অরুণাভ বিশ্বাস
ইয়েমেনের উত্তরে পাহাড়-পর্বতে জন্ম নেওয়া হুতি বিদ্রোহীরা আজ শুধু একটি আঞ্চলিক গোষ্ঠী নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তিতে পরিণত হয়েছে। যাদের কেউ দেখে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, কেউ বলে সন্ত্রাসী, আবার কেউ বলে ইরানের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু হুতি আন্দোলনের শুরুটা ছিল একেবারে ভিন্ন—ধর্মীয় অধিকার, সামাজিক বঞ্চনা এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের দাবি থেকেই তাদের পথচলা। সময়ের পরিক্রমায় তারা হয়ে উঠেছে ইয়েমেনের এক নিয়ন্ত্রক শক্তি, যা আজ সৌদি আরব, আমেরিকা এমনকি ইসরায়েলের জন্যও বড় মাথাব্যথার কারণ।
হুতি আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয় ১৯৯০-এর দশকে। এই আন্দোলনের মূল প্রণেতা ছিলেন বদরুদ্দিন আল-হুতি নামের এক ধর্মীয় নেতা, যিনি ইয়েমেনের জাইদি শিয়া সম্প্রদায়ের আলেম ছিলেন। ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলের সা’দা প্রদেশে বসবাসকারী জাইদি সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে সরকারের হাতে অবহেলার শিকার হয়ে আসছিল। তারা অভিযোগ করত যে, কেন্দ্রীয় সরকার সুন্নি মতাবলম্বী এবং সৌদি প্রভাবিত সালাফি মতবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, অথচ তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এই সামাজিক ও ধর্মীয় চাপ থেকেই ১৯৯২ সালে ‘আন্সারুল্লাহ’ নামে একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় “আল্লাহর সাহায্যকারীরা।” এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন বদরুদ্দিনের ছেলে হুসেইন বদরুদ্দিন আল-হুতি, যিনি মিশরে এবং ইরানে পড়াশোনা করে ফিরেছিলেন এক বলিষ্ঠ মতাদর্শ নিয়ে। তিনি শুধু ধর্মীয় নেতা ছিলেন না, ছিলেন একজন তুখোড় বক্তা ও সংগঠকও। তার ভাষণগুলোতে ছিল সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমেরিকার নীতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্রোধ।
২০০৪ সালে হুসেইন আল-হুতি ‘মৃত্যু আমেরিকার জন্য, মৃত্যু ইসরায়েলের জন্য’—এই স্লোগানে একটি বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করেন। সরকার তাকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করে, এবং সেই সময় তিনি সা’দার পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে সামরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এই প্রতিরোধ দমন করতে গিয়ে ইয়েমেন সরকার এক ভয়াবহ অভিযান চালায় এবং ওই বছরের সেপ্টেম্বরে হুসেইন নিহত হন। তবে এখানেই হুতি আন্দোলনের শেষ হয়নি—বরং এখান থেকেই শুরু হয় তার নতুন রূপান্তর।
নেতৃত্বে আসেন হুসেইনের ছোট ভাই আব্দুল মালিক আল-হুতি। তিনি একজন বেশি চুপচাপ, গম্ভীর এবং রাজনৈতিক কৌশলে অভ্যস্ত নেতা হিসেবে পরিচিত। তার হাত ধরে হুতি আন্দোলন একটি আদর্শিক বিদ্রোহ থেকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত হতে থাকে। ২০০৪ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ইয়েমেন সরকার ও হুতি যোদ্ধাদের মধ্যে ছয়বার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয় এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
এই সময়েই হুতিদের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তেহরান শুরুতে এই সম্পর্ক অস্বীকার করলেও পরে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা দেখতে পান যে, হুতিরা ইরানি অস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং অর্থ পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘Institute for the Study of War’-এর গবেষক ক্যাথরিন জিমারম্যান ২০১৭ সালের একটি প্রতিবেদনে লেখেন, “হুতিদের আন্দোলনকে একটি স্থানীয় গোষ্ঠী সংঘর্ষ হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। এটি এখন ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
২০১১ সালে ইয়েমেনে শুরু হয় আরব বসন্তের ঢেউ। জনগণের গণআন্দোলনে প্রেসিডেন্ট আলি আব্দুল্লাহ সালেহকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এই সময় হুতিরা নিজেদের পুনর্গঠিত করে এবং রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নেয়। ২০১৪ সালে তারা হঠাৎ করে উত্তর ইয়েমেন থেকে রওনা হয়ে রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। পুরো দেশ হতবাক হয়ে যায়—একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যাদের একসময় শুধুই সা’দার পাহাড়ে দেখা যেত, তারা কিভাবে রাজধানী দখল করে ফেলল?
এর পেছনে ছিল কৌশল এবং চুক্তির রাজনীতি। সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহ, যিনি হুতিদের একসময় দমন করেছিলেন, তিনিই আবার রাজনৈতিক স্বার্থে হুতিদের সঙ্গে জোট বাঁধেন। এই অদ্ভুত জোটের ফলে হুতিরা সেনাবাহিনীর একাংশের সমর্থন পায় এবং সরকার পতনের পথ সহজ হয়। এরপর হুতিরা প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদিকে গৃহবন্দি করে এবং কার্যত ইয়েমেনের অধিকাংশ অংশের শাসনভার গ্রহণ করে।
এই ঘটনা সৌদি আরব এবং আমেরিকার জন্য এক ভয়ানক সংকেত হয়ে ওঠে। কারণ, তারা হুতিদের ইরানের মদদপুষ্ট শক্তি হিসেবে দেখে। ২০১৫ সালে সৌদি আরব ৯টি আরব দেশের সমন্বয়ে একটি সামরিক জোট গঠন করে এবং ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স এই জোটকে অস্ত্র ও গোয়েন্দা সহায়তা দিতে থাকে।
যুদ্ধ শুরু হয়, কিন্তু হুতিরা ভেঙে পড়ে না। বরং তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা আরও জোরদার করে তোলে এবং ইরান থেকে উন্নত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র পেতে শুরু করে। তারা সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে সক্ষম হয়, যা পুরো উপসাগরীয় অঞ্চলে সন্ত্রস্ত পরিস্থিতি তৈরি করে।
২০১৯ সালে হুতিরা সৌদি তেল স্থাপনা ‘আরামকো’-তে ভয়াবহ হামলা চালায়, যার ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়। এই হামলার দায় হুতিরা স্বীকার করলেও যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, এটি ইরান থেকে পরিচালিত। ফলে ইয়েমেন যুদ্ধ হয়ে ওঠে ইরান-সৌদি আরব সংঘর্ষের এক প্রক্সি যুদ্ধ।
অন্যদিকে, হুতিরা শুধু সামরিক নয়, ধর্মীয়-রাজনৈতিক ভাবনাতেও নিজেদের শক্তিশালী করেছে। তারা শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় ভাবধারা ঢোকায়, নিজেদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে আদালত ও প্রশাসন গড়ে তোলে এবং পশ্চিমা প্রভাবকে “অসভ্য সংস্কৃতি” হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের শ্লোগান আজও অপরিবর্তিত—“আল্লাহু আকবর, মৃত্যু আমেরিকার জন্য, মৃত্যু ইসরায়েলের জন্য, অভিশাপ ইহুদিদের জন্য, ইসলাম বিজয়ী হোক।”
তবে এই চরমপন্থা নিয়ে বহু প্রশ্নও উঠেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ এবং ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ হুতিদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। তারা অভিযোগ করে যে, হুতিরা স্কুলে শিশুদের সৈনিক বানাচ্ছে, ভিন্নমত দমন করছে এবং গণতন্ত্রের পথে বাধা সৃষ্টি করছে।
বিশ্বখ্যাত মধ্যপ্রাচ্য গবেষক ফাওয়াজ জর্জেস (London School of Economics) ২০২১ সালে বলেন, “হুতি আন্দোলন মূলত বঞ্চনার ফল হলেও, এখন এটি একটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে রূপ নিচ্ছে, যা ইয়েমেনের জন্য ভবিষ্যতে আরও বিভাজনের কারণ হতে পারে।”
২০২৩ সালের পর থেকে হুতিরা শুধু ইয়েমেনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শুরু হলে তারা লোহিত সাগরে ইসরায়েলমুখী জাহাজে হামলা শুরু করে। তারা ঘোষণা দেয়, “ফিলিস্তিনি ভাইদের সহায়তায় আমরা প্রস্তুত।” এর ফলে আমেরিকা ও ব্রিটেন যৌথভাবে হুতিদের বিরুদ্ধে আবার বিমান হামলা শুরু করে।
আজকের দিনে এসে হুতি বিদ্রোহীরা একটি সাংবিধানিক আন্দোলন না, বরং একটি কার্যত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যার রয়েছে নিজস্ব বাহিনী, প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক এজেন্ডা। কেউ বলবে তারা ইরানের হাতিয়ার, কেউ বলবে তারা নির্যাতিত জনগণের কণ্ঠস্বর, কেউ বলবে এক ভয়ঙ্কর মিলিট্যান্ট গোষ্ঠী। কিন্তু বাস্তবতা হলো—হুতি আন্দোলনের পেছনে রয়েছে বহু বছর ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, উপেক্ষা এবং জাতিগত, ধর্মীয়, সামাজিক অসমতা।
এই অসমতা দূর না হলে শুধু হুতি নয়, আরও অনেক আন্দোলন এই অঞ্চলে জন্ম নেবে। হুতিরা হয়তো আজ অস্ত্রধারী এক শক্তি, কিন্তু তাদের জন্ম যে নিছক গুলি থেকে নয়—তা ইতিহাস মনে রাখবে।
ইয়েমেনের উত্তরে পাহাড়-পর্বতে জন্ম নেওয়া হুতি বিদ্রোহীরা আজ শুধু একটি আঞ্চলিক গোষ্ঠী নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শক্তিতে পরিণত হয়েছে। যাদের কেউ দেখে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, কেউ বলে সন্ত্রাসী, আবার কেউ বলে ইরানের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু হুতি আন্দোলনের শুরুটা ছিল একেবারে ভিন্ন—ধর্মীয় অধিকার, সামাজিক বঞ্চনা এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের দাবি থেকেই তাদের পথচলা। সময়ের পরিক্রমায় তারা হয়ে উঠেছে ইয়েমেনের এক নিয়ন্ত্রক শক্তি, যা আজ সৌদি আরব, আমেরিকা এমনকি ইসরায়েলের জন্যও বড় মাথাব্যথার কারণ।
হুতি আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয় ১৯৯০-এর দশকে। এই আন্দোলনের মূল প্রণেতা ছিলেন বদরুদ্দিন আল-হুতি নামের এক ধর্মীয় নেতা, যিনি ইয়েমেনের জাইদি শিয়া সম্প্রদায়ের আলেম ছিলেন। ইয়েমেনের উত্তরাঞ্চলের সা’দা প্রদেশে বসবাসকারী জাইদি সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে সরকারের হাতে অবহেলার শিকার হয়ে আসছিল। তারা অভিযোগ করত যে, কেন্দ্রীয় সরকার সুন্নি মতাবলম্বী এবং সৌদি প্রভাবিত সালাফি মতবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, অথচ তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এই সামাজিক ও ধর্মীয় চাপ থেকেই ১৯৯২ সালে ‘আন্সারুল্লাহ’ নামে একটি আন্দোলন গড়ে ওঠে, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় “আল্লাহর সাহায্যকারীরা।” এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন বদরুদ্দিনের ছেলে হুসেইন বদরুদ্দিন আল-হুতি, যিনি মিশরে এবং ইরানে পড়াশোনা করে ফিরেছিলেন এক বলিষ্ঠ মতাদর্শ নিয়ে। তিনি শুধু ধর্মীয় নেতা ছিলেন না, ছিলেন একজন তুখোড় বক্তা ও সংগঠকও। তার ভাষণগুলোতে ছিল সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমেরিকার নীতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্রোধ।
২০০৪ সালে হুসেইন আল-হুতি ‘মৃত্যু আমেরিকার জন্য, মৃত্যু ইসরায়েলের জন্য’—এই স্লোগানে একটি বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করেন। সরকার তাকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করে, এবং সেই সময় তিনি সা’দার পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে সামরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এই প্রতিরোধ দমন করতে গিয়ে ইয়েমেন সরকার এক ভয়াবহ অভিযান চালায় এবং ওই বছরের সেপ্টেম্বরে হুসেইন নিহত হন। তবে এখানেই হুতি আন্দোলনের শেষ হয়নি—বরং এখান থেকেই শুরু হয় তার নতুন রূপান্তর।
নেতৃত্বে আসেন হুসেইনের ছোট ভাই আব্দুল মালিক আল-হুতি। তিনি একজন বেশি চুপচাপ, গম্ভীর এবং রাজনৈতিক কৌশলে অভ্যস্ত নেতা হিসেবে পরিচিত। তার হাত ধরে হুতি আন্দোলন একটি আদর্শিক বিদ্রোহ থেকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত হতে থাকে। ২০০৪ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ইয়েমেন সরকার ও হুতি যোদ্ধাদের মধ্যে ছয়বার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয় এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
এই সময়েই হুতিদের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তেহরান শুরুতে এই সম্পর্ক অস্বীকার করলেও পরে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা দেখতে পান যে, হুতিরা ইরানি অস্ত্র, প্রশিক্ষণ এবং অর্থ পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘Institute for the Study of War’-এর গবেষক ক্যাথরিন জিমারম্যান ২০১৭ সালের একটি প্রতিবেদনে লেখেন, “হুতিদের আন্দোলনকে একটি স্থানীয় গোষ্ঠী সংঘর্ষ হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। এটি এখন ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
২০১১ সালে ইয়েমেনে শুরু হয় আরব বসন্তের ঢেউ। জনগণের গণআন্দোলনে প্রেসিডেন্ট আলি আব্দুল্লাহ সালেহকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এই সময় হুতিরা নিজেদের পুনর্গঠিত করে এবং রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নেয়। ২০১৪ সালে তারা হঠাৎ করে উত্তর ইয়েমেন থেকে রওনা হয়ে রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। পুরো দেশ হতবাক হয়ে যায়—একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যাদের একসময় শুধুই সা’দার পাহাড়ে দেখা যেত, তারা কিভাবে রাজধানী দখল করে ফেলল?
এর পেছনে ছিল কৌশল এবং চুক্তির রাজনীতি। সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহ, যিনি হুতিদের একসময় দমন করেছিলেন, তিনিই আবার রাজনৈতিক স্বার্থে হুতিদের সঙ্গে জোট বাঁধেন। এই অদ্ভুত জোটের ফলে হুতিরা সেনাবাহিনীর একাংশের সমর্থন পায় এবং সরকার পতনের পথ সহজ হয়। এরপর হুতিরা প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদিকে গৃহবন্দি করে এবং কার্যত ইয়েমেনের অধিকাংশ অংশের শাসনভার গ্রহণ করে।
এই ঘটনা সৌদি আরব এবং আমেরিকার জন্য এক ভয়ানক সংকেত হয়ে ওঠে। কারণ, তারা হুতিদের ইরানের মদদপুষ্ট শক্তি হিসেবে দেখে। ২০১৫ সালে সৌদি আরব ৯টি আরব দেশের সমন্বয়ে একটি সামরিক জোট গঠন করে এবং ইয়েমেনে হুতিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স এই জোটকে অস্ত্র ও গোয়েন্দা সহায়তা দিতে থাকে।
যুদ্ধ শুরু হয়, কিন্তু হুতিরা ভেঙে পড়ে না। বরং তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা আরও জোরদার করে তোলে এবং ইরান থেকে উন্নত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র পেতে শুরু করে। তারা সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়তে সক্ষম হয়, যা পুরো উপসাগরীয় অঞ্চলে সন্ত্রস্ত পরিস্থিতি তৈরি করে।
২০১৯ সালে হুতিরা সৌদি তেল স্থাপনা ‘আরামকো’-তে ভয়াবহ হামলা চালায়, যার ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়। এই হামলার দায় হুতিরা স্বীকার করলেও যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, এটি ইরান থেকে পরিচালিত। ফলে ইয়েমেন যুদ্ধ হয়ে ওঠে ইরান-সৌদি আরব সংঘর্ষের এক প্রক্সি যুদ্ধ।
অন্যদিকে, হুতিরা শুধু সামরিক নয়, ধর্মীয়-রাজনৈতিক ভাবনাতেও নিজেদের শক্তিশালী করেছে। তারা শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় ভাবধারা ঢোকায়, নিজেদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে আদালত ও প্রশাসন গড়ে তোলে এবং পশ্চিমা প্রভাবকে “অসভ্য সংস্কৃতি” হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের শ্লোগান আজও অপরিবর্তিত—“আল্লাহু আকবর, মৃত্যু আমেরিকার জন্য, মৃত্যু ইসরায়েলের জন্য, অভিশাপ ইহুদিদের জন্য, ইসলাম বিজয়ী হোক।”
তবে এই চরমপন্থা নিয়ে বহু প্রশ্নও উঠেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ এবং ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ হুতিদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। তারা অভিযোগ করে যে, হুতিরা স্কুলে শিশুদের সৈনিক বানাচ্ছে, ভিন্নমত দমন করছে এবং গণতন্ত্রের পথে বাধা সৃষ্টি করছে।
বিশ্বখ্যাত মধ্যপ্রাচ্য গবেষক ফাওয়াজ জর্জেস (London School of Economics) ২০২১ সালে বলেন, “হুতি আন্দোলন মূলত বঞ্চনার ফল হলেও, এখন এটি একটি ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে রূপ নিচ্ছে, যা ইয়েমেনের জন্য ভবিষ্যতে আরও বিভাজনের কারণ হতে পারে।”
২০২৩ সালের পর থেকে হুতিরা শুধু ইয়েমেনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ শুরু হলে তারা লোহিত সাগরে ইসরায়েলমুখী জাহাজে হামলা শুরু করে। তারা ঘোষণা দেয়, “ফিলিস্তিনি ভাইদের সহায়তায় আমরা প্রস্তুত।” এর ফলে আমেরিকা ও ব্রিটেন যৌথভাবে হুতিদের বিরুদ্ধে আবার বিমান হামলা শুরু করে।
আজকের দিনে এসে হুতি বিদ্রোহীরা একটি সাংবিধানিক আন্দোলন না, বরং একটি কার্যত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যার রয়েছে নিজস্ব বাহিনী, প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক এজেন্ডা। কেউ বলবে তারা ইরানের হাতিয়ার, কেউ বলবে তারা নির্যাতিত জনগণের কণ্ঠস্বর, কেউ বলবে এক ভয়ঙ্কর মিলিট্যান্ট গোষ্ঠী। কিন্তু বাস্তবতা হলো—হুতি আন্দোলনের পেছনে রয়েছে বহু বছর ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, উপেক্ষা এবং জাতিগত, ধর্মীয়, সামাজিক অসমতা।
এই অসমতা দূর না হলে শুধু হুতি নয়, আরও অনেক আন্দোলন এই অঞ্চলে জন্ম নেবে। হুতিরা হয়তো আজ অস্ত্রধারী এক শক্তি, কিন্তু তাদের জন্ম যে নিছক গুলি থেকে নয়—তা ইতিহাস মনে রাখবে।
ট্রাম্প বলেন, ‘আমি মনে করি তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করাটা একেবারেই হাস্যকর। যুক্তরাষ্ট্রে দুই দলের যে রাজনৈতিক কাঠামো, তা বহু বছর ধরেই আছে। তৃতীয় কোনো দল এখানে আনার চেষ্টা শুধু বিভ্রান্তি তৈরি করবে। তিনি (মাস্ক) চাইলে মজা করতে পারেন। তবে আমার মনে হয় এটি হাস্যকর।’
৮ ঘণ্টা আগেযুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান— এই দুই দলের বৃত্তে আবর্তিত হচ্ছে। তবে মাস্ক বলছেন, বাস্তবে এই দুই দল একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। ‘তারা ভিন্ন পোশাক পরে একসঙ্গে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে— এটাই ইউনিপার্টি,’— বলেন মাস্ক।
৯ ঘণ্টা আগেইয়েমেনের তিনটি বন্দর ও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে হুতিদের অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে দেশটির প্রধান বিদ্যুৎকেন্দ্র অচল হয়ে পড়েছে।
১১ ঘণ্টা আগেযুদ্ধের আগে হামাসের যে শক্তি ছিল তারা ফের সেই জায়গায় ফিরে গেছে বলে জানিয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত ইসরায়েলি মেজর জেনারেল ইয়েজহাক ব্রিক। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) দাবি করছে, হামাসকে তারা প্রায় নির্মূল করেছে। তবে আইডিএফের দাবির উল্টোটা বললেন এই জেনারেল।
১ দিন আগে