যুদ্ধ এবং ‘ফিল্ড মার্শাল’ তত্ত্ব

ড. মোহাম্মদ হাননান
প্রকাশ: ২৭ মে ২০২৫, ২২: ৫৫

পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম ‘ফিল্ড মার্শাল’ ছিলেন জেনারেল আইয়ুব খান। তিনি যুগপৎ সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন এবং দেশেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সামরিক অভ্যুত্থান করে রাজনীতিবিদদের ‘গাদ্দার’ আখ্যা দিয়ে তিনি ক্ষমতা নিজের কাছে নিয়েছিলেন।

একচ্ছত্র ক্ষমতা বলতে যা বোঝায়, আইয়ুব খানের হাতে তা-ই ছিল। কিন্তু খ্যাতির আকাক্সক্ষায় তিনি ‘জেনারেল’ থেকে ‘ফিল্ড মার্শাল’ হতে চাইলেন। ‘ফিল্ড মার্শাল’ হতে হলে একটা যুদ্ধ হতে হবে। ১৯৬৫ সালে তাই যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল।

ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ১৭ দিন যুদ্ধ হয়েছিল। ভারতের সেনারা যখন ঘোষণা করলেন যে তারা লাহোরে গিয়ে চা খাবেন, তখন সম্বিত ফিরে পেলেন আইয়ুব খান। সোভিয়েত রাশিয়াকে ধরে তাসখন্দে ভারতের সঙ্গে সন্ধি করে আইয়ুব দেশে ফিরলেন।

যুদ্ধে যে পাকিস্তান হেরে গেছে, এটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ জনগণকে বুঝতে দিলো না। তারা প্রচারণা-প্রোপাগান্ডা চালাতে লাগল— মাশাআল্লাহ, আসমান থেকে ফেরেশতা এসে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছে, পাকিস্তান তাই ‘জিতেগা’।

আইয়ুব খান দেখতে পেলেন, আমেরিকা তাকে গাছে উঠিয়ে দিয়ে মই সরিয়ে নিচ্ছে। তাই দ্রুত তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার শরণাপন্ন হলেন। এ ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি তার আস্থা ছিল। পরবর্তীকালে জেনারেল আইয়ুব খান তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন,

সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয় ৩ এপ্রিল, ১৯৬৫ সালে। ... দাবা খেলার প্রাথমিক চালে সোভিয়েতের যে খ্যাতি রয়েছে, সেটা দেখলাম মিথ্যা নয়। [মুহম্মদ আইয়ুব খান: প্রভু নয় বন্ধু, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, করাচি-ঢাকা-লাহোর, ১৯৬৮, পৃষ্ঠা ২১৬]

তাসখন্দ (বর্তমান উজবেকিস্তানের রাজধানী, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ) থেকে আইয়ুব খান এমনভাবে ফিরলেন যেন পাকিস্তানের জনগণ তাকে ‘বিজয়ী বীর’ মনে করে। যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন। তাই নিজেই নিজেকে ‘ফিল্ড মার্শাল’ বলে অভিহিত করলেন।

ভারত এত বড় দেশ, অনেক বড় তার সেনাবাহিনী। কিন্তু সেখানেও ‘ফিল্ড মার্শাল’ বিরল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের সেনাবাহিনী যে শৌর্য-বীর্য দেখিয়ে পাকিস্তানকে পরাজিত করতে সমর্থ হয়েছিল, তার জন্য ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ ‘ফিল্ড মার্শাল’ উপাধি পেয়েছিলেন। ভারতে তিনিই প্রথম ‘ফিল্ড মার্শাল’। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রথম ভারতীয় সেনাপ্রধান কোদানদেরা মদপ্পা কারিয়াপ্পাকে অবশ্য ‘জাতির প্রতি দৃষ্টান্তমূলক সেবার প্রতি কৃতজ্ঞতা’ হিসেবে ১৯৮৬ সালে ‘ফিল্ড মার্শাল’ পদমর্যাদা দেওয়া হয়।

এদিকে পাকিস্তানে সেই ১৯৬৫ সালের পর ছয় দশকে আর ‘ফিল্ড মার্শাল’ নেই। সেভাবে যুদ্ধও হচ্ছে না ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে। জাঁদরেল-জাঁদরেল জেনারেলরা কখনো প্রত্যক্ষভাবে, কখনো পরোক্ষভাবে পাকিস্তানে সেনা শাসনই চালিয়ে যাচ্ছেন।

আইয়ুব খানের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৯ মাস যুদ্ধ করেও ‘ফিল্ড মার্শাল’ হতে পারেননি। কারণ হাতেনাতে ধরা খেয়ে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন। জেনারেল জিয়াউল হক, জেনারেল পারভেজ মোশাররফরাও ‘ফিল্ড মার্শাল’ হতে পারেননি। কিন্তু বাজিমাৎ করে দিলেন পাকিস্তানের বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির।

বর্তমান পাকিস্তানের অসীম ক্ষমতার অধিকারী আসিম। ইমরান খানকে জেলে ঢুকিয়ে পুতুল জারদারি-শাহবাজ-বিলওয়ালকে সামনে রেখে ঢাল হিসেবে তিনিই পাকিস্তান শাসন করছেন। এত ক্ষমতা, কিন্তু তাতেও পেট ভরে না! তাই একটা যুদ্ধ চাই। ১৯৬৫ সালের পর ২০২৫ সালে এসে প্রায় ৬০ বছর পর ভারত-পাকিস্তান আবার যুদ্ধ হলো শুধু একজন জেনারেলকে ‘ফিল্ড মার্শাল’ বানানোর জন্য!

মাত্র ছয় দিন (৪ মে থেকে ১০ মে) মেয়াদ ছিল এ ‘যুদ্ধে’র। আর এতেই গদগদ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের মন্ত্রিসভা ২০ মে জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরকে ‘ফিল্ড মার্শাল’ বানানোর কথা ঘোষণা করে। করাচি থেকে প্রকাশিত দ্য ডনের বরাতে ঢাকার অনলাইন পোর্টাল ‘রাজনীতি ডটকম’ সে দিন দিবাগত রাতে এ খবরে জানিয়েছে, আইয়ুব খানের পর আসিম মুনীর প্রথম পাকিস্তানি, যিনি ‘ফিল্ড মার্শাল’ হলেন।

অথচ কাশ্মিরের পহেলগামে পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার জের ধরে দুই দেশের মধ্যেকার এই বিবাদকে ‘যুদ্ধ’ বলা যায় কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে বিশ্লেষকদের। এমনকি গত ১৬ মে খোদ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফই বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ থেকে দুর্দশা ছাড়া কিছুই পায়নি দুই দেশ’। [ঢাকার দৈনিক প্রথম আলো, ১৮ই মে ২০২৫]

মাত্র ছয় দিন যুদ্ধ করেই ‘ফিল্ড মার্শাল’ হয়ে গেলেন জেনারেল আসিম মুনির। অথচ তার পাপেট প্রধানমন্ত্রী শাহবাজই বলেছিলেন, এ যুদ্ধ থেকে দুর্দশা ছাড়া আর কিছুই পাননি তারা। যে যুদ্ধ দুর্দশা আনল, সেই যুদ্ধ করে কীভাবে একজন ‘ফিল্ড মার্শাল’ খেতাব পান?

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

আরাকান আর্মির অনুপ্রবেশ নিয়ে কী জানা যাচ্ছে?

সম্প্রতি বান্দরবান-মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশের ভেতরে আরাকান আর্মির সদস্যদের অনুপ্রবেশের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। থানচি উপজেলার রেমাক্রিতে সাঙ্গু নদীর চরে যেখানে অনুষ্ঠান আয়োজন এবং আরাকান আর্মির সদস্যরা উপস্থিত হয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে, সেটি মিয়ানমার সীমান্ত থেকে অন্তত দশ কিলোমিট

৪ দিন আগে

মূলধারার গণমাধ্যমের বাহন হয়ে উঠেছে ফেসবুক

ইন্টারনেটের ব্যবহার সহজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে সোস্যাল মিডিয়ার ব্যবহারেও অনেকটা বিপ্লবই ঘটে গেছে। বিপুল জনগোষ্ঠী সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন। আর অনলাইন নিউজ পোর্টলগুলোও বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। সংযুক্ত হতে হয়েছে ফেসবুকের সঙ্গেও। দ্রুত ও বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্য নিউজ পোর্টা

৫ দিন আগে

অন্তর্বর্তী সরকার পুনর্গঠন করতে হলে যেসব আইনি প্রশ্ন সামনে আসবে

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস যদি পদত্যাগ করেন, এরপর আইনি জটিলতা কী হতে পারে, তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। আইনগত দিক থেকে অন্তর্বর্তী সরকার পুনর্গঠনের সুযোগ কতটা আছে, সরকার পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আইনি কোনো বাধা আছে কিনা, এসব প্রশ্ন উঠছে ।

৫ দিন আগে

‘পদত্যাগের ভাবনার’ মতো সংকটে কীভাবে পড়লেন ড. ইউনূস?

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস গত বৃহস্পতিবার অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে এক অনির্ধারিত বৈঠকে তার পদত্যাগের ভাবনার কথা বলেছেন। সে ক্ষেত্রে নানা পক্ষের প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর অসহযোগিতায় তার সরকার কাজ করতে পারছে না বলে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন তিনি।

৫ দিন আগে