তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে নিরাপদ কোন দেশ?

আপডেট : ২৬ জুন ২০২৫, ১২: ১৪
প্রতীকী ছবি

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী এক যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যেকোনো সময়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বশক্তি এককেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় এ বিষয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ ও ইসরাইল-ইরান যুদ্ধ, ইরানে মার্কিন হামলা এবং দেশে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা- গোটা পৃথিবীকে যুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এইসব হামলায় যে মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে বিপুল বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতে মৃত্যুর চেয়েও বেশি। গোলার আঘাতে পঙ্গুত্ব বরণ করছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। নারী ও শিশু হত্যার কোনো কৈফিয়ত নেই। বরং খাদ্যসহায়তা দেওয়ার নামে লোক জমায়েত করে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে।

এক হিসেবে বলা হয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধে বেসামরিক নাগরিক মারা গেছে ১৩ হাজার। এক লাখ ৮০ হাজার মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়েছে। গৃহহীন হয়েছে লাখ লাখ পরিবার।

দুইটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা এখনো মানুষের মনে রয়ে গেছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে আমেরিকার আণবিক বোমা নিক্ষেপের বীভৎসতা এখনো মানুষের মনে দাগ কেটে রয়েছে। সেই ভয়াবহতা বিশ্বসভ্যতাকে যুদ্ধের পথ থেকে মোটেও দূরে রাখতে পারেনি। বরং বিজ্ঞানের বিষ্ময়কর অগ্রগতিকে ব্যবহার করে মানবসভ্যতা ধ্বংস করার মত মারণাস্ত্র আবিষ্কার করেছে বিভিন্ন দেশ। এই পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধলে পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে উন্নত, অনুন্নত বা দরিদ্র দেশ- কেউ টিকে থাকতে পারবে না।

যুদ্ধ বেঁধে যাওয়া নির্ভর করছে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের ওপর। সারা পৃথিবীতে পুঁজির লাগামহীন প্রতিযোগিতা চলছে। ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র বল্গাহীন ঘোড়ার মতো ছুটছে পুঁজির পেছনে। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়াই স্বাভাবিক। অতীতের প্রতিটি যুদ্ধের পেছনেই রয়েছে বিশ্বপুঁজির দৌরাত্ম্য। এমন পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধলে কি কোনো দেশ নিরাপদ থাকবে? বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে গেলে ধ্বংসযজ্ঞ থেকে কোন দেশের মানুষ কি রক্ষা পাবে?

বর্তমান বিশ্বে স্থলপথের চেয়ে আকাশপথে যুদ্ধের মাত্রা ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুদ্ধে পারমাণবিক বোমা বড় আতঙ্কের নাম। দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রসহ মানব বিধ্বংসী মারণাস্ত্র তৈরি হয়েছে যুদ্ধের জন্য। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার হলে মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। পারমাণবিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে কোনো কোনো দেশ সেদেশের বিশেষ নাগরিকদের জন্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কিন্তু দেশের সকল নাগরিকের জন্য এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেনি কোনো দেশ। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে সুইজারল্যান্ড।

ইউরোপের স্থলবেষ্টিত একটি ছোট দেশ সুইজারল্যান্ড। দেশটির আয়তন ৪১ হাজার ২৮৫ বর্গকিলোমিটার আর লোকসংখ্যা প্রায় ৭৩ লাখ। ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি এবং অস্ট্রিয়া পরিবেষ্টিত দেশ সুইজারল্যান্ড। দেশটি ভু-স্বর্গ হিসেবেও পরিচিত। ইউরোপের ছোট্ট এই দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটো- দুইটির কোনো সংস্থারই সদস্য নয়। বিষয়টি অনেকটাই আশ্চর্যের। আরো আশ্চর্যের বিষয় হলো ২০১২ সাল পর্যন্ত সুইজারল্যান্ড জাতিসংঘের সদস্যও ছিল না। সুইজারল্যান্ড বিশ্বের একটি নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে স্বীকৃত। কোনো দেশের সাথে যুদ্ধ বা সংঘাত ছাড়াই গত ২০০ বছরেও বেশি সময় পার করেছে দেশটি। ১৮১৫ সালে তারা নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সর্বশেষ যুদ্ধ করে। ইউরোপের কেন্দ্রে অবস্থিত সুইজারল্যান্ডের চারপাশের প্রতিটি দেশই বিশ্বের বড় বড় যুদ্ধের দায় বহন করছে। তারপরও কীভাবে সুইজারল্যান্ড এতটা নিরাপদ এবং নিরপেক্ষ?

অনেকদিক থেকেই সুইজারল্যান্ড হবে বিশ্বের নিরাপদ দেশ। দেশটি ভৌগোলিক অবস্থান, যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং যুদ্ধ পরিস্থিতিতে জনগণের জানমালের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণেই সুইজারল্যান্ড নিরাপদ দেশ। যুদ্ধপ্রস্তুটির ক্ষেত্রে দেশটির অবস্থান ও ভূপ্রকৃতি অনেক সহায়ক ভূমিকা রাখছে।

সুইজারল্যান্ডের দক্ষিণে রয়েছে আল্পস পর্বতমালা। এই পর্বতমালা দেশটির বেশিরভাগ জায়গাজুড়ে। আল্পস পর্বতমালা ইতালি ও অস্ট্রিয়া থেকে সুইজারল্যান্ডকে পৃথক করেছে। উত্তর এবং পশ্চিমে রয়েছে জুরাহ পর্বতমালা। এই পর্বতমালা ফ্রান্স থেকে সুইজারল্যান্ডকে পৃথক করেছে। আল্পস পর্বতমালার মতো জুরাহ বড় পর্বতমালা বড় নয়, তবে দেশটির প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ অবদান রাখছে। এই দুই পর্বতমালার মাঝে রয়েছে সুইস মালভূমি বা Swiss Plateau. সুইস মালভূমির আয়তন দেশের মোট স্থলভাগের তিন শতাংশ। দেশের প্রধান তিনটি শহর জুরিখ, বার্ন এবং জেনেভার অবস্থান এই মালভূমিতে এবং জনসংখ্যা মোট দুই-তৃতীয়াংশ এখানে বসবাস করে।

সুইজারল্যান্ড সবসময় বিদেশি আক্রমণের আশঙ্কায় থেকেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যদিও তারা রক্ষা পেয়েছে, তবুও দুইবারই আক্রান্ত হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স দখল করার জন্য জার্মানি সেই সময়ের আরেক নিরপেক্ষ দেশ বেলজিয়াম আক্রমণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তি এবং জার্মানির আক্রমণের দ্বারপ্রান্তে ছিল সুইজারল্যান্ড। যদিও জার্মানি আক্রমণ করেনি, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আক্রমণের আশঙ্কা করা হচ্ছিল। এ কারণে সুইসরা বহিঃশত্রু আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেতে কঠিন কৌশল গ্রহণ করেছে। এই কৌশলকে তারা ‘দ্য ন্যাশনাল রিডাউট’ বলে। এর অর্থ হচ্ছে- যদি কেউ সুইজারল্যান্ড আক্রমণ করতে চায়, সেক্ষেত্রে তাকে দেশের ভূ-প্রকৃতি এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখে আক্রমণ করার চিন্তা করতে হবে এবং এজন্য দুবার ভাবতে হবে।

সুইজারল্যান্ডের ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সী প্রতিটি সুস্থ নাগরিককে ১৭০ দিনের বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। এই প্রশিক্ষণে তাদের যুদ্ধ প্রস্তুতির প্রাথমিক বিষয়ে সম্যক ধারণা দেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক মিলিটারি প্রশিক্ষণ শেষে অধিকাংশ নাগরিক বাড়ি ফিরে যায়। তবে তাদের প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত রাইফেল নিজেদের কাছে রেখে দিতে পারে। এ কারণে বন্দুকের ব্যক্তিগত মালিকানার স্বত্ব অর্জনের দিক দিয়ে সুইজারল্যান্ড বিশ্বে অন্যতম। তবে এই অস্ত্র দিয়ে অপরাধ সংঘটনের ঘটনা নেই বললেই চলে। যারা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে না, ৩০ বছর পর্যন্ত তাদের আয়ের ওপর তিন শতাংশ কর প্রদান করতে হয়। যেকোনো জরুরি সামরিক প্রয়োজনে সুইজারল্যান্ড ৭২ ঘণ্টায় দুই লাখেরও বেশি সৈন্যকে কাজে নামিয়ে নিতে পারে।

সুইজারল্যান্ডের প্রতিটি সেতু, রেলপথ ও টানেল বিশেষ পরিকল্পনায় নির্মাণ করা হয়েছে। শত্রুপক্ষ আক্রমণ করলে যেকোনো সময় দূরবর্তী স্থান থেকে এগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া যাবে। শত্রুপক্ষ সড়কপথে আক্রমণ করলে কঠিন বিপদে পড়তে হবে। কারণ যেকোনো মুহূর্তে পাহাড়গুলো বিস্ফোরিত হয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেবে। কৌশলগত দিক গুরুত্ব দিয়ে দেশের তিন হাজার স্থানে এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। আক্রমণের আশঙ্কা দেখা দিলে সুইস সেনাবাহিনী মালভূমি ছেড়ে পর্বত বেষ্টিত আলপাইন অঞ্চলে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করবে। এটা সুইস সেনাবাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ রণকৌশল। আলপাইন পর্বতমালায় তারা নির্মাণ করেছে ২৬ হাজার বাংকার এবং ছোট ছোট দুর্গ। এছাড়াও পাহাড়ে বসানো রয়েছে অ্যান্টি ট্যাংক গান, অ্যান্টি এয়ার গান এবং মেশিনগান নেস্ট। এগুলো পাথর দিয়ে এমনভাবে রাখা হয়েছে যে, দুর থেকে সহজে বুঝা যায় না। পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট ঘর রয়েছে। এইগুলোর কোনটি মেশিনগান নেস্ট আবার কোনোটি অ্যান্টি ট্যাংক গান। এই ঘরগুলো মাটির নিচে টানেল দ্বারা সংযুক্ত। এই ছোট ঘরগুলো গোটা সুইজারল্যান্ডকে একটি দুর্ভেদ্য প্রাসাদে পরিণত করেছ।

বসতবাড়ি নির্মাণে পারমাণবিক বিপর্যয় প্রতিরোধী ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সুইজারল্যান্ড আইন প্রণয়ন করেছে। এগুলোকে নিউক্লিয়ার ফলআউট শেল্টার বলা হয়। ১৯৭৮ সালের পর থেকে নির্মাণ করা প্রত্যেক বাড়িতে নিউক্লিয়ার ফলআউট শেল্টার নির্মাণ করা হয়েছে। ৭০০ মিটার দূরবর্তী অঞ্চলের ১২ মেগাটন পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটলেও এই শেল্টারে আশ্রয় নিয়ে রক্ষা পাওয়া যাবে। সুইজারল্যান্ডে এধরনের প্রায় ৮.৭ মিলিয়ন পারমাণবিক আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। পারমাণবিক বিপর্যয়ের সময় নাগরিকরা তাদের বাংকারে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের রক্ষা করতে পারবে। অনেকের মতে, পারমাণবিক যুদ্ধের সময় যারা বেঁচে থাকবেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কতিপয় দেশের ক্ষমতাবান রাষ্ট্রপ্রধান, তেলাপোকা এবং ৮.৭ মিলিয়ন সুইস নাগরিক। সুতরাং যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধে এবং পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়, সেই যুদ্ধে সুইজারল্যান্ডই হবে নিরাপদ দেশ।

লেখক : চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) সাবেক মহাপরিচালক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৫ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৫ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে