রাজনীতি

বিশ্বমঞ্চে ব্রিকসের আবির্ভাব হয় যেভাবে

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৫, ১৭: ২১

বিশ্ব রাজনীতির ও অর্থনীতির মঞ্চে এককালের প্রাধান্য ছিল পশ্চিমা ধনসম্পন্ন রাষ্ট্রগুলোর। বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো গোষ্ঠীগুলোর অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রশ্নাতীত ছিল। কিন্তু ২১ শতকের শুরুতে এই প্রথাগত বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। উদীয়মান অর্থনীতির কয়েকটি শক্তিধর দেশ নিজেদের স্বার্থ ও উন্নয়নের উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়ে গড়ে তোলে একটি নতুন জোট—ব্রিকস (BRICS)। ব্রিকস জোটের পেছনে যে ইতিহাস, লক্ষ্য ও দর্শন রয়েছে, তা শুধুমাত্র অর্থনীতির নয়—এটি একধরনের ভূরাজনৈতিক বার্তাও বহন করে। এই ফিচারে আমরা সহজ ভাষায় জানব ব্রিকসের গঠনের ইতিহাস, এর উদ্দেশ্য এবং বিশ্বের গবেষকরা কী বলছেন এই জোট নিয়ে।

ব্রিকস শব্দটি মূলত পাঁচটি দেশের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে তৈরি—ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না এবং সাউথ আফ্রিকা। শুরুতে এটি ছিল শুধু "BRIC"—যেখানে দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল না। এই ধারণার সূত্রপাত ঘটে ২০০১ সালে, ব্রিটিশ বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাক্স-এর একজন প্রধান অর্থনীতিবিদ জিম ও'নীল-এর একটি গবেষণায়। তিনি বলেন, “ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া এবং চায়নার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সম্ভাবনা এতটাই বিশাল যে, এরা অদূর ভবিষ্যতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।” জিম ও’নীল-এর এই ধারণাই একপ্রকার ‘ব্রিক’ শব্দটির জনক।

তবে এই ধারণা গবেষণাগারে থেমে থাকেনি। ২০০৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাইডলাইনে ব্রিক দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একত্রিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্কের সূচনা করেন। এরপর ২০০৯ সালে রাশিয়ার একাতেরিনবুর্গ শহরে প্রথমবারের মতো ব্রিক দেশের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে যুক্ত করা হলে এটি “ব্রিকস” (BRICS) নামে পরিচিত হয়। তখন থেকেই এই জোট একটি প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোতে রূপ নেয় এবং প্রতি বছর নিয়মিত সম্মেলন শুরু করে।

ব্রিকসের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে একটি বহুপাক্ষিক, ন্যায্য ও ভারসাম্যপূর্ণ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে কাজ করা। সদস্য দেশগুলোর বিশ্বাস, পশ্চিমা বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকল্প প্রয়োজন, যেখানে উন্নয়নশীল দেশের কণ্ঠস্বর বেশি গুরুত্ব পাবে। এই উদ্দেশ্যে ২০১৪ সালে ব্রিকস নিজস্ব একটি উন্নয়ন ব্যাংক গঠন করে, যার নাম—“নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক” (এনডিবি)। এই ব্যাংক উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে অর্থায়নের কাজ করে।

চীন এই জোটে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ। অনেক বিশ্লেষকের মতে, ব্রিকসের মাধ্যমে চীন তার ভূরাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে চায়। কিন্তু ব্রাজিল ও ভারত বরাবরই একটি ভারসাম্যপূর্ণ নেতৃত্বের পক্ষে, যাতে চীনের আধিপত্য না হয়। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়লে ব্রিকস তার কাছে একধরনের বিকল্প প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে। দক্ষিণ আফ্রিকা আফ্রিকা মহাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে এই জোটে, যা ব্রিকসকে এক বৈশ্বিক মাত্রা দিয়েছে।

এই জোটের মূল আকর্ষণ শুধু সদস্য রাষ্ট্রগুলোই নয়, বরং যারা এর সঙ্গে যুক্ত হতে চায় তারাও। ২০২৩ সালে ব্রিকস ঘোষণা দেয়, নতুন সদস্যপদ উন্মুক্ত করা হবে। এরপর ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর ও ইথিওপিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। গবেষকরা বলছেন, এ এক বিরাট পদক্ষেপ, কারণ এটি ব্রিকসকে আরও শক্তিশালী ও বহুমাত্রিক বানাবে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. কার্লোস লরেন্স বলেন, “ব্রিকসের সম্ভাবনা বিশাল, তবে অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থের সংঘর্ষ এটির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।” তিনি আরও বলেন, “চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত দ্বন্দ্ব, কিংবা রাশিয়া ও ব্রাজিলের কূটনৈতিক অবস্থান ব্রিকসের একক কণ্ঠস্বর গঠনে বাধা হতে পারে।” এই কথা সত্য যে, একমতে আসা সবসময় সহজ নয়, কিন্তু এত ভিন্নমতের দেশ এক প্ল্যাটফর্মে থেকে আলোচনার মাধ্যমে পথ খুঁজে নেয়া নিজেই এক বড় অর্জন।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সুজান মেয়ার মন্তব্য করেন, “ব্রিকস একধরনের প্রতীকী জোটও—এটি দেখায়, বিশ্ব রাজনীতিতে শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তনশীল এবং পশ্চিমা আধিপত্যের বাইরেও বিশ্ব আছে।”

ব্রিকসের সামনে এখন একাধিক লক্ষ্য রয়েছে—নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য, ডলার নির্ভরতা কমানো, প্রযুক্তি বিনিময়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যৌথ উদ্যোগ, এবং সর্বোপরি এক নতুন বিশ্বব্যবস্থার দাবিদার হয়ে ওঠা। যদিও এসব উদ্দেশ্য পূরণের জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে, তবে এই জোট ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যবস্থার গতিপথে একটি বিকল্প কণ্ঠস্বর তৈরি করতে পেরেছে।

সর্বশেষ, এই কথাটাই বলা যায়—ব্রিকস শুধু একটি অর্থনৈতিক জোট নয়, এটি একটি ভাবনার প্ল্যাটফর্ম। যেখানে উন্নয়নশীল বিশ্ব নিজেদের প্রয়োজন ও স্বপ্নের কথা বলে। পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত এক ন্যায্য, টেকসই ও বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ব্রিকস এক সাহসী পদক্ষেপ, যার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এর সদস্যদের সংহতি ও কৌশলগত দূরদর্শিতার ওপর।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

যেভাবে শুরু ইয়েমেন-ইসরায়েল সংকটের

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই আরব দেশগুলোর মধ্যে এই রাষ্ট্রের প্রতি একধরনের ঐক্যবদ্ধ বিরোধিতা তৈরি হয়।

১৩ ঘণ্টা আগে

মাস্কের আমেরিকা পার্টি নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য— আমার মনে হয় হাস্যকর

ট্রাম্প বলেন, ‘আমি মনে করি তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করাটা একেবারেই হাস্যকর। যুক্তরাষ্ট্রে দুই দলের যে রাজনৈতিক কাঠামো, তা বহু বছর ধরেই আছে। তৃতীয় কোনো দল এখানে আনার চেষ্টা শুধু বিভ্রান্তি তৈরি করবে। তিনি (মাস্ক) চাইলে মজা করতে পারেন। তবে আমার মনে হয় এটি হাস্যকর।’

১৩ ঘণ্টা আগে

ট্রাম্পকে টেক্কা দিতে পারবেন মাস্ক?

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান— এই দুই দলের বৃত্তে আবর্তিত হচ্ছে। তবে মাস্ক বলছেন, বাস্তবে এই দুই দল একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। ‘তারা ভিন্ন পোশাক পরে একসঙ্গে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে— এটাই ইউনিপার্টি,’— বলেন মাস্ক।

১৪ ঘণ্টা আগে

ইয়েমেনের বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইসরায়েলের হামলা

ইয়েমেনের তিনটি বন্দর ও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে হুতিদের অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে দেশটির প্রধান বিদ্যুৎকেন্দ্র অচল হয়ে পড়েছে।

১৬ ঘণ্টা আগে