কাদেরের ‘লাগাম টানতে’ আদালতে যাবেন আনিসুল-হাওলাদাররা!

শাহরিয়ার শরীফ
প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৫, ১০: ০০
কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুসহ নেতাকর্মীদের একাংশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে সরাতে তৎপর হয়েছেন বলে তথ্য মিলছে। ছবি কোলাজ: রাজনীতি ডটকম

সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে অন্যরা যখন মাঠে ছুটছেন, তখন ঘর সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জিএম কাদের। রাজনীতির মাঠে জাপা দল হিসেবেই যখন কোণঠাসা, এমন সময়ে দলের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে।

এর জের ধরে কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই গঠনতন্ত্রে দেওয়া ক্ষমতাবলে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার ও মহাসচিব মুজিবুল হব চুন্নুকে অব্যাহতি দিয়েছেন জি এম কাদের। সব মিলিয়ে ১১ জনকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনায় জাপার ভেতর-বাইরে চলছে তোলপাড়।

তবে জাপা চেয়ারম্যানের এমন সিদ্ধান্তকে অগঠনতান্ত্রিক বলছেন অব্যাহতি পাওয়া নোতারা। বলছেন, জাপা চেয়ারম্যানের ক্ষমতায় লাগাম টানতে উচ্চ আদালতে যাওয়ার পরিকল্পনা পর্যন্ত রয়েছে তাদের।

জাতীয় পার্টি থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘দলের চেয়ারম্যান গঠনতন্ত্রের ধারা ২০-এর উপধারা (১)/ক-এর ক্ষমতা প্রয়োগ করে যা খুশি তাই করছেন। অগণতান্ত্রিক আচরণ করছেন। আমরা এর বিরোধীতা করে আসছি। এই সুযোগ তাকে আর দিতে চাই না। আমরা আদালতের আশ্রয় নেব।’

কবে নাগাদ আদালতে যাবেন— এমন প্রশ্নের জবাবে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘খুব শিগগিরই আমরা কোর্টে যাব।’

জিএম কাদেরপন্থি নেতা হিসেবে পরিচিত জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও রংপুরের সাবেক সিটি মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা অবশ্য শীর্ষ নেতাদের আদালতে যাওয়ার পরিকল্পনাকে আমলে নিচ্ছেন না।

মোস্তফা রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘তারা মাত্র কয়েকজন লোক। তৃণমূল তো জিএম কাদেরের সঙ্গে আছে। ভয়ের কিছু নেই। দল তো গঠনতন্ত্র দিয়ে চলে। কে কী বলল, করল তা দেখার সুযোগ নেই।’

দুপক্ষের মুখোমুখি এমন পরিস্থিতিতে আসছে নির্বাচনের আগে আবারও জাপায় ভাঙন দেখা দেবে কি না— তা নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা চলছে। তবে অব্যাহতি পাওয়া নেতারা ভাঙন নয়, সবাইকে নিয়ে চলার ওপর জোর দিতে চান। তারা বলছেন, তারা জাতীয় পার্টিতেই থাকবেন। দলকেও ভাঙতে দেবেন না। কাউন্সিল করে সেখানে নতুন নেতৃত্ব বাছাই করা হবে।

জিএম কাদের বলয়ের বাইরের এসব নেতারা বলছেন, গঠনতন্ত্রের ২০-এর উপধারা (১)/ক-এর অবাধ প্রয়োগ জাতীয় পার্টিতে একনায়কতন্ত্র বিরাজের সুযোগ করে দিয়েছে। তাই তারা এই ধারার পরিবর্তন চান। দলীয় ফোরামে পরিবর্তন করার সুযোগ করতে না পারলে আদালতের দ্বারস্থ হবেন তারা।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘নিশ্চিত থাকুন— এই ধারা কোর্টে চ্যালেঞ্জ করলে আমরাই জয়ী হব। কারণ কোনোভাবেই এ ধারা চলতে পারে না। এ ধারা বাদ দিলে একক ক্ষমতা চলে যাবে। এ কারণেই চেয়ারম্যান যাকে খুশি বাদ দিচ্ছেন।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম অবশ্য জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ এ কোন্দলকে গুরুত্ব দিতে রাজি নন।

রাজনীতি ডটকমকে তিনি বলেন, ‘এরশাদ ক্ষমতায় থাকতে আগ্রহীদের নিয়ে জাতীয় পার্টি দল করেন। এখনো সেই ধারা চলছে। এরশাদের বিদায়ের পর তার স্ত্রী রওশন এরশাদ, ভাই জিএম কাদেরও একইভাবে চলছেন। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আবার দুই ভাগ হয়ে গেছেন। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে ১৬ বছর থাকায় তাদের রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য ছিল না। তাদের জনপ্রিয়তাও নেই। তাই এদের কোন্দল নিয়েও মানুষের মাথা ব্যাথা নেই।’

জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০-এর উপধারা (১)/ক নিয়ে অধ্যাপক শামছুল বলেন, এটা একনায়কতান্ত্রিক ধারা। কারণ দলে কেউ বিরোধী হলেই বহিষ্কার। এটা তো গণতন্ত্র নয়। এখন সংক্ষুদ্ধরা যদি আদালতে যায় সেখানে সংবিধানের যেসব নাগরিক অধিকারের বিষয়গুলো আছে তা বিশ্লেষণ করে উপস্থাপন করা গেলে ভালো ফল পেতেও পারে। তবে আদালতের বিষয় আগে তো আগে বলা মুশকিল। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলে এমন ধারা থাকা উচিত নয়।’

গঠনতন্ত্রে কী ক্ষমতা দেওয়া আছে চেয়ারম্যানকে?

জাপার গঠনতন্ত্রের ২০-এর ১ উপধারা ‘ক’-তে বলা হয়েছে, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান পার্টির সর্বপ্রধান কর্মকর্তা। তিনি পার্টির ঐক্য, সংহতি ও মর্যাদার প্রতীক। গঠনতন্ত্রের অন্য ধারায় যাই উল্লেখ থাকুক না কেন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বিশেষ ক্ষমতা পাবেন।

গঠনতন্ত্র বলছে, এই বিশেষ ক্ষমতাবলে জাপা চেয়ারম্যান প্রয়োজনে প্রতিটি স্তরের কমিটি গঠন, পুনর্গঠন, বাতিল বা বিলুপ্ত করতে পারবেন। তিনি যেকোনো পদ তির বা অবলুপ্ত করতে পারবেন। চেয়ারম্যান জাতীয় পার্টির যেকোনো পদে যেকোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ, যেকোনো পদ থেকে যেকোনো ব্যক্তিকে অপসারণ ও যেকোনো ব্যক্তিকে তাহার স্থলাভিষিক্ত করিতে পারিবেন।’

যে কারণে অব্যাহতি, অস্থিরতা

এবার জাতীয় পার্টিতে দলের জাতীয় সম্মেলন ও এতে চেয়ারম্যান-মহাসচিব পদে অন্যদের প্রার্থী হওয়ার ইস্যু ঘিরে অস্থিরতা শুরু হয়। অস্থিরতা কিছুদিন ভেতরে-ভেতরে থাকলেও গত ৭ জুলাই হঠাৎ করে মহাসচিব পদ থেকে মুজিবুল হক চুন্নুকে সরিয়ে দেন জাপা চেয়ারম্যান। তার জায়গায় নিয়োগ দেন শামীম হায়দার পাটোয়ারিকে। এ ছাড়া চুন্নুসহ দলীয় সব পদ-পদবী থেকে অব্যাহতি দেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকেও।

জাপা চেয়ারম্যানের এমন সিদ্ধান্ত বিস্মিত করে দলের নেতাকর্মীদেরই। দলের সাবেক একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘কোনো সুস্থ মানুষ এভাবে দল চালাতে পারে না। জিএম কাদের তার পছন্দ না হলেই নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেন। এ কারণেই দলের এমন অবস্থা। সামনে হয়তো আরও খারাপ সময় আসতে পারে।’

এদিকে অব্যাহতি দিয়ে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অব্যাহতি দেওয়া এই তিন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে গত ২৫ জুনের মতবিনিময় সভায় জেলা, মহানগর কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনেন এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। পরে ২৮ জুন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সভায় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ওই তিন নেতাকে সব পদ-পদবী থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

এ প্রসঙ্গে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তা বেআইনি। আমরা সবাই আগের পদেই আছি। ২৮ তারিখের বৈঠকে তো কোরামই হয়নি।’

এদিকে শীর্ষ তিন নেতাকে দল থেকে অব্যাহতি নিয়ে আলোচনা হলেও জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে আরও আটজন নেতাকে অব্যাহতি হয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের এক প্রেসিডিয়াম সভায় সিদ্ধান্ত হয়— যাদের মাসিক চাঁদা এক বছর বকেয়া, তাদের পদ চলে যাবে। সেই সিদ্ধান্তের কারণেই এ নেতাদের দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘কত নিচু মানসিকতার এরা! এত বছর ধরে দল করছে মানুষগুলো, প্রত্যেকের কত অবদান। এরা কি চাঁদা পরিশোধের সামর্থ্য রাখে না? শুধু স্মরণ করিয়ে দিলেই তো সবাই টাকা দিয়ে দিত। এটা একটা অজুহাত।’

উলটো জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে আনিসুল বলেন, আগের বৈঠকে চেয়ারম্যানের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে কথা হয়েছে। তিনি মনোনয়নের কোটি কোটি টাকা দলের ফান্ডে জমা দেননি। এসব নিয়ে কথা বলায় ভালো লাগেনি। আমরা ধারা ২০–এর ১/(ক) ধারাটি বদলানোর কথা বলেছি। সেটা তিনি মানবেন না। নিজে রাজার মতো থাকবেন। এটা তো হতে পারে না। এটাই বড় কারণ।

এমন অবস্থায় দলের ভবিষ্যত কী— এমন প্রশ্নের জবাবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জাপা নেতা রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘আমরা দলের ভাঙন চাচ্ছি না। আবারও চেয়ারম্যানের এমন সিদ্ধান্ত মেনেও নিচ্ছি না। কারণ শামীম পাটোয়ারী ছাড়া কে আছে তার সঙ্গে? ১৪ জুলাই প্রয়াত চেয়ারম্যানের মৃত্যুবার্ষিকীতে সাবেক-বর্তমানদের মিলনমেলা হবে। এরপরই দলকে শক্তিশালী করতে করণীয় ঠিক করব।’

যতবার ভাঙনের কবলে পড়েছে জাপা

সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের হাতে গড়া দল জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে বারবার ভাঙনের মুখে পড়েছে। এর মধ্যে নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর প্রথমবারের মতো ভাঙন ধরে জাতীয় পার্টিতে। দেশের ইতিহাসে এই দলেরই সবচেয়ে বেশি ভাঙনের ঘটনা ঘটেছে।

এরশাদের জীবদ্দশায় জাপা, জেপি, বিজেপি ও জাপা (জাফর) নামে চার টুকরো হয়ে যায়। এরশাদের মৃত্যুর পর সহধর্মিণী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে আরেকটি জাপা তৈরি হয়েছে। তবে রওশন গ্রুপটি তেমন কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রমে দৃশ্যমান নেই, মাঝে মধ্যে বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ ওই গ্রুপটির কার্যক্রম।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

ফরিদা পারভীনকে দেখতে হাসপাতালে মির্জা ফখরুল

পরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, ফরিদা পারভীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক অমূল্য রত্ন। লালনসংগীতে তিনি অদ্বিতীয়া, দেশের মানুষের ভালোবাসায় আবদ্ধ এক মহান শিল্পী।

১ দিন আগে

সীমান্ত হত্যা আমরা কখনোই মেনে নেব না: নাহিদ ইসলাম

এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে। আমাদের পানির ন্যায্যহিস্যা দেওয়া হয়নি। অর্থনৈতিকভাবে, সাংস্কৃতিকভাবে বারবার বাংলাদেশকে অবদমন করা হয়েছে।’

১ দিন আগে

তৃণমূল ঐক্যবদ্ধভাবে জিএম কাদেরের পাশে : জাতীয় পার্টির মহাসচিব

জাতীয় পার্টির মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেছেন, দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা সবসময় চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরের পাশে ছিলেন এবং আছেন। তিনি বলেন, “বিগত সময়েও কিছু সিনিয়র নেতা বেঈমানি করলেও তৃণমূল কখনোই দল ছেড়ে যায়নি। গেল ২৫ জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে নেতা-কর্মীরা জিএম কাদেরের প

১ দিন আগে

শুধু হাসিনা নয়, আওয়ামী লীগেরও বিচার হওয়া উচিত: ফখরুল

মির্জা ফখরুল বলেন, সর্বশেষ গণহত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন শেখ হাসিনা। গণহত্যার জন্য শুধু শেখ হাসিনা নয়, দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগেরও বিচার হওয়া উচিত।

২ দিন আগে