ভূরাজনীতি

হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে এতটা সফল কীভাবে

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৫, ১৯: ৩১

লোহিত সাগরের গাঢ় নীল জলরেখায় এখন যেন অদৃশ্য এক আতঙ্কের ঢেউ। দিনের আলো হোক কিংবা রাতের নিস্তব্ধতা—যে কোনো সময় আকাশ থেকে নেমে আসতে পারে একটি হুতির ড্রোন, কিংবা সমুদ্রের নিচ দিয়ে ছুটে আসতে পারে ক্ষেপণাস্ত্র। সৌদি জাহাজ, আমেরিকান যুদ্ধজাহাজ, ব্রিটিশ বাণিজ্যিক জাহাজ—কোনোটাই আজ আর নিরাপদ নয়। ইয়েমেনের বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুতি, যারা একসময় শুধুই একটি স্থানীয় রাজনৈতিক-ধর্মীয় আন্দোলন ছিল, আজ তারা বিশ্বের সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য এক বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। তাদের এই সাফল্যের মূলে আছে এক চমকপ্রদ প্রযুক্তিগত রূপান্তরের গল্প।

হুতিদের প্রযুক্তিগত উত্থান শুরু হয় ২০১৫ সালের দিকে, যখন সৌদি আরব তাদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করে। এই সময় থেকেই হুতিরা বুঝে যায়, শুধু ছোট অস্ত্র বা স্থানীয় হামলা দিয়ে টিকে থাকা যাবে না। দরকার প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিরোধ। সেই থেকেই শুরু হয় তাদের ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার, এবং স্যাটেলাইট-নির্ভর হামলার প্রস্তুতি।

প্রথম দিকে তারা যেসব ড্রোন ব্যবহার করত সেগুলো ছিল ইরান থেকে আসা পুরনো মডেলের। কিন্তু এরপর তারা স্থানীয়ভাবে এসব ড্রোন কপি করতে শুরু করে। এইভাবে তৈরি হয় "কাসেফ-১", "সামাদ-৩", এমনকি "ওয়াদুদ" নামের একাধিক উন্নত মডেলের ড্রোন। এই ড্রোনগুলো শুধু নজরদারি নয়, বড় ধরনের বিস্ফোরক বহন করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে পারে।

এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. ব্রুস হফম্যান বলেন, “হুতিদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অবাক করার মতো। তারা এখন এমন ড্রোন তৈরি করতে সক্ষম যেগুলো ১,৫০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারে। এটি কেবল বিদ্রোহ নয়, আধুনিক প্রযুক্তির সামরিক ব্যবহার।”

শুধু ড্রোনই নয়, হুতিদের রয়েছে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেমও। ইরানি ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে তারা তৈরি করেছে "বদর-১", "কুদস-২", এবং "জলজলাত" নামের ক্ষেপণাস্ত্র, যেগুলো পশ্চিমা রাডার সিস্টেম ফাঁকি দিতে সক্ষম। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো স্যাটেলাইট ও জিপিএস ব্যবস্থায় পরিচালিত হয়, ফলে সেগুলোর লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৪ পর্যন্ত হুতিরা যেভাবে লোহিত সাগরে হামলা চালিয়েছে, তা বিশ্ব জাহাজ চলাচলে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। "মার্স্ক", "এভারগ্রিন", "এমএসসি"-এর মতো বড় বড় কোম্পানি এই রুট ব্যবহার বন্ধ করে বিকল্প পথ বেছে নেয়। এতে করে সুয়েজ খালের গুরুত্ব কমে যায় এবং আফ্রিকা ঘুরে চলাচল করতে গিয়ে সময় ও খরচ দুই-ই অনেক বেড়ে যায়।

এই প্রসঙ্গে ব্রিটেনের ডিফেন্স স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. এমিলি শার্প বলেন, “হুতিদের এই কৌশল কেবল সামরিক সাফল্য নয়, এটি অর্থনৈতিক যুদ্ধেরও এক নিখুঁত রূপ। তারা জানে, একটি জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়ার চেয়েও জাহাজগুলোর মনোবল ভেঙে দেওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

হুতিরা এখন নতুন একটি কৌশল চালু করেছে, যেটিকে বলা হচ্ছে "সারফেস-টু-সী সাইলেন্ট অ্যাটাক"। এর মাধ্যমে তারা ছোট স্পিড বোটে করে জাহাজের খুব কাছে চলে যায়, তারপর সেখান থেকে ড্রোন কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র ছাড়ে। জাহাজের রাডার এইসব ছোট বোট বা নিম্ন-উচ্চতার ড্রোনকে শনাক্ত করতে পারে না, ফলে প্রতিরোধ গড়তে দেরি হয়ে যায়।

তাদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো "অ্যান্টি-শিপ ব্যালিস্টিক মিসাইল", যার মধ্যে অন্যতম হলো "নাহিদ-৬" এবং "আরিয়াদ-২"। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো উঁচুতে উঠে পরে হঠাৎ করে সাগরের ওপর নেমে আসে, যার ফলে যুদ্ধজাহাজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এগুলো মোকাবেলা করতে হিমশিম খায়।

এই সব প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি হুতিরা ব্যবহার করছে ওপেন সোর্স উপগ্রহ ছবি, লাইভ জাহাজ লোকেটর, এবং ইন্টেলিজেন্স অ্যাপস। এর মাধ্যমে তারা কোন কোন বাণিজ্যিক জাহাজ কখন কোথায় যাচ্ছে—তা আগেই জেনে রাখছে। তারপর সে অনুযায়ী তারা হামলা চালাচ্ছে। কখনো কখনো তারা আকাশে নিজেদের ড্রোন পাঠিয়ে জাহাজের গতিবিধি পরীক্ষা করে, তারপর হামলা চালায়।

হুতিদের এই প্রযুক্তিগত কৌশলের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, তারা এখন অটোনোমাস বা স্বয়ংক্রিয় ড্রোন ও আন্ডারওয়াটার ড্রোন তৈরির দিকে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কানাডার মন্ট্রিয়ল ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এর গবেষক ড. অ্যালেক্স হ্যানসেন বলেন, “যদি হুতিরা সমুদ্রের নিচে চালিত স্বয়ংক্রিয় ড্রোন ব্যবহারে সফল হয়, তাহলে তা হবে নেভাল যুদ্ধের এক বিপ্লব। কারণ পানির নিচে কোনো রাডার সহজে ড্রোন শনাক্ত করতে পারে না।”

এতসব প্রযুক্তির উৎস কোথা থেকে আসে? এক কথায় বলা যায়—ইরান। যদিও তেহরান সরাসরি তা স্বীকার করে না, কিন্তু বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, ইরানি প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং যন্ত্রাংশের সহায়তায়ই হুতিরা আজ এতদূর এগিয়েছে। তারা শুধু প্রযুক্তি নিচ্ছে না, বরং নিজস্ব প্রযুক্তি ডেভেলপমেন্ট সেলও গড়ে তুলেছে সানা ও সা’দা প্রদেশে। স্থানীয় বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও ড্রোন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তৈরি হয়েছে হুতির নিজস্ব ‘মিলিটারি টেক ল্যাব’।

হুতিদের টার্গেট এখন শুধু সামরিক নয়, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধও। তারা হামলার ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে দেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এতে তারা শুধু শত্রুকে ভীত করে না, বরং নিজেদের সমর্থকদের মনোবলও বাড়িয়ে তোলে। হুতিরা দাবি করে, তারা ‘মুসলিম দুনিয়ার প্রতিরোধ বাহিনী’, যারা পশ্চিমাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়ছে। এই বার্তা অনেক সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রভাব ফেলছে।

তবে এই সব কিছুর মাঝেও প্রশ্ন থেকে যায়—এই প্রযুক্তিগত সাফল্য কি টেকসই? কারণ আমেরিকা ও ব্রিটেন এখন হুতিদের এই সফলতা রুখতে যৌথভাবে কাজ শুরু করেছে। তারা স্যাটেলাইট থেকে হুতিদের লঞ্চিং পয়েন্ট নজরদারিতে রেখেছে এবং প্রতিবার হামলার পর পাল্টা হামলা চালাচ্ছে।

এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে জার্মানির হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা গবেষক ড. লুকাস ম্যায়ার বলেন, “হুতিদের প্রযুক্তি যতই শক্তিশালী হোক, শেষ পর্যন্ত এটি নির্ভর করে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার ওপর। যদি বিশ্ব শক্তিগুলো সমন্বিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তবে হুতিদের এই আধিপত্য সীমিত হয়ে যাবে।”

তবু স্বীকার করতেই হয়—পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী যে পর্যায়ে সফল হয়েছে, তা অভূতপূর্ব। তারা প্রমাণ করেছে, আধুনিক যুদ্ধ কেবল অর্থ বা অস্ত্রের ওপর নির্ভর করে না—কৌশল, প্রযুক্তি ও মেধারও একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।

লোহিত সাগরের ঢেউ এখন আর শুধু জাহাজ বইছে না, বইছে এক নতুন যুগের লড়াই—ড্রোন, মিসাইল আর তথ্যপ্রযুক্তির লড়াই। সেই লড়াইয়ে হুতি বিদ্রোহীরা এখন পর্যন্ত এক ধাপ এগিয়েই রয়েছে।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

ইরান যেভাবে কর্মসূচির শুরু করে

ইরাণের পারমাণবিক কর্মসূচির গোড়া পত্তন হয় ১৯৫০-এর দশকে। তখন দেশটির শাসন ক্ষমতায় ছিলেন মোহাম্মদ রেজা পাহলভি, ইরাণের শাহ। সে সময় ইরাণ ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর ঘনিষ্ঠ মিত্র।

২ দিন আগে

তিব্বতের দালাই লামা কেন ভারতে থাকেন

লাসায় একটি বিশাল জনসমাবেশ হয় দালাই লামাকে চীনা সেনার হাত থেকে রক্ষার জন্য। এই সমাবেশ দমন করতে চীনা বাহিনী চালায় ট্যাংক, কামান, গুলি। হাজার হাজার তিব্বতি নিহত হন।

২ দিন আগে

গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর ২য় বৈঠক

গাজায় চলমান যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার জন্য গতকাল মঙ্গলবার (৮ জুলাই) সন্ধ্যায় দ্বিতীয়বারের মতো বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

২ দিন আগে

তালেবানের শীর্ষ দুই নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

আফগানিস্তানে নারী নির্যাতন ও তাদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়ার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) তালেবানের দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।

২ দিন আগে