কুসংস্কার
দাঁতে কি সত্যিই পোকা হয়? কী বলছে বিজ্ঞান?

“দাঁতে পোকা ধরেছে”—এই কথা আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। গ্রামগঞ্জে দাঁতব্যথা হলেই অনেক সময় আশপাশের লোকজন বলত, বুঝি দাঁতের মধ্যে পোকা ঢুকে গেছে! এই বিশ্বাস এতটাই জনপ্রিয় যে এখনো অনেক কবিরাজ দাঁতব্যথার চিকিৎসা দিতে গিয়ে রোগির সামনে দাঁত থেকে সাদা বা বাদামি রঙের এক ধরনের ‘পোকা’ বের করে দেখান। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেই পোকা রোগির কেউ চোখের সামনে দেখেন না—কিন্তু কবিরাজ ঠিকই দাঁত থেকে সেটা ‘তুকতাক’ করে বের করে ফেলেন। অনেক সময় রোগিও বিশ্বাস করে বসেন, দাঁতের মধ্যে নিশ্চয়ই সত্যি কোনো পোকা ছিল! কিন্তু বিজ্ঞান এই ব্যাপারে একেবারে ভিন্ন কথা বলছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, দাঁতে পোকা বলে কিছু হয় না। মুখে থাকা অতি ক্ষুদ্র ব্যাকটেরিয়া, চিনিযুক্ত খাবার এবং সময়মতো দাঁতের যত্ন না নেওয়াই দাঁতের ক্ষয় এবং ব্যথার আসল কারণ। দাঁতের ওপরের শক্ত আবরণ—যাকে এনামেল বলে—সেটি খুবই মজবুত। সেই স্তরের ভেতরে রয়েছে ডেন্টিন ও স্নায়ু। মুখে যেসব ব্যাকটেরিয়া বসবাস করে, তারা চিনিযুক্ত খাবার পেয়ে সেটি থেকে অ্যাসিড তৈরি করে। এই অ্যাসিড দাঁতের এনামেল ধীরে ধীরে ক্ষয় করে দেয়। একসময় দাঁতের ভেতর গর্ত তৈরি হয়, ব্যথা শুরু হয়, এমনকি দাঁত ফেটে যেতেও পারে। এই ক্ষয়প্রক্রিয়াকে বলা হয় ডেন্টাল ক্যারিজ।
যে কালো বা বাদামি দাগ অনেক সময় দাঁতে দেখা যায়, কিংবা যেখানে গর্ত হয়েছে, সেখানে খাবার আটকে গেলে মনে হয় ভেতরে কিছু নড়ছে—সেখান থেকেই ‘পোকা ধরেছে’ বলে মানুষের মনে ভ্রান্ত ধারণা জন্ম নেয়। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে সেখানে কোনো পোকা থাকে না, বরং ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে দাঁতের বিভিন্ন স্তরে ক্ষয় ধরা পড়ে।
এই প্রসঙ্গে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ডেন্টাল রিসার্চার ড. রেবেকা ফিনচ বলেন, “দাঁতের ক্ষয় কোনো বাহ্যিক পোকার কারণে হয় না। এটি ব্যাকটেরিয়া ও খাদ্যের রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল। পোকা শব্দটি মূলত প্রাচীন ভ্রান্ত ধারণার উত্তরাধিকার।” তিনি আরও বলেন, “ডেন্টাল সমস্যাগুলোর আধুনিক ব্যাখ্যা দিতে না পারার কারণে একসময় মানুষ দাঁতের ব্যথাকে অদৃশ্য পোকার কাজ বলে মনে করত।”
এমন বিশ্বাস অবশ্য এক দিনে তৈরি হয়নি। দাঁতের ব্যথা বা ফাঁপা নিয়ে মানুষের অভিজ্ঞতা হাজার বছরের পুরোনো। খ্রিস্টপূর্ব যুগের ব্যাবিলনীয় চিকিৎসাগ্রন্থ, প্রাচীন চীনা ও গ্রিক চিকিৎসাতেও দাঁতের ব্যথার জন্য দায়ী করা হতো এক ধরনের ‘দাঁতের পোকা’কে। মধ্যযুগেও অনেক ইউরোপিয়ান চিকিৎসক দাঁত ব্যথা হলে পোকা বের করার জন্য গরম লোহা ব্যবহার করতেন। তবে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই ভুল ধারণা দূর হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে এখনো অনেক কবিরাজ, তুকতাকওয়ালা এবং তথাকথিত প্রাকৃতিক চিকিৎসক এই বিশ্বাস ব্যবহার করে সহজ-সরল মানুষদের প্রতারিত করেন।
তবে কবিরাজেরা দাঁত থেকে পোকা কীভাবে ‘বের করে’—এই প্রশ্নটাও গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর প্রতারনাবিদ্যার অধ্যাপক ড. এলিজাবেথ ম্যাকলিওড বলেন, “দাঁতের পোকা বের করার বিষয়টি এক ধরনের হাতসাফাই। কবিরাজেরা গাছের পচা শেকড় বা মিশ্রণের মধ্যে আগে থেকেই পোকার মতো কিছু লুকিয়ে রাখেন। পরে দাঁতে সেটা ছোঁয়ানোর পর এক ধরণের অভিনয় করে বের করে দেখান। আসলে সেগুলো দাঁতের নয়, আগে থেকেই প্রস্তুত করা কিছু লার্ভা বা অন্য কীট।”
এই প্রতারণা মূলত মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নেয়। কেউ যদি বুঝত দাঁতের গর্ত বা দাগ পোকা নয়, বরং ব্যাকটেরিয়ার কারণে তৈরি, তাহলে আর এমন ধোঁকায় পড়ত না।
আজকের দিনে দাঁতের যত্ন নেওয়া খুব কঠিন নয়। শুধু দিনে দুবার ব্রাশ, মিষ্টিজাতীয় খাবার কম খাওয়া, খাওয়ার পর কুলি করা এবং ছয় মাস পরপর দাঁতের ডাক্তার দেখালেই অধিকাংশ সমস্যা এড়ানো সম্ভব। দাঁতের গর্ত হলে শুরুতে ছোট একটি ফিলিং করলেই সেটি ভালো হয়ে যায়। পরে যদি স্নায়ু পর্যন্ত ক্ষতি হয়ে যায়, তাহলে রুট ক্যানাল বা এক্সট্র্যাকশন দরকার হয়, যা খরচসাপেক্ষ এবং অনেক সময় ব্যথাও সইতে হয়।
দাঁতের চিকিৎসা আজ বিজ্ঞাননির্ভর ও সম্পূর্ণ চিকিৎসাগত বিষয়। যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডনের ডেন্টাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. টমাস ম্যাকগ্রেগর বলেন, “দাঁতের ক্ষয় এখন পুরোপুরি প্রতিরোধযোগ্য এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য। তবে সমস্যা হলো, মানুষ এখনো ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কারে বিশ্বাস করে। ফলে তারা আধুনিক চিকিৎসা নিতে চায় না।”
এটাই আমাদের বড় শিক্ষা—সতর্কতা ও সচেতনতা আমাদের দাঁতের সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারে। আর সেইসঙ্গে দরকার সমাজে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া। যেন কেউ আর অদৃশ্য ‘পোকা’র গল্পে না বিশ্বাস করে, বরং দাঁতের প্রকৃত কারণ বোঝে ও চিকিৎসা নেয় আধুনিক পদ্ধতিতে।
সবশেষে বলাই যায়, দাঁতের ভেতরে পোকা থাকে না—থাকে অজ্ঞানতা, ভুল ধারণা আর অবহেলা। দাঁতের যত্ন নিয়ে থাকলে কোনো ‘পোকা’ আর আপনার হাসি নষ্ট করতে পারবে না।
সূত্র: হাউ ইট ওয়ার্কস