ইতিহাস

ইরাক-ইরান যুদ্ধ: কেন হয়েছিল এই ভয়াবহ সংঘাত?

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ২২: ৪৩

বিশ্ব ইতিহাসে এমন কিছু যুদ্ধ আছে, যেগুলো অনেক দিন ধরে চলে, লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটায়, কিন্তু শেষমেশ কেউ জেতে না। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত চলা ইরাক-ইরান যুদ্ধ তেমনই এক যুদ্ধ, যা আট বছর ধরে দুই মুসলিম দেশের মধ্যে তীব্র রক্তক্ষয়ী সংঘাতে রূপ নেয়। এই যুদ্ধ শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, পুরো বিশ্ব রাজনীতির গতিপথকেই প্রভাবিত করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কেন এই যুদ্ধ হয়েছিল? কী এমন ঘটেছিল, যার কারণে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র এতটা তিক্ততায় জড়িয়ে পড়ল? সহজ ভাষায় বললে, এই যুদ্ধের পেছনে ছিল ধর্মীয় বিভেদ, সীমানা নিয়ে বিরোধ, ক্ষমতার লোভ, রাজনৈতিক বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া এবং আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির চাপ।

সবচেয়ে আগে বোঝা দরকার, ইরান ও ইরাকের মধ্যে সম্পর্ক কখনো খুব সহজ ছিল না। ইরান হচ্ছে শিয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, আর ইরাক তখন সুন্নি মুসলিম শাসিত, যদিও ইরাকের জনগণের একটা বড় অংশ ছিল শিয়া। এই ধর্মীয় বিভক্তি দুই দেশের রাজনৈতিক চিন্তাধারাকেও আলাদা করে দেয়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ঘটে ইসলামি বিপ্লব। শাহ রেজা পাহলভির রাজতন্ত্র পতন হয়, ক্ষমতায় আসেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। এই বিপ্লব শুধু ইরানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার ছিল না। খোমেনি ঘোষণা করেন, তিনি চান সারা মুসলিম বিশ্বে ইসলামি শাসনব্যবস্থা ছড়িয়ে দিতে। এই বার্তা ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেনকে আতঙ্কিত করে তোলে। কারণ ইরাকের শিয়া জনগোষ্ঠীও খোমেনিকে অনুসরণ করতে পারে—এমন আশঙ্কা ছিল তার।

সাদ্দাম হোসেন তখন চাচ্ছিলেন নিজেকে আরব বিশ্বের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। তিনি ভাবেন, সদ্য বিপ্লব-পরবর্তী অস্থির ইরান দুর্বল অবস্থায় আছে, এই সুযোগে আক্রমণ করলে হয়তো ইরানের কিছু এলাকা দখল করে নেওয়া যাবে এবং খোমেনি সরকারের পতন ঘটানো যাবে। বিশেষ করে ইরাকের দৃষ্টি ছিল ‘শাত আল-আরব’ নামের একটি নদীপথের ওপর, যা দুই দেশের সীমান্ত নির্ধারণ করে। এই নদী বন্দর ব্যবহার এবং নদীপথ নিয়ন্ত্রণে অতীতে বহুবার দ্বন্দ্ব হয়েছে। ১৯৭৫ সালে ইরান ও ইরাক ‘আলজিয়ার্স চুক্তি’ স্বাক্ষর করে, যাতে ইরাক কিছুটা পিছু হটে। কিন্তু সাদ্দাম হোসেন ১৯৭৯ সালের পর সেই চুক্তি বাতিল করে আবার নদীটির নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়।

এই পরিস্থিতিতে ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাক ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আক্রমণ চালায়। যুদ্ধ শুরু হয়। সাদ্দামের ধারণা ছিল, এই যুদ্ধ কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। ইরানি জনগণ খোমেনির নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে পড়ে এবং দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যুদ্ধটি আট বছর ধরে চলে, যার মধ্যে ছিল রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার, বেসামরিক মানুষের ওপর বোমাবর্ষণ, ধর্মীয় স্থান ধ্বংস, এবং শিশু-কিশোরদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো।

যুক্তরাজ্যের ‘লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস’-এর ইতিহাসবিদ টোবি ম্যাথিসন এই প্রসঙ্গে বলেন, “এই যুদ্ধ ছিল শুধু ভূখণ্ড দখলের জন্য নয়, এটি ছিল দুটি বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক আদর্শের সংঘর্ষ—একদিকে ছিল ধর্মভিত্তিক বিপ্লবী ইরান, অন্যদিকে ছিল আরব জাতীয়তাবাদী স্বৈরতান্ত্রিক ইরাক।” তিনি আরও বলেন, “এই যুদ্ধ প্রমাণ করে, রাজনৈতিক বিপ্লব যখন প্রতিবেশীদের ওপর প্রভাব ফেলে, তখন তা সরাসরি সংঘাতে পরিণত হতে পারে।”

ইরাক এই যুদ্ধে ব্যবহার করে বহু রাসায়নিক অস্ত্র, যেমন সরিন, স্নায়ু গ্যাস, ও মাস্টার্ড গ্যাস। ইরান বহুবার জাতিসংঘে অভিযোগ জানালেও, তখনকার বিশ্বপরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলো সাদ্দামের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং, কিছু দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি ও সৌদি আরব গোপনে ইরাককে অস্ত্র, প্রযুক্তি এবং অর্থ সহায়তা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগানের প্রশাসন সরাসরি ইরাকের পাশে না দাঁড়ালেও ইরানকে থামানোর জন্য ইরাকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র পরবর্তীতে ‘ইরান-কনট্রা’ কেলেঙ্কারিতে ধরা পড়ে, যেখানে গোপনে ইরানকেও অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছিল। এই জটিল দ্বিচারিতামূলক কূটনীতি যুদ্ধকে আরও দীর্ঘ করে তোলে।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস’-এর গবেষক ক্যারেন এলিয়ট হাউস এক বিশ্লেষণে লেখেন, “ইরাক-ইরান যুদ্ধ ছিল এমন এক সংঘাত, যেখানে বিশ্বশক্তিগুলো নিজের স্বার্থে দুই পক্ষকেই ব্যবহার করেছে। তাদের কারও লক্ষ্য ছিল না শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।”

যুদ্ধের সময় ইরান নানা কৌশল অবলম্বন করে। তারা 'মানব তরঙ্গ' (human wave) পদ্ধতি ব্যবহার করে, যেখানে অল্প প্রশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বিশাল দলে করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হতো। অনেক ক্ষেত্রেই এই তরুণরা হাতে শুধু কোরআন নিয়ে যুদ্ধ করত। এমনকি ১২-১৩ বছরের কিশোররাও মাইনফিল্ডে প্রাণ বিসর্জন দিত। এই দৃশ্য ছিল মানব ইতিহাসের এক নির্মম অধ্যায়।

ইরাকও ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইরান ইরাকের ভেতরে ঢুকে পড়ে, তখন সাদ্দাম হোসেন বাধ্য হয়ে আরও ভয়ংকর প্রতিশোধমূলক হামলা চালান। দুই দেশই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। যুদ্ধ চলাকালীন ইরাকের ওপর ৮০ বিলিয়ন ডলার ঋণের বোঝা পড়ে, যা পরে কুয়েত ও সৌদি আরবের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করে এবং যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯০ সালে কুয়েত আগ্রাসন ঘটে।

যুদ্ধ শেষে ১৯৮৮ সালে জাতিসংঘের ৫৯৮ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি ঘটে। দুই দেশই যুদ্ধ শেষ করতে রাজি হয়। কোনো দেশ বিজয়ী হতে পারেনি, সীমান্তও প্রায় আগের মতোই থেকে যায়। তবু প্রায় ১০ লাখ মানুষ নিহত হন, কয়েক কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হন, হাজার হাজার শিশু এতিম হয়, দুই দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ে।

জার্মানির হামবুর্গ ইউনিভার্সিটির মধ্যপ্রাচ্য গবেষক উলে ভারনার লিখেছেন, “এই যুদ্ধ ইতিহাসের সবচেয়ে অর্থহীন সংঘাতগুলোর একটি, যেখানে দুই দেশই তাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করেছে শুধু ক্ষমতার অহংকার ও ভুল কূটনীতির কারণে।”

এই যুদ্ধ আমাদের শিক্ষা দেয়—ধর্মীয় বিভাজন, রাজনৈতিক বিপ্লব, ক্ষমতার প্রতিযোগিতা এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব যখন একত্রিত হয়, তখন তা কত ভয়ানক বিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে। এই যুদ্ধ শুধু ইরান ও ইরাকের সীমাবদ্ধতায় আটকে ছিল না, বরং এটি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পাল্টে দেওয়ার এক চেষ্টা, যেখানে মানুষ ছিল সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।

আজ এত বছর পরেও এই যুদ্ধের ক্ষত মুছে যায়নি। যুদ্ধোত্তর প্রজন্ম এখনও বয়ে বেড়ায় সেই ভয়াবহতার স্মৃতি। আর বিশ্বের জন্য এটি রয়ে গেছে এক ভয়ঙ্কর উদাহরণ হিসেবে—যেখানে কেউ জেতেনি, কেবল মানুষ হেরেছে।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

আমি বেঁচে আছি এবং শহীদ হতে প্রস্তুত: খামেনির উপদেষ্টা

তেহরানে চালানো এক হামলায় ইরানের ‘খাতাম আল-আনবিয়া সেন্ট্রাল হেডকোয়ার্টার্স’-এর প্রধান আলি শাদমানিকে হত্যা করেছে বলে জানিয়েছিল ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। তবে এ দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে এক বার্তায় শামখানি বলেছেন, ‘আমি বেঁচে আছি এবং শহীদ হতে প্রস্তুত।’

১১ ঘণ্টা আগে

ইরান একা নয়, পাশে থাকবে উত্তর কোরিয়া: কিম জং-উন

মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ইরানের প্রতি একান্ত সমর্থন জানিয়েছে উত্তর কোরিয়া। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা কিম জং-উন স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “এই সংঘাতে তেহরান একা নয়।”

১৩ ঘণ্টা আগে

ইরানে সরকার পরিবর্তনের চিন্তা অকল্পনীয়, খামেনিকে হত্যা ‘প্যান্ডোরার বক্স’ : রাশিয়া

ইরানে সরকার পরিবর্তন বা দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যা—এই ধরনের কোনো পরিকল্পনা রাশিয়ার দৃষ্টিতে ‘অকল্পনীয় ও অগ্রহণযোগ্য’। এমনটি ঘটলে তা গোটা অঞ্চলে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে মস্কো।

১৩ ঘণ্টা আগে

ইরানের হামলার আশঙ্কা: যুদ্ধবিমান-রণতরী সরিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কায় ওই অঞ্চলের ঘাঁটি থেকে যুদ্ধবিমান ও রণতরী সরিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও ব্লুমবার্গ।

১৩ ঘণ্টা আগে