৩৬ জুলাইয়ের আলো কি মেঘে ঢাকা পড়ছে?

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২৫, ১৩: ৩৪

রক্ত আর উৎসবের মিশেলে লেখা হয়েছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অপ্রতিরোধ্য দিন— ৩৬ জুলাই। ওই দিনই ভেঙে পড়েছিল দেড় দশকের একচ্ছত্র শাসনের প্রাচীর।

দিনটি এখন ইতিহাসে খোদাই হয়ে আছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়— এটা কি কেবল রোমাঞ্চকর এক স্মৃতি, নাকি বদলে দিয়েছে দেশের ভবিষ্যৎগতি? যে আগুন জ্বলে উঠেছিল সেদিন, তা কি এখনও দীপ্ত? নাকি ঢেকে যাচ্ছে নতুন হতাশার ছায়ায়?

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। ঘুম ভাঙতেই ঢাকা শহর যেন রণক্ষেত্র। ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে সাড়া দিয়ে লাখো মানুষ যখন উত্তরার প্রবেশপথ ধরে রাজধানীতে ঢুকছিল, তখন পুরো নগরী জুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। যাত্রাবাড়ী থেকে চানখাঁরপুল, গাবতলী থেকে টিকাটুলী— সব প্রান্তেই চলছিল গুলি, কাঁদানে গ্যাস, আর দমন-পীড়ন।

সেনাবাহিনী কোথাও নিষ্ক্রিয়, কোথাও পিছু হটছে। রায়ট পুলিশের ট্রাকগুলো ধাবমান জনতার দিকে। এমন এক আতঙ্ক ছড়ানো পরিস্থিতিতে হঠাৎ খবর আসে, সেনাপ্রধান জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। সময় একাধিকবার বদলায়, কিন্তু সেই ভাষণ আর আসে না।

এর মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে খবর— প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে দেশ ছেড়েছেন। সেই খবরে ঢাকায় যেন বাঁধভাঙা উল্লাস। হাজারও মানুষ ছুটে যায় গণভবনের দিকে। সাধারণত গণভবন ও এর চারদিকে থাকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা। সেই সোমবার এর ভেতরে-বাইরে কোনো নিরাপত্তা ছিল না। লুটপাটেও কেউ বাধা দেয়নি। জাতীয় সংসদ ভবনেও লুটপাট চলে। প্রায় সারা রাত সংসদ চত্বরে চলে গণউৎসব— গান, স্লোগান আর সেলফি।

এই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটেই গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে রাখা হয় এর প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে। সরকারের ঘোষিত তিনটি প্রধান লক্ষ্য ছিল— জুলাই আন্দোলনে স্বৈরসাশসের চালানো গণহত্যার বিচার, কাঠামোগত সংস্কার এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।

তবে এক বছর পেরিয়ে এখন দেখা যাচ্ছে— এসবের কিছুটা বাস্তবায়ন হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশই অধরা। সরকারের ওপর মানুষের আস্থা ক্রমশ কমছে। হয়তো অভিজ্ঞতার অভাবে অন্তর্বর্তী প্রশাসনের দুর্বলতা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। সরকারের সিদ্ধান্ত ও কার্যকারিতায় একধরনের দিকহারা দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যাচ্ছে।

এই হতাশা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন দেখা যায় এক বছর পরও দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। বিচারিক প্রক্রিয়া দুর্বল, আর ‘মব জাস্টিস’ বারবার নিয়মতন্ত্রকে অমান্য করছে। আদালতের ভেতরেই আসামির ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে, যা ছিল এক ভয়ানক নজির।

প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণে রাজনৈতিক পক্ষপাত স্পষ্ট। সংস্কৃতি অঙ্গনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত, ভিন্নমত বা প্রতিবাদকে দমন করা হচ্ছে। ধর্মীয় মৌলবাদীদের তৎপরতা বেড়েছে। ফলে লেখক, শিল্পী ও সাংবাদিকরা আতঙ্কে কাজ করছেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল হলেও গণমাধ্যম এখনো নিয়ন্ত্রিত। অনেক পত্রিকা মালিকানা বা নেতৃত্ব বদলের মাধ্যমে প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে গেছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অসংখ্য হত‍্যা মামলা বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সরকারের প্রতি রয়েছে এক স্পষ্ট অভিযোগ— তারা এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন হলেও কর্তৃত্ববাদী চর্চার অবসান হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। ফলে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার ঝুঁকি দেখছেন তিনি।

সোমবার (৪ আগস্ট) টিআইবির এক অনুষ্ঠানে বক্তব‍্য রাখেন ড. ইফতেখার। অনুষ্ঠানে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক বছরে ৪৭১টি রাজনৈতিক সহিংসতায় ১২১ জন নিহত হয়েছেন। মব জাস্টিস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি মামলা বাণিজ্যের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোকেও নিতে হবে।

এদিকে আরও গভীর উদ্বেগের বিষয়— যারা ৩৬ জুলাইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তারাই এখন নানা বিতর্কের কেন্দ্রে— যেখানে রয়েছে আর্থিক কেলেঙ্কারি, ক্ষমতার অপব্যবহার, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের অভিযোগ। তারুণ্য যাদের কাঁধে ভর করে রাস্তায় নেমেছিল, তারাই আজ হতাশ, অনেকেই পাসপোর্ট লাইনে দাঁড়িয়ে আছে বিদেশে চলে যাওয়ার আশায়।

এর মধ্যে অবশ্য শেখ হাসিনা ও তার সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে। সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন হয়েছেন রাজসাক্ষী। যার অধীন পুলিশ বাহিনী জুলাই-আগস্টের গণন্দোলনে দমনে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল, তাকেই রাজসাক্ষী করা নিয়েও আছে প্রশ্ন।

সরকার বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ শুরু হয়েছে, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ প্রস্তুত হচ্ছে। ‘জুলাই সনদ’ ও ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ প্রণয়ন প্রায় চূড়ান্ত। এগুলো একধরনের নতুন সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক পথনকশা তৈরি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এরই মধ‍্যে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা রয়েছে। হয়তো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে কয়েকদিনের মধ‍্যে। কিন্তু জনমনে রয়েছে গভীর শঙ্কা— এই নির্বাচন আদৌ হবে তো? নাকি কোনো অঘটন থামিয়ে দেবে প্রক্রিয়াকে? কেউ বলছেন নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে, কেউ বলছেন ‘জাতীয় ঐক্যমতের সরকার’ নামে নতুন অনির্বাচিত শাসন প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। ঘুরেফিরে আলোচনায় আসছে ১/১১-এর অতীত।

এই বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠে— ৩৬ জুলাইয়ের যে আলো এসেছিল রক্ত, শোক আর প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে, তা কি এখন মেঘে ঢাকা পড়ছে? নাকি এই অস্থিরতা আর দ্বিধার ভেতর দিয়েই নতুন কোনো দিশা তৈরি হচ্ছে?

বাংলাদেশ এখন দাঁড়িয়ে আছে এক সন্ধিক্ষণে। ফ‍্যাসিবাদের পতন হলেও একদিকে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, অন্যদিকে সম্ভাবনার ক্ষীণ আলো। জাতিসংঘের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ মিশন বলছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সহিংসতায় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ১,৪০০ ছাড়াতে পারে, যদিও সরকারি হিসাব বলছে ৮৩৪ জন।

এই শহিদরা কি কেবল আরেকটি ‘স্মরণসভা’ হয়ে থাকবে? নাকি তারা হয়ে উঠবে এক জীবন্ত আদর্শ?

সম্ভবত নবম শ্রেণিতে পড়েছিলাম ‘সময়ের প্রয়োজনে’ গল্পটি, লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় নিখোঁজ হওয়া লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। তিনি লিখেছেন—

‘প্রথম প্রথম কাউকে মরতে দেখলে ব্যথা পেতাম। কেমন যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়তাম। কখনো চোখের কোণে এক ফোঁটা অশ্রু হয়তো জন্ম নিত। এখন অনেকটা সহজ হয়ে গেছি… হয়তো অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে।’

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে জহির রায়হানের এই বর্ণনায় আজকের বাস্তবতার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়— যেখানে মৃত্যু ও শোক বারবার আসে, কিন্তু প্রতিবারেই মানুষ যেন একটু করে অনুভূতিহীন হয়ে পড়ে।

৩৬ জুলাইয়ের আলো এখনো নিভে যায়নি। কিন্তু চারপাশের মেঘ ক্রমশ ঘন হচ্ছে। এই অন্ধকারের ভেতর দিয়েই হয়তো আবার আলোর দিশা খুঁজে নিতে হবে— যদি আমরা ভুলে না যাই কেন সেই আলো একদিন জ্বলে উঠেছিল।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

জুলাই ঘোষণা ও নির্বাচন ঘিরে আশা-নিরাশা

গণঅভ্যুত্থানের প্রারম্ভে যে গণআকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে প্রথমত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, সুশীল সমাজ ও সর্বস্তরের জনসাধারণের পক্ষ থেকে, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক সরকারগুলো যে যথাযথভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গ্রাহ্য করেনি, এই

৪ দিন আগে

নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা— শেষ, নাকি সাময়িক বিরতি?

বিএনপি, যাদের এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজনীতিতে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল, তারা চাইছিল ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হোক, যাতে তারা নিজেদের অবস্থান ফের শক্ত করতে পারে। তবে এনসিপি ও জামায়াত মনে করে, আগে সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন দরকার—তারপরেই জাতীয় নির্বাচন দেওয়া যেতে পার

৪ দিন আগে

পুঁজিবাজারের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর এখনই সময়

তবে বহু বছর পর ব্যাংক ও বীমা খাত একসঙ্গে ধনাত্মক ধারায় প্রবেশ করেছে। এর কৃতিত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দাবি করতেই পারেন। তিনি ধারাবাহিকভাবে ব্যাংক খাতে নীতি ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে গেছেন এবং আমানতকারীদের আস্থা ধরে রেখেছেন।

৮ দিন আগে

মধ্যপ্রাচ্যের দুষ্টক্ষত ইসরাইল আরববিশ্বের নিরাপত্তায় হুমকি

আমরা যদি পেছনের দিকে ফিরে তাকাই দেখা যায় যে, যুক্তরাজ্যই মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার বিষয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার বালফোর ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর জায়নবাদী নেতা ব্যারণ রথচাইল্ডকে এক পত্রে বৃটিশ সরকার কর্তৃক ইহুদী জনগণের জন্য ফিলিস্তিনে জাতীয় আবাসভূমি গড়ে

৯ দিন আগে