শীর্ষ নেতারা বিপক্ষে, জি এম কাদেরের ভরসা তৃণমূলে

শাহরিয়ার শরীফ
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫, ২১: ০০

বড় ভাই হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর অনেকটা একক নিয়ন্ত্রণেই জাতীয় পার্টি (জাপা) চালিয়ে নিচ্ছিলেন গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের)। লম্বা সময় ধরে জাপা চেয়ারম্যানের পদে থাকা জি এম কাদের এবার দলের মধ্যেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে তার নেতৃত্ব।

জাপার সূত্রগুলো বলছে, কেন্দ্রীয় ও শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই এখন জি এম কাদেরকে চেয়ারম্যান পদ থেকে সরানোর পক্ষে ‘একজোট’ হয়েছেন। সেটি সম্ভব না হলে আরও একবার ভাঙনের মুখে পড়তে পারে জাপা। তবে জি এম কাদেরের পক্ষে হাতেগোনা কয়েকজন নেতা থাকলেও তারা বলছেন, তৃণমূলের পূর্ণ সমর্থন এখনো তাদের পক্ষেই। ফলে অন্যরা দল থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু জাপা জি এম কাদেরের নেতৃত্বেই টিকে থাকবে।

এরই মধ্যে দুপক্ষই পালটাপালটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছে গণমাধ্যমে। এক পক্ষ ‘জাপা চেয়ারম্যানের একগুয়েমি ও স্বেচ্ছাচারিতার অবসানে’র দাবি তুলেছে। অন্য পক্ষের সংবাদ ‍বিজ্ঞপ্তিতে জাপা চেয়ারম্যানের প্রতি ‘তৃণমূল নেতাদের অকুণ্ঠ সমর্থনে’র কথা জানানো হয়েছে।

জাতীয় পার্টির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পদ হারানোর মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি এখন জাপা চেয়ারম্যান। কারণ পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব মুজিবুর রহমান চুন্নু থেকে শুরু করে জি এম কাদেরের একসময়ের ঘনিষ্ঠজনরা এখন উলটো পথে হাঁটতে শুরু করেছেন।

বলতে গেলে পার্টির শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই এখন অবস্থান নিয়েছেন জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, জাতীয় কাউন্সিলে চেয়ারম্যান পদে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব পদে এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা জাপা চেয়ারম্যানকে আরও বেকায়দায় ফেলেছে।

এমন পরিস্থিতিতে ভেন্যু জটিলতার কথা বলে আগামী ২৮ জুনের সম্মেলন স্থগিত করেছেন জি এম কাদের। তার এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদার দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় কাকরাইলে আলাদা সম্মেলন আহ্বান করে করেছিলেন। পরে সেখানে জি এম কাদেরের অনুসারীদের পক্ষ থেকে সমাবেশ করার কথা বলা হলে সংঘাত এড়াতে আপাতত কাউন্সিল না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।

জি এম কাদেরপন্থিরা বলছেন, কেন্দ্রীয় নেতারা মিলে আলাদা প্ল্যাটফর্ম করলেও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তাদের সঙ্গেই থাকবেন। তাদের ভাষ্য, আগেও যতবার দলে ভাঙন ধরেছে, তৃণমূল বরাবরই মূলধারার সঙ্গে ছিল। এর বাইরে অন্যরা রাজনীতিতে খুব একটা ভালো করতে পারেননি। এবারও এমন পরিস্থিতি হলে সারা দেশের নেতাকর্মীরা জি এম কাদেরের সঙ্গেই থাকবেন।

দলের কো-চেয়ারম্যান মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘দলে অস্থিরতা তো অনেক আগে থেকেই আছে। জাপা তো আর কম ভাঙেনি। অনেকে চেষ্টা করছে। কিন্তু মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে কোনো লাভ নেই। জিএম কাদেরের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে দলটির প্রার্থীকে হারিয়ে রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব পালন করা জাপা নেতা ফিজার বলেন, ‘রংপুর-রাজশাহী বিভাগে অন্যদের তো কেউ নেই। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ পাঁচ হাজার ভোটও পাবেন না। তাদের মতো অথর্ব নেতাদের মূল্যায়ন করার কারণে এ অবস্থা হয়েছে। আমরা চেয়ারম্যানের আহ্বানে সব জেলা ও মহানগরের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ঢাকা যাচ্ছি। সামনে কী হবে, তার পরামর্শ দেওয়া হবে।’

এর আগে গত ১৬ জুন জাপা চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারি খন্দকার দেলোয়ার জালালীর সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জাতীয় পার্টির দশম জাতীয় সম্মেলনের জন্য বরাদ্দ পাওয়া বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ হল বরাদ্দ বাতিল করায় ২৮ জুন সম্মেলন হচ্ছে না। পরে স্থান পাওয়াসাপেক্ষে জাতীয় সম্মেলনের তারিখ ও সময় জানিয়ে দেওয়া হবে।

বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৮ জুন প্রধান উপদেষ্টার বাজেট-সংক্রান্ত সেমিনারের জন্য তাদের বরাদ্দ বাতিল করা হয়েছে বলে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। জিএম কাদেরের পক্ষ থেকে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

জি এম কাদেরের ঘনিষ্ঠ একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আগে সম্মেলনের সিদ্ধান্ত থেকে আপাতত সরে আসা হয়েছে। এখন পর্যন্ত চেয়ারম্যান সে সিদ্ধান্তেই অটল আছেন। আপাতত সম্মেলন হচ্ছে না— এটাই চূড়ান্ত।’

জি এম কাদেরের এ সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে ১৭ জুন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারের যৌথ বিবৃতিতে বিকল্প স্থান হিসেবে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সামনে কাউন্সিল করার আহ্বান জানান। তবে বুধবার (২৫ জুন) এক বিবৃতিতে তারা নিজেদের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে দ্রুত কাউন্সিলের তারিখ ঘোষণা করতে জি এম কাদেরের প্রতি আহ্বান জানান।

তবে দলের ভেতরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে সপ্তমবারের মতো জাতীয় পার্টির ভাঙন ঠেকানো সম্ভব হবে না— তা অনেকটা নিশ্চিত। শেষ পর্যন্ত দুপক্ষ ছাড় দেওয়ার মানসিকতা দেখালে পরিস্থিতি শান্ত হতে পারে— এমন আলোচনাও আছে।

জাপার একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা আর শামীম হায়দার পাটোয়ারী ছাড়া শীর্ষ নেতাদের কেউ জি এম কাদেরের সঙ্গে নেই। কাউন্সিল করে নতুন কমিটি হলে জি এম কাদের মাইনাস হয়ে যাবেন।’

নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এরশাদের পতনের পর প্রথমবারের মতো ভাঙন ধরে জাতীয় পার্টিতে। দ্বিতীয় দফার ভাঙন হয় ১৯৯৭ সালে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও শেখ শহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে। কাজী জাফর ও শাহ মোয়াজ্জেমের নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে, ২০০১ সালে নাজিউর রহমানের নেতৃত্বে চতুর্থ দফায় এবং ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে জাপায় পঞ্চমবারের মতো ভাঙন ধরে।

এরশাদ মারা যাওয়ার পর সবশেষ ২০২৪ সালের ২০ এপ্রিল এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ ভাগ হয়ে যায়।

জাপায় নতুন নেতৃত্ব আনার চেষ্টায় থাকা নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগের আমলে ‘গৃহপালিত বিরোধী দলে’র তকমা পাওয়া জাতীয় পার্টি অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের শুরুতে কিছুটা স্বস্তিতে ছিল। তবে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ আমলের ভূমিকা সামনে আসতে থাকায় চাপে পড়েন নেতারা।

এর মধ্যে জি এম কাদেরসহ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। সামনের দিকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে এবং জি এম কাদের নেতৃত্বে থাকলে নির্বাচনে লড়াই করা কঠিন হয়ে যাবে— এমন আশঙ্কা থেকে জি এম কাদেরকে বাইরে রেখে তারা দলের নেতৃত্ব তৈরির চেষ্টা করছেন।

এর বাইরেও গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে জি এম কাদের চেয়ারম্যান হিসেবে যখন যাকে ইচ্ছা বহিষ্কার, পদোন্নতি কিংবা যেকোনো ধরনের সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে পারেন। এ বিষয়টি নিয়ে ঘোর আপত্তি তার বিরোধী বলয়ের নেতাদের।

জাপার একজন কো-চেয়ারম্যান রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘প্রেসিডিয়াম থেকে শুরু করে সিনিয়র নেতারা বেশির ভাগ এক পক্ষে। তারা সবাই জি এম কাদেরের বিপক্ষে। সবাই তার একনায়কতন্ত্রের অবসান চায়। এবার তেমন কিছু হতে যাচ্ছে।’

জানতে চাইলে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘আমরা সংঘাত চাই না। কাকরাইলে কাউন্সিল করার চিন্তা করলেও সেখানে তারা (জি এম কাদেরের অনুসারী) সমাবেশ আহ্বান করেছে। আমরা যদি কাউন্সিল করি, তাহলে সমস্যা হবে। তাই আপাতত কাউন্সিল করছি না আমরা। আহ্বানে সাড়া না দিলে সুবিধামতো সময়ে কাউন্সিল হবে।’

তবে চেয়ারম্যান ছাড়া কারও কাউন্সিল করার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। রাজনীতি ডটকমকে তিনি বলেন, ‘একটু পালটাপালটি অবস্থান দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কাউন্সিল তো রাস্তায় হতে পারে না।’

শামীম হায়দার পাটোয়ারী আরও বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিলের সময়, সিদ্ধান্ত সব নেওয়ার ক্ষমতা চেয়ারম্যানের হাতে। সভাপতিত্বও তিনি করবেন। অন্য কেউ কাউন্সিল করলে তো সেটা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী হবে না। বেআইনি হবে। আমরা চাই, সবাই ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে এক প্ল্যাটফর্মেই থাকবেন।’

এর মধ্যে বুধবার জাপা চেয়ারম্যানের বনানী কার্যালয় মিলনায়তনে জেলা ও মহানগর কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবদের সঙ্গে জাপা চেয়ারম্যানের জরুরি সভা হয়েছে। সভায় একজন কো-চেয়ারম্যানসহ অন্তত ১২ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

ওই সভা শেষে খন্দকার দেলোয়ার জালালীর সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সারা দেশ থেকে আসা জাতীয় পার্টির জেলা ও মহানগর কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবরা জরুরি সভায় মিলিত হয়ে পার্টির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা ব্যক্ত করেছেন। সারা দেশে থেকে আসা নেতারা জরুরি সভায় বলেছেন, জাতীয় পার্টির মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

ad
ad

ঘরের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

নগর ভবনে হামলার দায় উপদেষ্টা আসিফের ঘনিষ্ঠদের: ইশরাক

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনে শ্রমিকদল নেতাদের একাংশের ওপর স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়ার ঘনিষ্ঠরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন।

১৪ ঘণ্টা আগে

আমাকে ধরে নিয়ে বুকে নিয়ে গুলি চালিয়ে দেন: ইশরাক

এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নগর ভবনে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়রের শপথ পড়ানোর দাবিতে আন্দোলনরত তার সমর্থকদের সঙ্গে অপর একটি গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে আহত ৯ জন আহত হয়েছেন।

১ দিন আগে

সংস্কারের প্রশ্নে কোনো আপস নেই : নুর

ফেসবুক পোস্টে নুরুল হক নুর বলেন, ‘গোলামি ও দাসত্বের রাজনীতি পরিবর্তনের জন্যই গণ অধিকার পরিষদের জন্ম। নতুন বাংলাদেশ গড়তে সংস্কারের প্রশ্নে কোনো আপস নেই।’

১ দিন আগে

‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীকসহ নিবন্ধন ফিরে পেল জামায়াত

এদিকে ২০১৬ সালের ১২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ‘দাঁড়িপাল্লা’ ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের মনোগ্রামে ব্যবহৃত হবে এবং কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও দলের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

১ দিন আগে