাল নজরুল ইসলাম আবার ফিরে যান ইংলান্ডে। লন্ডনের কিংস কলেজের ফলিত গণিতের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু সে-ও মাত্র এক বছরের জন্য। ১৯৭৫ সালে তিনি কার্ডিফের ইউনিভার্সিটি কলেজে রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭৮ সালে যোগ দেন লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে, প্রভাষক পদে। পরে রিডার পদে উন্নীত হন। এখানে তিনি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিতে ১৯৬৮, ১৯৭৩ ও ১৯৮৪ সালে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ’৮৪ সালেই আসে জীবনের সবচেয়ে বড় সুযোগ। ডাক পান বিশ্বখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার জন্য। কিন্তু জামাল নজরুল ইসলাম সেই লোভনীয় চাকরি না করে ফিরে এলেন দেশে। যোগ দিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে। সেই বছরই এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা তাঁকে প্রশ্ন করেন, কেন তিনি এমন লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দেশে চলে এলেন? জবাবে বিজ্ঞানী বলেন, ‘আমার বাড়ি চিটাগং, এ জন্য এখানে জয়েন করি। আমি আমার দেশকে ভালোবাসি, আমি এখান থেকে নিতে আসিনি আমি দিতে এসেছি।’

নানা বিষয়ে জামাল নজরুল ইসলাম গবেষণা করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে কোয়ান্টামের ক্ষেত্র তত্ত্ব, আপেক্ষিকতার সূত্র, নক্ষত্রের গঠন, মহাবিশ্ব তত্ত্ব। ছাত্র অবস্থায় তিনি বিখ্যাত পদার্থবিদ পল ডিরাকের ক্লাস করেছেন। কোয়ান্টামের ক্ষেত্র তত্ত্ব পড়েছেন তাঁর প্রিয় শিক্ষক জন পলকিংহর্নের কাছে। নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী পল ডিরাক ছিলেন হাইজেনবার্গ-শ্রোডিঙ্গারের পরে আধুনিক কোয়ান্টাম তত্ত্ব কাজ করা সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানী। তাঁর ছাত্র পলকিংহর্ন কোয়ার্ক তত্ত্বে বিশেষ অবদান রেখেছেন। কোয়ার্ক হলো পদার্থের সবচেয়ে ক্ষুদ্র কণাদের একটি। এই কণা দিয়েই মূলত আরও দুই ক্ষুদ্র কণা প্রোটন ও নিউট্রন তৈরি।

জামাল নজরুল ইসলাম যখন ছাত্র ছিলেন তখন কোনো জার্নাল বা বিজ্ঞান পত্রিকায় লেখা ছাপানোর একটা নিয়ম ছিল ইউরোপে। বড় বৈজ্ঞানিকের মারফত সেই লেখা পাঠাতে হতো। নইলে নতুন বিজ্ঞানীর কোনো লেখা ছাপা হতো না। জামাল নজরুল ইসলাম যেসব প্রবন্ধ লিখতেন, সেগুলোও সরাসরি ছাপত না ইউরোপের জার্নালগুলো। তাঁর লেখাগুলো পত্রিকা বা জার্নালে জমা দিতেন ফ্রেড হয়েল, স্টিফেন হকিং, মার্টিন রিজের মতো দুনিয়াকাঁপানো বিজ্ঞানীরা।

গবেষক হিসেবে জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন বিশ্বমানের। বিশ্বখ্যাত সব গবেষকদের স্বান্নিধ্য পেয়েছেন তিনি। বিশেষ করে একালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ছিলেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের বন্ধু। লন্ডনে স্টিফেন হকিংয়ের বাড়িতে তিনি গেছেন বহুবার। তেমনি জামাল নজরুল ইসলামের লন্ডনের বাড়িতেও বহুবার গেছেন হকিং। এ ছাড়া ফ্রিম্যান ডাইসন, রিচার্ড ফাইনম্যান, আবদুস সালামের মতো বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীর সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন।

মহাবিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি হলো, তা নিয়ে বেশ ভালো ভালো কিছু বই তখন বাজারে ছিল। জামাল নজরুল ইসলাম চিন্তা করলেন, মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি কী হতে পারে, তা নিয়েও একটা বই থাকা উচিত। তিনি নিজেই সেটা লিখতে বসলেন। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হলো তাঁর প্রথম বই দ্য আল্টিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স। ইংরেজি ভাষায় লেখা জামাল নজরুল ইসলামের এ বইটি প্রকাশ করে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস।

সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের ভেতর সাড়া ফেলে দেয় বইটি। আজকাল বিজ্ঞানের অনেক কথাই খুব সহজে বলতে পারি। কিন্তু ৩১ বছর আগে যখন জামাল নজরুল ইসলাম এই বই লিখছিলেন, তখন সেগুলো এত সহজে বলার উপায় ছিল না। অথচ জামাল নজরুল ইসলাম সেগুলো তাঁর বইয়ে কত সহজে বলেছেন। মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি কী হতে পারে, তাঁর সুন্দর ও যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়ে বইটি লিখেছিলেন তিনি। এই বই পরে জাপানি, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান, পর্তুগিজ ও যুগোস্লাভ ভাষায় অনুবাদ হয়।

নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান বিভিন্ন কোয়ান্টাম তত্ত্বে একটা বড় গবেষণা করেন। তিনি পদার্থের মূল কণিকা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে একধরনের চিত্র আবিষ্কার করেন। এই চিত্র পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসের বিখ্যাত ফাইনম্যান ডায়াগ্রাম নামে পরিচিত। জামাল নজরুল ইসলাম কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এই ফাইনম্যান চিত্র নিয়ে গবেষণা করেন। ফাইনম্যান চিত্র আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী কিছু কৌশল আবিষ্কার করেন। জামাল নজরুল ইসলাম সেই কৌশলগুলোর বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটা সুন্দর গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখেন।

বিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েল আর জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার, দুজনে মিলে কনফরমাল তত্ত্ব নামে একটা তত্ত্ব দিলেন। নিউটনের মহাকর্ষ শুধরে আইনস্টাইন মহাকর্ষ তত্ত্ব দিয়েছিলেন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে। সেই তত্ত্বে নতুন কিছু বিষয় যোগ করেন হয়েল আর নারলিকর। এই তত্ত্ব নিয়েই চমৎকার একটি প্রবন্ধ লেখেন জামাল নজরুল ইসলাম। সেটা ১৯৬০-এর দশকের কথা। তাঁর এই প্রবন্ধটিও বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে।

সে সময় বিজ্ঞানীরা ভাবছিলেন, যদি আইনস্টানের আপেক্ষিক তত্ত্বের সঙ্গে বিখ্যাত বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েলের বিজ্ঞানী বিদ্যুচ্চুম্বকীয় সূত্রের যোগসাধন করা যায়, তবে পৃথিবীর অনেক সমস্যার সমাধান করা যায়। জামাল নজরুল ইসলাম সেটা নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করলেন। ১৯৭০-এর দশকে তিনি এ বিষয়ে পাঁচটি প্রবন্ধ প্রকাশ করলেন। এগুলোও বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীর দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হলো।

মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি নিয়ে তাঁর জামাল নজরুল ইসলামের বিখ্যাত প্রবন্ধটি প্রকাশ হয় ১৯৭৬ সালে। তাতে তিনি বলেছিলেন মহাবিশ্ব সব সময় প্রসারিত হতে থাকবে। আরও এমন কিছু কথা বলেছিলেন, যেগুলো অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও সায়েন্স ফিকশন লেখকদের খুবই প্রভাবিত করে। সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসন। তাঁর অনেক লেখার ভেতর জামাল নজরুল ইসলামের নাম শেনা যায়।

বই পড়তে ভালোবাসতেন জামাল নজরুল ইসলাম। গান শুনতে ও ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন তিনি। ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের একনিষ্ঠ ভক্ত। কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের ধারেকাছে ঘেঁষতেন না। মোবাইল ফোনও ব্যবহার করতেন না বলে শোনা যায়।

দেশ নিয়েও তাঁর চিন্তাভাবনা ছিল অনুকরণীয়। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে বাংলাদেশে, তখন জামাল নজরুল ইসলাম হাত গুটিয়ে বসে ছিলেন না। আমেরিকা থেকেই চিঠি লেখেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে। সেই চিঠিতে তিনি অনুরোধ করেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যেন পাকিস্তানি হানাদারদের ন্যক্কারজনক হামলা বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়।

দেশ ও সমাজের উন্নতি নিয়ে ব্যাপক চিন্তাভাবনা ছিল তাঁর। নিজের আয় থেকে কিছু কিছু অর্থ জমিয়ে তিনি দরিদ্র ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন জামাল নজরুল ইসলাম। ব্যক্তিগত জীবনে জামাল নজরুল ইসলাম ছিলেন দুই কন্যার পিতা। তাঁর বড় মেয়ের নাম সাদাফ সাজ সিদ্দিকী আর ছোট মেয়ের নাম নার্গিস ইসলাম। তাঁর স্ত্রীর নাম সুরাইয়া ইসলাম। ১৯৬০ সালে তাঁদের বিয়ে হয়।

ইদানিং জামাল নজরুল ইসলামকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অনেকেই তাঁকে হকিংয়ের চেয়ে বড় বিজ্ঞানী বানিয়ে ফেলছেন। আমরা সব সময় অতি আবেগ দিয়ে কথা বলি, বাড়াবাড়ি করে ফেলি। এই বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে হয়তো পরোক্ষভাবে জামাল নজরুল ইসলামকেই অসম্মান করে ফেলি। এটাও আসলে এক ধরনে গোঁড়ামি। এই গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে আর যাই হোক বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া অসম্ভব।

২০১৩ সালের ১৬ মার্চ ৭৪ বছর বয়সে বিশ্বখ্যাত এই মহান বিজ্ঞানী চট্টগ্রামে মৃত্যুবরণ করেন।

জন্মদিনে এই বিজ্ঞানীর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।

সূত্র:

অজয় রায়, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, দীপেন ভট্টাচার্য, অভিজিৎ রায়ের লেখা বিভিন্ন প্রবন্ধ থেকে

উইকিপিডিয়া

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

দারুচিনির ১০ উপকারিতা

দারুচিনি শরীরে প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে। প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন অনেক রোগের মূল কারণ হতে পারে, যেমন আর্থ্রাইটিস বা হৃদরোগ। দারুচিনির ভেতরে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদানগুলো প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াই করে। মার্কিন গবেষক ড. জর্জ স্যাভান্ট এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “দারুচিনির মধ্যে থাকা পলিফেনল জাতীয় অ্যান্টিঅক্

২ দিন আগে

দিগন্তে আকাশ ও মাটি কেন মেশে?

যেদিকেই তাকান না কেন, কেবল দূরেই মনে হবে আকাশ আর মাটি মিশেছে। কিন্তু কাছাকাছি কোথাও তা খুঁজে পাবেন না। এমনটা কেন হয়?

২ দিন আগে

চুলের যত্নে কোন তেল উপকারী?

বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে চুলের গঠন, তার প্রাকৃতিক বৃদ্ধি এবং ক্ষতির কারণ নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। চুল মূলত প্রোটিন দ্বারা গঠিত, বিশেষ করে কেরাটিন নামের একটি প্রোটিন চুলের মূল উপাদান। যখন চুল পর্যাপ্ত পুষ্টি পায় না কিংবা বাইরে থেকে সঠিক যত্ন পায় না, তখন তা রুক্ষ হয়ে যায়, ভেঙে যায় এবং ঝরে পড়ে। তেল মূলত চ

২ দিন আগে

দৈইখাওয়া গ্রামের হট্টিটি

লাল লতিকা হট্টিটি মাঝারি আকারের হয়ে থাকে। এই পাখিটি খুবেই চটপটে ও চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে থাকে। তার সতর্ক ভঙ্গি ও জলশয়ের পাতার ওপর দ্রুত দৌড়ানোর ক্ষমতার জন্য সুপরিচিত। লাল লতিকা হট্টিটি লম্বায় ৩৪-৩৭ সেন্টিমিটার। এদের চোখের সামনে টকটকে লাল চামড়া। সেটিই লতিকা।

৩ দিন আগে