গল্প
বৃষ্টির কান্না

রাতের শেষ প্রহর। জানালার কাঁচে টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ। একটানা এই বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঋতুর ঘুম ভাঙে। পাশ ফিরে তাকায়। রিমন বিছানায় নেই।
ঘরের কোণায় রাখা ছোট্ট স্টুডিওর দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো, ক্যানভাসের সামনে বসে আছে রিমন। হাতে তুলি, চোখ দুটো ক্যানভাসের গায়ে স্থির। ঘুমহীন, ক্লান্ত মুখে এক ধরনের অস্পষ্ট তৃপ্তি খেলা করছে।
ঋতু ধীরে ধীরে উঠে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
"ঘুমাওনি এখনো?" কণ্ঠে হালকা অভিমান।
রিমন কাঁধ উঁচিয়ে বলল, "এই মুহূর্তটা হারাতে ইচ্ছা করে না। ক্যানভাসের উপর বৃষ্টির রং ঠিক ধরতে পারছি। বৃষ্টি যেন আজ আমার জন্যই এসেছে।"
ঋতু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার এই মানুষটাকে বিয়ে করেছিল ভালোবাসা থেকে, কিন্তু এখন মনে হয়, এই ভালোবাসাই বুঝি তার সবচেয়ে বড় ভুল।
বছর দুয়েক আগে।
এক আকাশ রোদেলা দিনে তাদের প্রথম দেখা। ঋতু তখন সদ্য কলেজে চাকরি পেয়েছে। এক বন্ধু তার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল রিমনের সাথে, ছবি আঁকার কাজের জন্য। পরিচয়ের সেই প্রথম দিনেই ঋতু টের পেয়েছিল এই ছেলেটার মধ্যে একটা অদ্ভুত মুগ্ধতার ছায়া আছে।
রিমন, একজন উদাসীন শিল্পী। সংসারের হিসাবের খাতা কখনোই তার ভালো লাগেনি। জীবনকে সে নিজের মতো করে দেখত, ঠিক যেমন ক্যানভাসের রঙে রঙে জীবনের ছায়া আঁকে।
ঋতু, বরং বাস্তববাদী। পড়াশোনায় ভালো, ক্যারিয়ার সচেতন। দুই ভিন্ন ধরনের মানসিকতার মানুষের মিলন ছিল কিছুটা অসময়ের ভালোবাসা। কিন্তু প্রেম তো যুক্তি মানে না।
বিয়ের পরের জীবনটা খুব দ্রুতই রং বদলাতে শুরু করলো। রিমনের কাজ নেই বললেই চলে। কখনো কোনো ক্লায়েন্টের জন্য পেইন্টিং, আর নয়তো নিজের ইচ্ছেমতো একাকী স্টুডিওতে বসে থাকা।
ঋতু চাকরি করত, সংসারের সব খরচ চলত তার আয়েই। প্রথমদিকে খুব একটা গায়ে লাগেনি, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে।
আজও সকালটা একইভাবে শুরু হয়েছিল।
"রিমন, আজ একটু বাসার বাজার সদাই করে আনবে তো? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।"
রিমন বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে বলেছিল, "আজই আনবো। তুমি যাও।"
ঋতু দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়েছিল কিছু না বলেই।
সন্ধ্যা। বৃষ্টি তখনো ঝরছে। অফিস থেকে ফিরে ঋতু দরজা খুলেই দেখে টেবিলে রাখা চিরকুট:
"আজ বৃষ্টির রং খুঁজতে বের হয়েছি। রাতের খাবার ফ্রিজে। ভালো থেকো।"
ঋতুর চোখ ভিজে উঠলো। একদিকে ক্লান্তি, অন্যদিকে অভিমান। তার ভালোবাসা কি কেবলই একপাক্ষিক ছিল?
রাত বাড়ে। দরজা খুলে রিমন ঢোকে, ভেজা ছাতা হাতে। চুপচাপ এসে বসে। কিছু বলে না।
ঋতু পানি এগিয়ে দেয়।
"আজ কেমন ছবি আঁকলে?"
রিমন কণ্ঠে বিষণ্ণতা নিয়ে বলল, "তোমার হাসিটা আঁকতে চেয়েছিলাম। পারিনি। তোমার মুখের সেই পুরোনো হাসিটা আর দেখতে পাই না।"
ঋতু কিছু বলল না। শুধু জানালার বাইরে তাকিয়ে রইলো। বৃষ্টি যেন থেমে গিয়েছে। কিন্তু তার মনের ভেতরে বৃষ্টি তখনো ঝরছে।
দিন যায়, রাত যায়। সম্পর্কের মাঝে দূরত্ব বাড়তে থাকে। একদিন হঠাৎ রিমন বলল:
"ঋতু, আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারিনি। চাইলে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারো।"
ঋতু তাকিয়ে ছিল তার দিকে। চোখে কোনো অভিযোগ ছিল না। কেবল দীর্ঘ নীরবতা।
সেই রাতে ফের বৃষ্টি নামে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ঋতু মনে মনে বলে:
"জীবনের সব অপেক্ষার শেষ আছে। কিন্তু ভালোবাসার কী শেষ আছে?"
রিমন পেছন থেকে এসে বলে:
"তুমি চাইলে আমি বদলাবো। সত্যি বলছি। এই শিল্পী জীবন ছাড়তেও রাজি আছি।"
ঋতুর কণ্ঠ শান্ত, কিন্তু দৃঢ়।
"বদলে যাওয়ার জন্য ভালোবাসা দরকার হয় না, দরকার ইচ্ছা। আমি সেই ইচ্ছা দেখতে চাই।"
রিমন বদলায়। আর্ট গ্যালারিতে কাজ নেয়। নিয়মিত বেতন পেতে শুরু করে। একসাথে জীবন গড়ার স্বপ্ন আবার একটু একটু করে নতুন করে বুনে যেতে থাকে তারা।
একদিন বিকেলে, বৃষ্টি নামে আবার। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ঋতু আর রিমন। দু'জনের মুখেই হালকা হাসি।
রিমন ধীরে ধীরে বলে,
"তোমার এই চোখের বৃষ্টিটাই আমাকে বদলে দিয়েছে। আমি সত্যিই ভাগ্যবান, তুমি আজও আমার পাশে আছো।"
ঋতু বলে,
"বৃষ্টি কখনো ফুরায় না, তবে রোদও আসে। সম্পর্কও ঠিক তেমন। একদিন এই গল্প আমরা অন্য কারো সামনে বলবো। হয়তো আমাদের সন্তানের সামনে।"
বৃষ্টির শব্দ, দু'জনের নিঃশব্দ হাসি। বাইরে বর্ষা, ভেতরে এক নতুন সকাল।