ইতিহাস
মে দিবসের ইতিহাস

বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের জন্য ১ মে একটি স্মরণীয় দিন। এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস নামে আমরা চিনি। এটি এমন একটি দিন, যা শুধু ছুটি কিংবা আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং এটি এক ঐতিহাসিক আন্দোলন ও আত্মত্যাগের স্মারক। আজকের দিনে শ্রমিকরা যে অধিকার ভোগ করেন, সেগুলোর পেছনে রয়েছে শতবর্ষের রক্ত-ঘাম-অশ্রু মাখা সংগ্রাম। মে দিবস সেই সংগ্রামের ইতিহাস বুকে লালন করে।
১৮শ শতকের শেষের দিকে শিল্প বিপ্লবের পর পাশ্চাত্য জগতে কারখানার উৎপাদন বেড়ে যায়। যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকদের কাজের চাহিদাও বাড়ে। কিন্তু সেই সময় শ্রমিকদের জন্য কাজের পরিবেশ ছিল অমানবিক। দিনে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা টানা কাজ করতে হতো। বিশ্রামের সুযোগ থাকত না, নিরাপত্তার বালাই ছিল না, এবং মজুরি ছিল খুবই কম। নারী ও শিশুরাও এই শ্রমের যন্ত্রণা থেকে বাদ পড়েনি। মালিকেরা শ্রমিকদের মানুষ হিসেবে না দেখে কেবল উৎপাদন যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন।
এই অমানবিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে শুরু করে। তারা সংগঠিত হতে থাকেন। তাদের প্রধান দাবি ছিল কাজের সময় নির্ধারণ করা—দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম এবং ৮ ঘণ্টা অবসর। এই দাবিকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। অবশেষে ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শুরু হয় এক ঐতিহাসিক ধর্মঘট। লাখো শ্রমিক কারখানার কাজ বন্ধ রেখে রাস্তায় নামেন, শান্তিপূর্ণভাবে তারা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি জানান।
শুরুতে আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও ৩ মে ও ৪ মে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ৪ মে শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ারে শ্রমিকদের একটি সমাবেশ চলছিল। তখন হঠাৎ একটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটে, যার উৎস আজও স্পষ্ট নয়। পুলিশ পাল্টা গুলি চালায়, প্রাণ হারান কয়েকজন শ্রমিক ও পুলিশ সদস্য। এই ঘটনার পর পুলিশ বহু শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করে এবং আটজনকে বিচারের নামে শাস্তি দেয়। তাদের মধ্যে চারজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়, যদিও কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ ছিল না যে তারা বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। এদের অনেকেই ছিলেন সমাজতন্ত্রী, নিপীড়িত মানুষের পক্ষে কণ্ঠস্বর।
এই ভয়াবহ ঘটনার পর সারা বিশ্বে নিন্দার ঝড় উঠে। শ্রমিক আন্দোলন নতুন গতি পায়। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতন্ত্রী কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ১৮৮৬ সালের ১ মে শিকাগো শহরের শ্রমিকদের আত্মত্যাগের স্মরণে এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত করা হবে। সেই থেকে প্রতি বছর ১ মে দিনটি বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা স্মরণ করে পালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে মে দিবস পালনের ইতিহাস তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও, এই অঞ্চলে শ্রমিক আন্দোলনের শিকড় অনেক পুরনো। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা কাজের সময়, মজুরি, নিরাপদ পরিবেশ ইত্যাদি নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের পর শ্রমিকদের সংগঠিত আন্দোলনের ভিত্তি আরও দৃঢ় হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার ১ মে-কে সরকারিভাবে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে এবং দিনটি সরকারি ছুটি হিসেবে নির্ধারণ করে।
বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে গার্মেন্টস খাতের শ্রমিকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে এই খাত থেকে। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক এই খাতে কর্মরত, যার অধিকাংশই নারী। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই বিশাল শ্রমশক্তি আজও শোষণ ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধস এই বাস্তবতার নির্মম প্রমাণ। সেই ঘটনায় সহস্রাধিক শ্রমিক প্রাণ হারান, হাজার হাজার মানুষ পঙ্গু হন। এই ঘটনার পর দেশে-বিদেশে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে আলোচনার ঢেউ উঠে। কিন্তু বাস্তবে আজও অনেক সমস্যার সমাধান হয়নি।
শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য মজুরি, স্বাস্থ্য সেবা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, কাজের পরিবেশের নিরাপত্তা—এসব মৌলিক দাবি অনেকাংশেই অধরাই রয়ে গেছে। এমনকি আজকের প্রযুক্তিনির্ভর যুগে, যেখানে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজের ধরন বদলে যাচ্ছে, সেখানেও শ্রমিকেরা নতুন ধরনের শোষণের মুখোমুখি হচ্ছেন। রাইড-শেয়ারিং, ফুড ডেলিভারি, ফ্রিল্যান্সিং—এসব খাতে কর্মরত মানুষদের ‘শ্রমিক’ হিসেবে স্বীকৃতি নেই, নেই কোনো সামাজিক নিরাপত্তা বা স্থায়ী সুবিধা।
এই বাস্তবতায় মে দিবস আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এটি শুধু ইতিহাস স্মরণের দিন নয়, এটি বর্তমানের চাহিদা ও ভবিষ্যতের পথ নির্ধারণের দিন। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শ্রমিকের অধিকার কোনো করুণার বিষয় নয়, এটি তার প্রাপ্য। একটি সমাজ কতটা মানবিক ও উন্নত—তা নির্ধারিত হয় সেই সমাজ কীভাবে তার শ্রমজীবী মানুষদের মূল্যায়ন করে তার ভিত্তিতে।
মে দিবসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি বিখ্যাত স্লোগান—“আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম, আট ঘণ্টা অবসর।” এই স্লোগান কেবল সময় বণ্টনের নয়, এটি শ্রমিকের ব্যক্তিগত জীবনের মর্যাদার প্রতীক। আজকের দ্রুতগামী সমাজে যখন মানুষ কেবল কাজের যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে, তখন এই স্লোগান আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়।
বাংলাদেশসহ অনেক দেশে এখনও শিশু শ্রম একটি বড় সমস্যা। দরিদ্র পরিবারের শিশুরা স্কুল ফেলে শ্রমবাজারে আসছে জীবিকার তাগিদে। তাদের কাজের পরিবেশ দুর্বিষহ, মজুরি সামান্য, এবং কোনো আইনগত সুরক্ষা নেই। মে দিবস এই ধরনের সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আওয়াজ তোলে।
একটি দেশের উন্নয়ন তখনই অর্থবহ হয়, যখন তার সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সেই উন্নয়নের সুফল ভোগ করে। শুধু দালানকোঠা, রাস্তা বা বড় প্রকল্প গড়ে উন্নত দেশ হওয়া যায় না, যদি শ্রমিকরা অবহেলিত থাকে। তাই মে দিবসে আমাদের উচিত শ্রমজীবী মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং নীতি-নির্ধারকদের কাছ থেকে জবাবদিহিতা চাওয়া—তারা যেন শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে কাজ করেন।
মে দিবস আমাদের শিক্ষা দেয় সংগঠিত হওয়ার গুরুত্ব। শ্রমিকরা যখন একতাবদ্ধ হয়ে কথা বলেন, তখন সমাজে পরিবর্তন আসে। ইতিহাস তার সাক্ষী। আজকের তরুণ প্রজন্মকেও এই বার্তা পৌঁছানো জরুরি—অধিকার নিজে আদায় করে নিতে হয়, আর একতা ও প্রতিবাদ ছাড়া কোনো পরিবর্তন আসে না।
অতএব, ১ মে কেবল একটি দিন নয়, এটি একটি আদর্শ, একটি অনুপ্রেরণা। এটি মনে করিয়ে দেয়, যেকোনো প্রাপ্তির পেছনে সংগ্রাম থাকে। আমরা যদি সত্যিকারের ন্যায্য ও মানবিক সমাজ গড়তে চাই, তাহলে শ্রমিকদের অধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। শ্রদ্ধা, মর্যাদা ও সুবিচারের ভিত্তিতে গড়ে উঠুক এমন একটি সমাজ, যেখানে কেউ অবহেলিত থাকবে না।
সূত্র: বিবিসি