ফিচার

মেঘ বিস্ফোরণ কী?

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

পৃথিবীর আবহাওয়ায় এমন অনেক ঘটনা আছে, যা মানুষের কল্পনারও বাইরে। কখনো প্রবল ঝড়, কখনো ঘূর্ণিঝড়, আবার কখনো আকস্মিক বন্যা। কিন্তু এর মধ্যেও এক ভয়ংকর এবং অস্বাভাবিক ঘটনা হলো মেঘ বিস্ফোরণ। হঠাৎ করেই আকাশ যেন ফেটে যায়, প্রবল জলধারা নেমে আসে, অল্প সময়ের মধ্যেই ডুবে যায় গ্রাম, ভেসে যায় রাস্তা-ঘাট। সাধারণ মানুষ যেমন এই ঘটনার ভয়াবহতা দেখে হতবাক হয়ে যায়, তেমনি বিজ্ঞানীরাও খুঁজতে থাকেন এর রহস্য।

মেঘ বিস্ফোরণ বলতে মূলত বোঝানো হয়, খুব অল্প এলাকায় অতি অল্প সময়ে প্রবল বর্ষণ হওয়া। আবহাওয়াবিদদের ভাষায়, এক ঘণ্টার মধ্যে একশ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হলে তাকে মেঘ বিস্ফোরণ ধরা হয়। এর সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো, এই বৃষ্টি হয় আকস্মিকভাবে এবং অনেক সময় খুব ছোট এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে। তাই পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় দেখা যায়, একটি গ্রামে মেঘ বিস্ফোরণ হয়ে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেল, অথচ পাশের গ্রামে স্বাভাবিক আবহাওয়া বিরাজ করছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মেঘ বিস্ফোরণ ঘটে তখনই, যখন উষ্ণ আর্দ্র বায়ু দ্রুত উপরে উঠে গিয়ে ঠান্ডা বায়ুর সঙ্গে ধাক্কা খায়। তখন বিশাল আকারের মেঘ গঠিত হয়। সাধারণ বৃষ্টিতে মেঘ ধীরে ধীরে জল ছেড়ে দেয়, কিন্তু মেঘ বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে কোনো কারণে জলবিন্দুগুলো আটকে থেকে হঠাৎ একসঙ্গে ঝরে পড়ে। ফলে কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টি কয়েক মিনিটেই নেমে আসে। এ ধরনের ঘটনা সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় বেশি হয়, কারণ পাহাড় মেঘকে আটকে দেয় এবং মেঘ দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায়।

ভারতের হিমালয় অঞ্চল, পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল, নেপাল কিংবা বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি এলাকায় প্রায়ই এ ধরনের ঘটনার শোনা যায়। ২০১৩ সালে ভারতের উত্তরাখণ্ডে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ মেঘ বিস্ফোরণ এখনো মানুষের মনে দাগ কেটে আছে। পাহাড়ি এলাকায় হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি নামায় ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধস হয়, কয়েক হাজার মানুষ প্রাণ হারান। বাংলাদেশেও পাহাড়ি ঢলে অনেক সময় মেঘ বিস্ফোরণের প্রভাব দেখা যায়, যদিও এখানে তা তুলনামূলক কম ঘটে।

বিদেশি গবেষকেরা এই বিষয়ে নানা মতামত দিয়েছেন। আমেরিকার ন্যাশনাল ওসেনিক অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (NOAA)-এর গবেষক ডেভিড পিটারসন বলেন, “মেঘ বিস্ফোরণকে আসলে আকাশ থেকে জলপ্রপাত নেমে আসার সঙ্গে তুলনা করা যায়। এখানে স্বাভাবিক বৃষ্টির নিয়ম ভেঙে যায়, ফলে জল হঠাৎ অতি মাত্রায় ঝরে পড়ে।” তাঁর মতে, উষ্ণায়নের কারণে এখন বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত আর্দ্রতা জমে থাকছে, যা মেঘ বিস্ফোরণের মতো চরম আবহাওয়া ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের মেট অফিসের বিজ্ঞানী সারা মিলস বলেন, “মেঘ বিস্ফোরণ আগে কেবল পাহাড়ি এলাকায় ঘটত, কিন্তু সাম্প্রতিক কালে সমতল অঞ্চলেও এ ধরনের ঘটনার নজির পাওয়া যাচ্ছে। এর কারণ হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, যা বায়ুমণ্ডলের গঠন বদলে দিচ্ছে।” তিনি মনে করেন, মেঘ বিস্ফোরণকে আগে বিরল ঘটনা বলা হতো, কিন্তু ভবিষ্যতে হয়তো এটি অস্বাভাবিক আর বিরল থাকবে না, বরং বাড়তেই থাকবে।

মেঘ বিস্ফোরণের প্রভাব ভয়ংকর। আকস্মিক বন্যা সৃষ্টি হয়, নদী-নালা ভরে যায়, পাহাড়ি ঢল নামে। ভূমিধস হয়ে গ্রাম, রাস্তা-ঘাট চাপা পড়ে যায়। কৃষিজমি নষ্ট হয়, অসংখ্য প্রাণহানি ঘটে। উত্তরাখণ্ড, কাশ্মীর, লাদাখ, পাকিস্তানের গিলগিট-বালতিস্তান কিংবা নেপালের পার্বত্য অঞ্চলে প্রায়ই এমন ভয়াবহতার খবর পাওয়া যায়। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামেও পাহাড়ি ঢল নামার পেছনে মেঘ বিস্ফোরণের ভূমিকা থাকতে পারে বলে গবেষকেরা মনে করেন।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, মেঘ বিস্ফোরণ আগে থেকে খুব ভালোভাবে পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। কারণ এটি খুব স্থানীয় ঘটনা। বড় বড় অঞ্চলের জন্য আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হলেও মাত্র কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকায় এমন হঠাৎ বৃষ্টি হবে—তা বলা সহজ নয়। তবে আধুনিক স্যাটেলাইট প্রযুক্তি এবং রাডার ব্যবস্থা ব্যবহার করে কিছুটা পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর এ ধরনের পূর্বাভাস দেওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশও আবহাওয়া রাডার বসাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে মেঘ বিস্ফোরণের পূর্বাভাসে সাহায্য করবে।

মেঘ বিস্ফোরণের ভয়াবহতা এতটাই যে, স্থানীয় মানুষ এ ঘটনার সঙ্গে প্রলয় বা মহাপ্লাবনের তুলনা করেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একেকটি পাহাড়ি গ্রাম ধুয়ে মুছে যায়। নদী উপচে উঠে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। মানুষ, গবাদিপশু, ঘরবাড়ি—কিছুই রক্ষা পায় না। অনেক সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে, উদ্ধারকাজ করা কঠিন হয়ে যায়। তাই বিজ্ঞানীরা বলছেন, শুধু পূর্বাভাসই যথেষ্ট নয়, বরং পাহাড়ি এলাকায় নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা এবং স্থানীয় মানুষকে সচেতন করাই জরুরি।

ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির জলবায়ু বিজ্ঞানী মাইকেল থমাস বলেন, “আমরা এখন এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি, যেখানে আবহাওয়া ক্রমশই চরম হয়ে উঠছে। মেঘ বিস্ফোরণ তারই একটি দৃষ্টান্ত। এই ঘটনাকে পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব নয়, কিন্তু আমরা মানুষের ক্ষতি কমাতে পারি সচেতনতা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে।”

সবশেষে বলা যায়, মেঘ বিস্ফোরণ প্রকৃতির এক আকস্মিক ক্রোধ, যা মানুষের অসহায়ত্বের পরিচয় করিয়ে দেয়। বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগেও মানুষ এখনো এই ঘটনার বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয়। তবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। মেঘ বিস্ফোরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানুষ যতই আধুনিক হোক না কেন, প্রকৃতির শক্তির সামনে সে এখনো দুর্বল। তাই প্রকৃতিকে সম্মান জানানো এবং পরিবেশকে রক্ষা করাই ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমাতে পারে।

সূত্র: ন্যাচার ফিজিকস

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

দিগন্তে আকাশ ও মাটি কেন মেশে?

যেদিকেই তাকান না কেন, কেবল দূরেই মনে হবে আকাশ আর মাটি মিশেছে। কিন্তু কাছাকাছি কোথাও তা খুঁজে পাবেন না। এমনটা কেন হয়?

২ দিন আগে

চুলের যত্নে কোন তেল উপকারী?

বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে চুলের গঠন, তার প্রাকৃতিক বৃদ্ধি এবং ক্ষতির কারণ নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। চুল মূলত প্রোটিন দ্বারা গঠিত, বিশেষ করে কেরাটিন নামের একটি প্রোটিন চুলের মূল উপাদান। যখন চুল পর্যাপ্ত পুষ্টি পায় না কিংবা বাইরে থেকে সঠিক যত্ন পায় না, তখন তা রুক্ষ হয়ে যায়, ভেঙে যায় এবং ঝরে পড়ে। তেল মূলত চ

২ দিন আগে

দৈইখাওয়া গ্রামের হট্টিটি

লাল লতিকা হট্টিটি মাঝারি আকারের হয়ে থাকে। এই পাখিটি খুবেই চটপটে ও চঞ্চল প্রকৃতির হয়ে থাকে। তার সতর্ক ভঙ্গি ও জলশয়ের পাতার ওপর দ্রুত দৌড়ানোর ক্ষমতার জন্য সুপরিচিত। লাল লতিকা হট্টিটি লম্বায় ৩৪-৩৭ সেন্টিমিটার। এদের চোখের সামনে টকটকে লাল চামড়া। সেটিই লতিকা।

৩ দিন আগে

মারা গেছেন ‘থ্রি ইডিয়েটস’ সিনেমার অধ্যাপক

অচ্যুত পোতদারের অভিনয়জীবন ছিল চার দশকেরও বেশি। তিনি ১২৫টির বেশি হিন্দি ও মারাঠি ছবিতে কাজ করেছেন। হিন্দি ও মারাঠি চলচ্চিত্র অঙ্গনে তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সহকর্মী, ভক্ত ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা সামাজিক মাধ্যমে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। বাস্তব জীবনেও তিনি ছিলেন নম্র, অমায়িক এবং বহুমুখী প্রতিভ

৩ দিন আগে