জাতীয় পার্টির (জাপা) সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রক্রিয়কে বেআইনি ও অবৈধ হিসেবে অভিহিত করেছেন দলটির মহাসচিব ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তিনি বলেছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পার্টির চেয়ারম্যান তার অনুপস্থিতিজনিত কারণে কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিলে তবেই তিনি সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন।

শুক্রবার (৮ আগস্ট) কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে জাপা মহাসচিব এসব কথা বলেন। এ সময় বৃহস্পতিবার রাতে গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ ও দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০/২(খ) ধারায় বলা হয়েছে— চেয়ারম্যান তার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান, কো-চেয়ারম্যান অথবা কোনো প্রেসিডিয়াম সদস্যকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করতে পারবেন। অর্থাৎ চেয়ারম্যান গঠনতন্ত্রের ক্ষমতাবলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগ করতে পারবেন। জাপা চেয়ারম্যান এখন দেশে আছেন, সুস্থ আছেন এবং নিয়মিত অফিসে আসেন। তাছাড়া কাউকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিয়োগও করেননি।

জাপা মহাসচিব আরও বলেন, চেয়ারম্যান দায়িত্ব না দিলে অন্য কোনো উপায়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ জাতীয় পার্টিতে নেই। ফলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তাদের (আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও তার অনুসারীরা) কাজ করার প্রক্রিয়াটি শুরু থেকে বেআইনি ও অবৈধ।

এদিকে নিজেকে জাপার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণার পাশাপাশি পার্টির কাউন্সিলও আহ্বান করেছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। এ প্রসঙ্গে শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, বহিষ্কৃতদের কাউন্সিলে জাতীয় পার্টির মূল ধারার কোনো নেতাকর্মী যাবেন না। আমি মনে করি, আমরা দীর্ঘদিন এক সঙ্গে রাজনীতি করেছি। তাই শিষ্টাচারের কারণে তারা কাউন্সিল থেকে বিরত থাকবেন।

তিনি আরও বলেন, তাদের এই কাউন্সিল রাজনীতিতে কোনো সুবাতাস আনবে না। কারণ তাদের এই কাউন্সিল আহ্বান সম্পূর্ণ অবৈধ। যারা জাতীয় পার্টি ভেঙেছে তারা কেউই রাজনীতিতে সফল হতে পারেনি। এরশাদের জাতীয় পার্টি বা জি এম কাদেরের জাতীয় পার্টি হচ্ছে মূলধারার জাতীয় পার্টি। মূলধারার জাতীয় পার্টি টিকে ছিল, টিকে থাকবে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, গত ২৮ জুন জাতীয় পার্টির জাতীয় কাউন্সিল হওয়ার কথা ছিল। হল বরাদ্দ না পাওয়ার কারণে কাউন্সিলটি স্থগিত করা হয়। ওই সময় হল কর্তৃপক্ষ আমাদের জানায়, প্রধান উপদেষ্টার বাজেট সংক্রান্ত একটি সভা হবে। তাই তারা আমাদের হল ভাড়ার অগ্রিম টাকা গ্রহণ করেনি। আমরা ২৭ তারিখেও হল চেয়েছিলাম। কিন্তু হল কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে হল বরাদ্দ দেওয়ার ব্যাপারে অপারগতা প্রকাশ করে।

কাউন্সিলের ভেন্যুসংক্রান্ত এ জটিলতাকে দলের একটি পক্ষ মিথ্যাচার করে বিভ্রান্তি ছড়ায় বলে অভিযোগ ব্যারিস্টার শামীমের। তিনি বলেন, দুঃখের বিষয়, কিছু সিনিয়র নেতা এই বিষয়টিকে মিথ্যা দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এ ঘটনায় আমাদের কিছু সিনিয়র নেতা ২৮ জুনই কাউন্সিল করার জন্য রেষারেষি শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ জুন জাতীয় পার্টির ৭৮টি ইউনিট কমিটির নেতারা সভা করে জাপা চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের ওপর পূর্ণ আস্থা জানান। একই সঙ্গে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।

জাপা।মহাসচিব বলেন, পরে ২৮ জুন জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী সিনিয়র নেতাদের দল থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত হয়। প্রেসিডিয়াম সদস্যদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ৩০ ধারা অনুযায়ী জপা চেয়ারম্যান অনেককেই বহিষ্কার করেন। পরে তারা দেওয়ানি মামলা করেন। দীর্ঘ শুনানির পর আদালত আবেদনটি পরিবর্তিত আকারে মঞ্জুর করা করেন।

জাপা।মহাসচিব জানান, আদালতের নির্দেশনায় জাপা চেয়ারম্যান ও দপ্তর সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলার পরবর্তী তারিখ পর্যন্ত সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ আদেশে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যানকে বাতিল করা হয়নি, চেয়ারম্যান পদ অবৈধ ঘোষণা করা হয়নি এবং বর্তমান চেয়ারম্যানকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়নি। ফলে যারা প্রাথমিক সদস্যপদসহ বহিষ্কৃত হয়েছেন, তারা এখন পর্যন্ত বহিষ্কৃত আছেন। তাদের পক্ষে জাতীয় পার্টির কোনো সভায় অংশ নেওয়া অবৈধ। তারা কোনো সভা ডাকতে পারেন না এবং প্রেসিডিয়াম সভা করতে পারেন না। বহিষ্কৃতদের কাউন্সিল ডাকার অধিকার নেই।

শামীম হায়দায় আরও বলেন, অনেকেই জাতীয় পার্টির পদ-পদবী ব্যবহার করে সভা করছেন, কেউ নিজেকে মহাসচিব দাবি করছেন। প্রকৃতপক্ষে আদালতের আদেশে মহাসচিব শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি এবং আদেশে মহাসচিব বিষয়ে কিছু উল্লেখ৯ করা হয়নি। তাহলে আরেকজন কী করে নিজেকে মহাসচিব দাবি করেন? আমরা লক্ষ করছি, আদালতের রায়ের অপব্যাখ্যা হচ্ছে। নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত না হতে অনুরোধ জানাচ্ছি।

দলের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক জটিলতার পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতি নিয়েও সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন জাপা মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী। বলেন, দেশে এখন নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। রাষ্ট্রের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এমন বাস্তবতায় মনে হচ্ছে নির্বাচন করার জন্য সরকারের কোনো আন্তরিকতা ছিল না।

তিনি আরও বলেন, এখন নির্বাচন নিয়ে সরকার নতুন ইনিংস শুরু করেছে। আমরা দেখতে চাই এই ইনিংসে সরকার কেমন ব্যাটিং-বোলিং করে। এরপরই আমরা নির্বাচনের ব্যাপারে সঠিক মন্তব্য করতে পারব। এখন যদি সরকার সচেষ্ট হয় তাহলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে হয়তো নির্বাচন করা সম্ভব হবে। নির্বাচনের জন্য সরকারের সদিচ্ছা ও সক্ষমতা থাকতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, অ্যাডভোকেট মো. রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, আলমগীর শিকদার লোটন, ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল হোসেন তাপস, অধ্যাপক মহসিনুল ইসলাম হাবুল, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট মমতাজ উদ্দিন, ইঞ্জিনিয়ার মইনুর রাব্বি চৌধুরী রুম্মন, চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা হেনা খান পন্নী, অধ্যাপক ড. গোলাম মোস্তফা ও মো. খলিলুর রহমান খলিল; ভাইস চেয়ারম্যান আমির উদ্দিন ডালু, মো. হেলাল উদ্দিন ও এম এ সোবাহান আখতার হোসেন দেওয়ান; জাপা চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারি খন্দকার দেলোয়ার জালালী এবং যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক সমরেশ মন্ডল মানিক।