মতামত

জুলাই বিপ্লবের এক বছর: ইতিহাসের বাঁকবদল

আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২৫, ১৫: ৫৬

৫ আগস্ট ২০২৪, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মোড়। জুলাই মাসের শুরুতে যে ছাত্রনেতৃত্বাধীন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল, তা মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে রূপ নেয় এক সর্বব্যাপী গণঅভ্যুত্থানে, যার পরিণতিতে অবসান ঘটে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা ১৫ বছরের শাসনের। ৬ জুন থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশের নানা প্রান্তে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনাসহ হাজার হাজার ছাত্র-যুবা রাস্তায় নেমে আসে, দাবি জানায় ন্যায়ভিত্তিক সংস্কারের এবং জন্মসুত্রের প্রাপ্ত সুবিধার বিরুদ্ধে। আন্দোলনের তাৎক্ষণিক কারণ ছিল মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের জন্য পুনর্বহাল করা ৩০% কোটা ব্যবস্থা, যা ২০১৮ সালে উচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছিল। এই নীতির ফলে সরকারি চাকরির অধিকাংশ পদ সংরক্ষিত হয়ে পড়ছিল, মেধাভিত্তিক প্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছিলেন। আন্দোলনকারীরা স্পষ্ট করে বলেন, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদাহানি করতে চায় না, তাদের লক্ষ্য ছিল ঐতিহাসিক স্মৃতিকে রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহারের প্রতিবাদ। সেই সময়ের স্লোগান, “বিচার চাই, সংরক্ষণ নয়” প্রজন্মের গভীর মেধানির্ভর সমাজ ব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে।

কিন্তু সরকার সংলাপের পরিবর্তে বেপরোয়া দমন-পীড়ন শুরু করে। ১৫ জুলাই থেকে পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে অভিযান চালায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে রাতের অন্ধকারে হানা দেওয়া হয়, ছাত্রদের হোস্টেল থেকে টেনে বের করে নির্যাতন করা হয়, নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানো হয়, চিকিৎসার সুযোগ সীমিত করে দেওয়া হয়। হাসপাতালগুলোতে আহত ছাত্রছাত্রীদের ঢল নামলেও সেই রেকর্ড বা সিসিটিভি ফুটেজ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারী হস্তক্ষেপে গায়েব করে দেওয়া হয়। ১৯ জুলাই একটি দিনেই ৭৫ জনের মৃত্যু হয়, এবং ১৮ জুলাইয়ের মধ্যে সরকার স্বীকার করে ৩২ জন শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। পরবর্তীতে তদন্তে জানানো হয় ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ১,৫৮১ জন নিহত ছাড়িয়ে গেছে, আহত হয়েছেন ২০,০০০+, এবং গ্রেফতার হয়েছেন ১১,০০০+। ইউনিসেফ নিশ্চিত করে যে নিহতদের মধ্যে ৬ বছরের শিশুও ছিল।

৫ আগস্টে সহিংসতা চরমে পৌঁছালে দেশের বিভিন্ন শহরে সমন্বিত হামলায় শত শত প্রাণহানি ঘটে, বহুজন নিখোঁজ হন। তখনই দেশের জনগণ, সেনাবাহিনীর অংশবিশেষ এবং আন্তর্জাতিক সমাজের চাপ একত্রে সরকারকে বৈধতার সংকটে ফেলে। নিরাপত্তা বাহিনীর ভেতরে বিদ্রোহ, কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া এবং সুশীল সমাজের সোচ্চার ভূমিকার ফলে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ ও পদত্যাগে বাধ্য হন। সেদিনই সেনাপ্রধান এক অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা দেন—নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস হন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান এবং সংসদ বিলুপ্ত করা হয়। এক বছর পরে, ৫ আগস্ট ২০২৫, বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো পালন করছে “জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস” রাষ্ট্রীয় ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকার “জুলাই প্রোক্লেমেশন” চালু করতে যাচ্ছে, যার আওতায় থাকছে: কোটা ব্যবস্থার সংবিধানিকভাবে বাতিল ঘোষণা, জুলাই হত্যাযজ্ঞ তদন্তে ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস কমিশন, ছাত্রসংসদ পুনরায় চালু, নির্বাচন কমিশনের রাজনীতি-নিরপেক্ষ সংস্কার ও স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ । জাতিসংঘ ও কমনওয়েলথ এই উদ্যোগগুলোর প্রশংসা করলেও সতর্ক করেছে যে টেকসই বিচার, সংবিধানিক স্বচ্ছতা এবং সংখ্যালঘু অধিকার নিশ্চিত না হলে এই সংস্কার অর্থহীন হয়ে পড়বে।

রাজনৈতিক বাস্তবতা জটিল। আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধে অনুপস্থিতিতে বিচারের মুখোমুখি। জামায়াতে ইসলামি রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেছে। ড. ইউনূস সংবিধান পুনর্গঠন ও সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিয়ে নির্বাচন পিছিয়ে ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে জুন ২০২৬-এর মধ্যে করার প্রস্তাব দিলেও রাজনৈতিক দলগুলো এই সময়সূচি নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে যে সহিংসতা, সংখ্যালঘু নিপীড়ন এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বন্ধ না হলে বিপ্লবের ফসল বৃথা যাবে।

জুলাই বিপ্লব শুধু একটি সরকারের পতন নয়, এটি ছিল সামাজিক ন্যায় ও শাসনব্যবস্থার পুনর্বিবেচনা। একসময় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানার্থে প্রণীত কোটা, ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক পরিবারের সুবিধাভোগের হাতিয়ারে পরিণত হয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদিবাসী, গ্রামীণ দরিদ্র, প্রতিবন্ধী, এদের জন্য কোটা ছিল না, সুযোগও ছিল না। ছাত্ররা চেয়েছিল অন্ধ সংরক্ষণের বদলে একটি স্বচ্ছ, তথ্যভিত্তিক ও প্রয়োজনে সংরক্ষণনীতি, যাতে মেধা ও অন্তর্ভুক্তি পাশাপাশি চলতে পারে। এই আন্দোলন একজোট করেছিল ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবী ও অভিভাবকদের। প্রথমবারের মতো ভয় নয়, ঐক্য ও সংলাপ, এই ছিল ছাত্রসমাজের উত্তর।

আজ এক বছর পর, বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে সম্ভাবনা ও ঝুঁকির চৌরাস্তায়। “জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন”, যেটি ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে গঠিত হয়, শহীদদের স্মরণে কাজ করছে ও পরিবারকে সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু এখনও বিচার অসম্পূর্ণ, গঠনগত সংস্কার বাস্তবায়ন হয়নি, এবং নারী, আদিবাসী, তৃতীয় লিঙ্গ, ও শ্রমজীবীদের প্রতিশ্রুত অন্তর্ভুক্তি বাস্তবতা থেকে বহু দূরে। ৫ আগস্ট আজ শুধু একটি তারিখ নয়, এটি একটি প্রতিজ্ঞা, সত্য, ন্যায় ও আগামী প্রজন্মের অধিকারের জন্য চলমান সংগ্রাম। আগামী কয়েক মাসেই নির্ধারিত হবে, জুলাইয়ের সেই রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের আইন, প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতির সংস্কৃতিতে জায়গা করে নেবে, না কি সবই মিলিয়ে যাবে আরেকটি ভাঙা প্রতিশ্রুতির ভেতর।

লেখক: উপ-পরিচালক, মানবসম্পদ বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৪ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৫ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে