ড. ইকবাল হুসাইন
সম্প্রতি একাধিক মিছিল-সমাবেশে বেশ কিছু অশ্লীল, আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলো দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার পাবে, এমনকি লাইভ প্রচার হতে পারে জানার পরেও শত শত ছেলেমেয়ের অংশগ্রহণে এরূপ স্লোগান সত্যিই বিস্ময়কর।
আমাদের সংস্কৃতিতে বন্ধু-বান্ধব, ঘরোয়া আলাপচারিতায় কিংবা আড্ডায় অনেকে অশ্লীল (slang) শব্দের প্রয়োগ করে থাকেন। বদঅভ্যাসের কারণেও কেউ কেউ ‘স্ল্যাং’ ব্যবহার করেন। কিন্তু যতই বদঅভ্যাস থাকুক, সবাই স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় রাখেন। সাধারণত মুরব্বি, অভিভাবক, প্রবীণ এবং নারীদের সামনে সবাই সংযতভাবেই কথা বলেন। প্রকাশ্য মিছিল-সমাবেশে সমস্বরে শত শত মানুষ অবলীলায় অশ্লীল স্লোগান দিচ্ছেন—এটি অকল্পনীয়!
স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি”; “আমরা লড়ব, আমরা জিতব”—ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতনতা, স্বাধীনতার দাবি এবং স্বদেশপ্রেমকে শানিত করেছিল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও চমৎকার সব স্লোগান ব্যবহার করা হতো—“লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” (আমরা লড়াই করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করবো); “পাকিস্তান জিন্দাবাদ, মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ”; “আমরা চাই পাকিস্তান, পাকিস্তান, পাকিস্তান”—ইত্যাদি তরুণ, বৃদ্ধ সবাইকে উজ্জীবিত করতো।
ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল স্লোগান—“রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই বাংলা চাই”; “বাংলা আমার মাতৃভাষা, করতে হবে রাষ্ট্রভাষা”; “আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না”; “ভাষা আমার অধিকার, বঞ্চিত করা চলবে না”—এমন আরো অনেক স্লোগান ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করেছিল।
পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনেও স্লোগানের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে বলা হতো—“শরীফ কমিশন মানি না, শিক্ষা বিক্রি চলবে না”; “মাতৃভাষায় শিক্ষা চাই”; “ছাত্র-জনতা, গড়ে তোলো একতা”; “সংগ্রাম সংগ্রাম, শিক্ষার জন্য সংগ্রাম”। এরপর ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—প্রতিটি ক্ষেত্রেই নান্দনিক নানা স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হতো।
“আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা”; “পূর্ববাংলা শোষণ করা, চলবে না চলবে না”; “ছয় দফা মেনে নাও, পূর্ববাংলাকে বাঁচতে দাও”; “জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো”; “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা”; “তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি”; “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো”; “জয় বাংলা”; “জয় বঙ্গবন্ধু”; “তোমার নেতা, আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব”; “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”; “তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ”—এমন অসংখ্য স্লোগান বাঙালির মুক্তির অভিযাত্রায় শক্তি ও প্রেরণা যুগিয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামেও স্লোগানের ভূমিকা অপরিসীম। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” স্লোগানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। প্রচলিত স্লোগান না হলেও ব্যানার-ফেস্টুনে বহুল ব্যবহৃত একটি উক্তি ছিল—“দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে”।
এছাড়া—“অমুকের দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে”; “স্বৈরাচারকে বিদায় কর, গণতন্ত্র কায়েম কর”; “এক দফা এক দাবি, … তুই কবে যাবি”; “গণমানুষের রক্তের দাম, …… তুই নাম রে নাম”; “অমুক তুই স্বৈরাচার, এই মুহূর্তে গদি ছাড়”—এ ধরনের স্লোগানও ছিল।
সময়ের সাথে সাথে স্লোগানের ভাষায়ও কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। নান্দনিকতা থেকে ক্রমশ সহিংসতার দিকে অগ্রসর হয়েছে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন প্রায়ই তাদের দাবি-দাওয়া এবং প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্লোগান দেয়। এর মধ্যে “জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো” খুবই সাধারণ একটি স্লোগান। আবার “একটা দুইটা …… ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর”—রীতিমতো সন্ত্রাসী স্লোগান। এ ধরনের স্লোগান কেবল রাজনৈতিকভাবে বিদ্বেষপূর্ণ নয়, এগুলো প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা এবং সহিংসতাকে উসকে দেয়।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অনেক সময় ব্যঙ্গাত্মক, আক্রমণাত্মক, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসামূলক উত্তেজনাপূর্ণ স্লোগান দেওয়ারও রেওয়াজ রয়েছে। এ সব স্লোগানের কোনো কোনোটি হয়তো কুরুচিপূর্ণও। কিন্তু অশ্লীল নয়।
২০১৩ সালে শাহবাগের গণআন্দোলন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল মূলত স্লোগানকে ঘিরে। উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ গান, গণসঙ্গীত, কবিতা কিংবা বক্তৃতা নয়—স্লোগানকেই বেশি গ্রহণ করেছিল। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানেও স্লোগানের প্রভাব অনস্বীকার্য। জনপ্রিয় সব স্লোগান কেবল মিছিল-সমাবেশে উচ্চারিত হয়নি, দেয়ালে দেয়ালে শোভা পেয়েছে, মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। এটাই স্লোগানের শক্তি—ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তোলে।
কিন্তু ২০২৫-এ এসে আমরা স্লোগানের নতুন একটি রূপ দেখলাম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রুচিহীন, কদর্য এবং অশ্লীল এ সব স্লোগান কীভাবে প্রকাশ্যে উচ্চারিত হলো? এ বিষয়ে একটি সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধান পরিচালিত হতে পারে। সমাজবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে এ বিষয়ে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে।
প্রথমত, ভাষা অনেকটা প্রবাহমান নদীর মতো—ছুটে চলে, প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। প্রযুক্তির বিকাশে ভাষার শব্দ, বানান, উচ্চারণ নানা ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। এক্ষেত্রে প্রথমেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কথা বলা যায়। সেখানে অনেকেই ইংরেজি বর্ণমালায় বাংলা লেখেন। বিকৃত উচ্চারণ ও বানান, নতুন নতুন শব্দের প্রয়োগও লক্ষ করা যায়—যেমন “ঠিকাছে”, “ছ” এর পরিবর্তে “স” এর ব্যবহার ইত্যাদি।
এটি হয়তো ভাষার স্বাভাবিক রূপান্তর। কিন্তু ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকের লেখালেখি, মন্তব্য, অডিও-ভিডিও কনটেন্ট ইত্যাদিতে অনেকেই সাবলীলভাবে ‘স্ল্যাং’ ব্যবহার করেন। ‘স্ল্যাং’ ব্যবহার করে অনেকে কেবল জনপ্রিয় নন, রীতিমতো সেলিব্রিটি! এ কারণে হয়তো অনেকে অশ্লীল বা স্ল্যাং শব্দের ব্যবহারকে স্বাভাবিক মনে করছেন, উৎসাহিত হচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, গত বেশ কয়েক বছর যাবৎ আমাদের মূল ধারার গণমাধ্যমে প্রচারিত নাটক-সিনেমায়ও প্রচুর অশ্লীল শব্দ এবং গালি-গালাজ লক্ষ করা যায়। এ জন্য কেউ কেউ দু’একজন প্রভাবশালী নির্মাতাকে দায়ী করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অশ্লীল, অবাঞ্ছিত এবং কুরুচিপূর্ণ শব্দের ব্যবহার ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এ ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য নির্মিত অধিকাংশ সিরিজ কিংবা সিনেমায় গালিগালাজ এবং অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ থাকবেই।
তৃতীয়ত, মূল্যবোধের অবক্ষয়ও তরুণ প্রজন্মকে বেপরোয়া করে তুলছে। অনেকেই বাবা-মা, শিক্ষক, বয়োজ্যেষ্ঠ কাউকেই কেয়ার করে না। আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর রাখা, দুস্থ-দরিদ্রকে সাহায্য করার শিক্ষা তাদের মধ্যে নেই। বই পড়া, ভালো সিনেমা দেখা, খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড—কিছুতেই তাদের আগ্রহ নেই। সোশ্যাল মিডিয়া, বন্ধু-বান্ধব নিয়েই তাদের জগত। অনেকে নেশা এবং পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত।
ফলে, পারিবারিক ও সামাজিক সম্প্রীতি, মূল্যবোধ, ঔচিত্যবোধ ইত্যাদি তাদের মধ্যে খুব বেশি কাজ করে না। ‘যা খুশি তাই করা’কেই তারা স্বাধীনতা বলে মনে করে।
নাটক-সিনেমা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন খুব সাবলীলভাবে অশ্লীল শব্দের ব্যবহার দেখা যায়, তখন অনেকে আর এটিকে “অশ্লীল” বলে মনেই করে না। কুরুচিপূর্ণ এবং অপভাষার অপপ্রয়োগ একটা সময় দৈনন্দিন কথ্য ভাষায় হয়তো জায়গাও করে নিতে পারে। তরুণ প্রজন্মের অনেকে এটি “স্বাভাবিক” বলে গ্রহণও করতে পারেন।
কিন্তু সবার পক্ষে এই পরিবর্তন গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। আন্দোলন-সংগ্রাম, ক্ষোভ-বিক্ষোভেও যারা নান্দনিকতাকে লালন করেছেন, তুমুল ঘৃণার মধ্যেও যে প্রজন্ম বলেছেন—“তুমি আমার জলস্থলের/মাদুর থেকে নামো/তুমি বাংলা ছাড়ো” (সিকান্দার আবু জাফর, ১৯৭১)—তারা তো সহিংসতা কিংবা অশ্লীলতাকে এত সহজে গ্রহণ করতে পারবেন না।
লেখক: অধ্যাপক (সমাজবিজ্ঞান), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
সম্প্রতি একাধিক মিছিল-সমাবেশে বেশ কিছু অশ্লীল, আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলো দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার পাবে, এমনকি লাইভ প্রচার হতে পারে জানার পরেও শত শত ছেলেমেয়ের অংশগ্রহণে এরূপ স্লোগান সত্যিই বিস্ময়কর।
আমাদের সংস্কৃতিতে বন্ধু-বান্ধব, ঘরোয়া আলাপচারিতায় কিংবা আড্ডায় অনেকে অশ্লীল (slang) শব্দের প্রয়োগ করে থাকেন। বদঅভ্যাসের কারণেও কেউ কেউ ‘স্ল্যাং’ ব্যবহার করেন। কিন্তু যতই বদঅভ্যাস থাকুক, সবাই স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় রাখেন। সাধারণত মুরব্বি, অভিভাবক, প্রবীণ এবং নারীদের সামনে সবাই সংযতভাবেই কথা বলেন। প্রকাশ্য মিছিল-সমাবেশে সমস্বরে শত শত মানুষ অবলীলায় অশ্লীল স্লোগান দিচ্ছেন—এটি অকল্পনীয়!
স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি”; “আমরা লড়ব, আমরা জিতব”—ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতনতা, স্বাধীনতার দাবি এবং স্বদেশপ্রেমকে শানিত করেছিল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও চমৎকার সব স্লোগান ব্যবহার করা হতো—“লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” (আমরা লড়াই করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করবো); “পাকিস্তান জিন্দাবাদ, মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ”; “আমরা চাই পাকিস্তান, পাকিস্তান, পাকিস্তান”—ইত্যাদি তরুণ, বৃদ্ধ সবাইকে উজ্জীবিত করতো।
ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ছিল স্লোগান—“রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই বাংলা চাই”; “বাংলা আমার মাতৃভাষা, করতে হবে রাষ্ট্রভাষা”; “আমার ভাইয়ের রক্ত, বৃথা যেতে দেব না”; “ভাষা আমার অধিকার, বঞ্চিত করা চলবে না”—এমন আরো অনেক স্লোগান ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করেছিল।
পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনেও স্লোগানের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে বলা হতো—“শরীফ কমিশন মানি না, শিক্ষা বিক্রি চলবে না”; “মাতৃভাষায় শিক্ষা চাই”; “ছাত্র-জনতা, গড়ে তোলো একতা”; “সংগ্রাম সংগ্রাম, শিক্ষার জন্য সংগ্রাম”। এরপর ছয় দফা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—প্রতিটি ক্ষেত্রেই নান্দনিক নানা স্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হতো।
“আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা”; “পূর্ববাংলা শোষণ করা, চলবে না চলবে না”; “ছয় দফা মেনে নাও, পূর্ববাংলাকে বাঁচতে দাও”; “জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো”; “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা”; “তুমি কে আমি কে, বাঙালি বাঙালি”; “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো”; “জয় বাংলা”; “জয় বঙ্গবন্ধু”; “তোমার নেতা, আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব”; “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”; “তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ”—এমন অসংখ্য স্লোগান বাঙালির মুক্তির অভিযাত্রায় শক্তি ও প্রেরণা যুগিয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলন-সংগ্রামেও স্লোগানের ভূমিকা অপরিসীম। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে “স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক” স্লোগানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। প্রচলিত স্লোগান না হলেও ব্যানার-ফেস্টুনে বহুল ব্যবহৃত একটি উক্তি ছিল—“দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে”।
এছাড়া—“অমুকের দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে”; “স্বৈরাচারকে বিদায় কর, গণতন্ত্র কায়েম কর”; “এক দফা এক দাবি, … তুই কবে যাবি”; “গণমানুষের রক্তের দাম, …… তুই নাম রে নাম”; “অমুক তুই স্বৈরাচার, এই মুহূর্তে গদি ছাড়”—এ ধরনের স্লোগানও ছিল।
সময়ের সাথে সাথে স্লোগানের ভাষায়ও কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। নান্দনিকতা থেকে ক্রমশ সহিংসতার দিকে অগ্রসর হয়েছে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন প্রায়ই তাদের দাবি-দাওয়া এবং প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্লোগান দেয়। এর মধ্যে “জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো” খুবই সাধারণ একটি স্লোগান। আবার “একটা দুইটা …… ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর”—রীতিমতো সন্ত্রাসী স্লোগান। এ ধরনের স্লোগান কেবল রাজনৈতিকভাবে বিদ্বেষপূর্ণ নয়, এগুলো প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা এবং সহিংসতাকে উসকে দেয়।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অনেক সময় ব্যঙ্গাত্মক, আক্রমণাত্মক, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসামূলক উত্তেজনাপূর্ণ স্লোগান দেওয়ারও রেওয়াজ রয়েছে। এ সব স্লোগানের কোনো কোনোটি হয়তো কুরুচিপূর্ণও। কিন্তু অশ্লীল নয়।
২০১৩ সালে শাহবাগের গণআন্দোলন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল মূলত স্লোগানকে ঘিরে। উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ গান, গণসঙ্গীত, কবিতা কিংবা বক্তৃতা নয়—স্লোগানকেই বেশি গ্রহণ করেছিল। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানেও স্লোগানের প্রভাব অনস্বীকার্য। জনপ্রিয় সব স্লোগান কেবল মিছিল-সমাবেশে উচ্চারিত হয়নি, দেয়ালে দেয়ালে শোভা পেয়েছে, মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। এটাই স্লোগানের শক্তি—ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তোলে।
কিন্তু ২০২৫-এ এসে আমরা স্লোগানের নতুন একটি রূপ দেখলাম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রুচিহীন, কদর্য এবং অশ্লীল এ সব স্লোগান কীভাবে প্রকাশ্যে উচ্চারিত হলো? এ বিষয়ে একটি সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধান পরিচালিত হতে পারে। সমাজবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে এ বিষয়ে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে।
প্রথমত, ভাষা অনেকটা প্রবাহমান নদীর মতো—ছুটে চলে, প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। প্রযুক্তির বিকাশে ভাষার শব্দ, বানান, উচ্চারণ নানা ক্ষেত্রে দৃশ্যমান পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। এক্ষেত্রে প্রথমেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কথা বলা যায়। সেখানে অনেকেই ইংরেজি বর্ণমালায় বাংলা লেখেন। বিকৃত উচ্চারণ ও বানান, নতুন নতুন শব্দের প্রয়োগও লক্ষ করা যায়—যেমন “ঠিকাছে”, “ছ” এর পরিবর্তে “স” এর ব্যবহার ইত্যাদি।
এটি হয়তো ভাষার স্বাভাবিক রূপান্তর। কিন্তু ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকের লেখালেখি, মন্তব্য, অডিও-ভিডিও কনটেন্ট ইত্যাদিতে অনেকেই সাবলীলভাবে ‘স্ল্যাং’ ব্যবহার করেন। ‘স্ল্যাং’ ব্যবহার করে অনেকে কেবল জনপ্রিয় নন, রীতিমতো সেলিব্রিটি! এ কারণে হয়তো অনেকে অশ্লীল বা স্ল্যাং শব্দের ব্যবহারকে স্বাভাবিক মনে করছেন, উৎসাহিত হচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, গত বেশ কয়েক বছর যাবৎ আমাদের মূল ধারার গণমাধ্যমে প্রচারিত নাটক-সিনেমায়ও প্রচুর অশ্লীল শব্দ এবং গালি-গালাজ লক্ষ করা যায়। এ জন্য কেউ কেউ দু’একজন প্রভাবশালী নির্মাতাকে দায়ী করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অশ্লীল, অবাঞ্ছিত এবং কুরুচিপূর্ণ শব্দের ব্যবহার ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম এ ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য নির্মিত অধিকাংশ সিরিজ কিংবা সিনেমায় গালিগালাজ এবং অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ থাকবেই।
তৃতীয়ত, মূল্যবোধের অবক্ষয়ও তরুণ প্রজন্মকে বেপরোয়া করে তুলছে। অনেকেই বাবা-মা, শিক্ষক, বয়োজ্যেষ্ঠ কাউকেই কেয়ার করে না। আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর রাখা, দুস্থ-দরিদ্রকে সাহায্য করার শিক্ষা তাদের মধ্যে নেই। বই পড়া, ভালো সিনেমা দেখা, খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড—কিছুতেই তাদের আগ্রহ নেই। সোশ্যাল মিডিয়া, বন্ধু-বান্ধব নিয়েই তাদের জগত। অনেকে নেশা এবং পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত।
ফলে, পারিবারিক ও সামাজিক সম্প্রীতি, মূল্যবোধ, ঔচিত্যবোধ ইত্যাদি তাদের মধ্যে খুব বেশি কাজ করে না। ‘যা খুশি তাই করা’কেই তারা স্বাধীনতা বলে মনে করে।
নাটক-সিনেমা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় যখন খুব সাবলীলভাবে অশ্লীল শব্দের ব্যবহার দেখা যায়, তখন অনেকে আর এটিকে “অশ্লীল” বলে মনেই করে না। কুরুচিপূর্ণ এবং অপভাষার অপপ্রয়োগ একটা সময় দৈনন্দিন কথ্য ভাষায় হয়তো জায়গাও করে নিতে পারে। তরুণ প্রজন্মের অনেকে এটি “স্বাভাবিক” বলে গ্রহণও করতে পারেন।
কিন্তু সবার পক্ষে এই পরিবর্তন গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। আন্দোলন-সংগ্রাম, ক্ষোভ-বিক্ষোভেও যারা নান্দনিকতাকে লালন করেছেন, তুমুল ঘৃণার মধ্যেও যে প্রজন্ম বলেছেন—“তুমি আমার জলস্থলের/মাদুর থেকে নামো/তুমি বাংলা ছাড়ো” (সিকান্দার আবু জাফর, ১৯৭১)—তারা তো সহিংসতা কিংবা অশ্লীলতাকে এত সহজে গ্রহণ করতে পারবেন না।
লেখক: অধ্যাপক (সমাজবিজ্ঞান), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।
৪ দিন আগেভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।
৫ দিন আগেবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা
৯ দিন আগেশেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানী নেতাদের প্রতি খারাপ ভাষার ব্যবহার করতে শুনিনি। স্বাধীনতার ঘোষক বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা সেনাবাহিনী প্রধান বাংলাদেশের সফল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁর জীবদ্দশায় শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করেননি। শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে এনে রাজনীতি করার সুযোগস
৯ দিন আগে