জীবনযাপন

সাগরে ডুবে কেন এত প্রাণহানি, বাঁচার উপায় কী

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫, ১৫: ৩০

বাংলাদেশের কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এখানে ঘুরতে আসেন, অনেকে সাগরের ঢেউয়ের মধ্যে নেমে পড়েন আনন্দে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, প্রায়ই শোনা যায়—সাঁতার জানা মানুষও এই সাগরে ডুবে মারা গেছেন। এই মৃত্যুগুলোর কারণ কী? সাঁতার জানা সত্ত্বেও কেন কেউ সাগরে প্রাণ হারান? আর এই বিপদ থেকে কীভাবে বাঁচা যায়?

এই প্রশ্নগুলো শুধুই কৌতূহল নয়, বরং অত্যন্ত জরুরি। কারণ অনেক মানুষ ভাবেন, “আমি তো ভালো সাঁতার জানি, একটু সাগরে নামলে কিছুই হবে না।” এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কখনো কখনো হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী।

মূলত, কক্সবাজারের সাগর বা বঙ্গোপসাগরের এই অঞ্চলকে অনেকটাই ধোঁকাবাজ টাইপের বলা চলে। উপরের পানি শান্ত দেখালেও নিচে থাকে প্রবল স্রোত, হঠাৎ তৈরি হয় রিপ কারেন্ট বা বিপজ্জনক টান। এটা একধরনের জলোচ্ছ্বাসময় স্রোত, যা পাড় থেকে সোজা গভীর সাগরের দিকে মানুষকে টেনে নিয়ে যায়।

রিপ কারেন্ট

ইউএস ন্যাশনাল ওশিয়েনিক অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন** (ইউএস-এনওএএ) এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “রিপ কারেন্ট হচ্ছে এমন একধরনের সংকীর্ণ ও শক্তিশালী জলের ধারা, যা উপকূল থেকে সোজা সাগরের গভীরের দিকে প্রবাহিত হয়।” এটা যখন তৈরি হয়, তখন আপনি যতই ভালো সাঁতার জানুন না কেন, তার গতিকে হারানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

ইউনাইটেড স্টেটস লাইফগার্ড অ্যাসোসিয়েশন-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “রিপ কারেন্ট বছরে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে ১০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়।” বাংলাদেশে এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তবে সংবাদমাধ্যমে প্রতি বছর কক্সবাজারে সাগরে ডুবে অন্তত কয়েক ডজন মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।

সাঁতার জানলেও কেন বাঁচা কঠিন?

রিপ কারেন্ট সাধারণত খুব দ্রুতগামী হয়—প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ২ মিটার পর্যন্ত গতিতে পানিকে টেনে নেয় গভীর সমুদ্রের দিকে। কেউ যদি এই স্রোতের মধ্যে পড়ে, তবে সে স্বাভাবিকভাবে উপকূলের দিকে ফিরতে চেষ্টা করে, অর্থাৎ স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটে। এতে শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। একসময় হাত-পা চলা বন্ধ হয়ে যায়, শুরু হয় আতঙ্ক। আর তখনই ঘটে বিপর্যয়।

অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির সমুদ্রবিজ্ঞানী ড. রব ব্র্যান্ডার বলেন, “রিপ কারেন্টে পড়ে গেলে মানুষের প্রথম ভুল হলো—স্রোতের বিপরীতে লড়াই করা। এতে তারা ক্লান্ত হয়ে যায় এবং ডুবে যায়।” তিনি পরামর্শ দেন, “এই সময় স্রোতের সাথে লড়াই না করে স্রোতের দিক বরাবর কিছুটা গিয়ে পরে বাঁ দিকে বা ডানে সাঁতার কেটে বের হয়ে আসা উচিত।” তাঁর গবেষণা এই তথ্যেই শক্তি পেয়েছে যে, অধিকাংশ রিপ কারেন্ট এক নির্দিষ্ট সীমার পরে থেমে যায়।

বাংলাদেশে সচেতনতাহীনতা এবং দুর্ঘটনার বাস্তব চিত্র

বাংলাদেশে কক্সবাজার বা অন্যান্য সমুদ্রসৈকতে পর্যটকরা প্রায়ই বিনা নির্দেশনা বা লাইফগার্ডের অনুপস্থিতিতেই সাগরে নেমে পড়েন। অনেক সময় তাঁরা দলে থাকলেও কেউ কাউকে নজর রাখেন না। আবার অনেকে গিয়েই গভীর জলে চলে যান, ঢেউয়ের তালে খেলতে খেলতে হঠাৎ বিপদে পড়েন। অনেকে পানিতে নামার আগে স্রোতের গতিমুখ বোঝেন না, কিংবা ভুল জায়গা বেছে নেন। এর মধ্যে রিপ কারেন্ট, হঠাৎ গভীরতা পরিবর্তন, পানির নিচে বালির ফাঁদ, এবং হাই টাইডের ঝুঁকি সবচেয়ে বড় বিপদ।

২০২৩ সালের এক ঘটনা আমরা মনে করতে পারি—একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যিনি সাঁতার জানতেন, কক্সবাজারে বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছিলেন। মজা করতে করতেই একটু দূরে চলে যান, কিন্তু আর ফেরেননি। পরে তাঁর দেহ মিলেছিল অনেক দূরে। বন্ধুদের ভাষ্যে জানা যায়, “সে খুব ভালো সাঁতার জানত, কখনও ভাবিনি এমন কিছু হবে।”

বাঁচার উপায় কী?

  • প্রথম এবং সবচেয়ে জরুরি হলো—রিপ কারেন্ট সম্পর্কে সচেতনতা। ইউএস এনওএএ যেসব পরামর্শ দিয়েছে, তা অনুসরণ করলে জীবন বাঁচানো সম্ভব।
  • কোনোদিনই একা সাগরে নামা উচিত নয়। সম্ভব হলে লাইফগার্ডের কাছে থাকা উপকূলে নামতে হবে। লাইফগার্ডরা সাধারণত নির্দিষ্ট পতাকা বা চিহ্ন দিয়ে রিপ কারেন্ট এলাকা চিহ্নিত করে রাখেন। যদি এমন কোনো সতর্কতা দেখা যায়, তা অমান্য করা উচিত নয়।
  • সাঁতার জানেন মানেই আপনি নিরাপদ—এই ধারণা মুছে ফেলতে হবে। সাগরের নিয়ম এবং বিপদ সম্পূর্ণ আলাদা। আপনি যতই নদী বা পুকুরে দক্ষ হন, সাগরের ঢেউ এবং স্রোতের শক্তির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া সহজ নয়।
  • যদি কেউ রিপ কারেন্ট-এ পড়ে যান, তাহলে উল্টো দিকে না গিয়ে বরং স্রোতের সঙ্গে কিছুটা বয়ে গিয়ে পরে পাশে সাঁতার কাটুন। হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে গেলে নিজেকে ভাসিয়ে রাখুন। প্যানিক বা আতঙ্ক যেন না হয়, এটা গুরুত্বপূর্ণ।
  • বাংলাদেশের উপকূলে পর্যটনের মৌসুমে পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রশিক্ষিত লাইফগার্ড থাকা উচিত। পর্যটকসমাগম বেশি হয় এমন সময়গুলোতে সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মোতায়েন করা উচিত মোবাইল মনিটরিং টিম**, যারা **হ্যান্ড মাইক** বা অন্য উপায়ে সতর্কতা দেবে।
  • সচেতনতা তৈরির জন্য পোস্টার, ভিডিও এবং স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা দরকার।

মার্কিন রিপ কারেন্ট বিশেষজ্ঞ জেফ হ্যাভেনার বলেন, “রিপ কারেন্ট নিজে হত্যাকারী নয়, বরং মানুষের আতঙ্কই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।” এই মন্তব্য আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে, সঠিক শিক্ষা ও মানসিক প্রস্তুতিই জীবন বাঁচাতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অব মিয়ামির সামুদ্রিক নিরাপত্তা গবেষক লরা ম্যাককিনলি বলেন, “প্রতি বছর রিপ কারেন্ট সম্পর্কিত মৃত্যু কমানো সম্ভব শুধু যদি মানুষ শেখে কীভাবে তা শনাক্ত করতে হয়।” তাঁর মতে, সাগরে ঢেউয়ের ফাঁকে যদি পানি অসমভাবে দূরে টানতে থাকে, বুঝতে হবে এটি একটি রিপ কারেন্ট এলাকা।

সাগর আমাদের কাছে শুধুই আনন্দের জায়গা নয়, বরং দায়িত্বশীলতার জায়গা। বিশেষ করে কক্সবাজারের মতো বিশাল ও গভীর সাগরের সামনে দাঁড়ালে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। সাঁতার জানা ভালো, কিন্তু তা দিয়ে সব বিপদ জয় করা যায় না। প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে চলে। তাই দরকার নিয়ম জানা, বিপদ চেনা এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া। তা না হলে সামান্য আনন্দের জন্য জীবন দিতে হতে পারে—এটা আমরা কেউই চাই না।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

বাংলা গানে বর্ষা: ভালোবাসা, বিরহ আর প্রকৃতির আবগীয় অনুরণন

প্রাচীন কবি-গান থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অতুল প্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় থেকে আধুনিক যুগের সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, রুনা লায়লা কিংবা বর্তমান প্রজন্মের অনুপম রায়, শিলাজিৎ—সবাই বর্ষার রোমান্টিকতায় মজেছেন।

১৪ ঘণ্টা আগে

বর্ষায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এত বেশি কেন, কীভাবে বাঁচবেন এর থেকে?

বর্ষায় চারদিকে জমে থাকে পানি। খোলা ড্রেন, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, ফুলদানি, এমনকি এসির নিচে রাখা কনডেনসড পানির বাটি—সবখানেই জন্ম নিতে পারে এডিস ইজিপটাই ও এডিস অ্যালবোপিক্টাস নামের মশা, যারা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে।

১৪ ঘণ্টা আগে

অব্যাহত টানা বর্ষণ, বন্যার আশঙ্কা কতটা?

দেশে এমন অব্যাহত বর্ষণের মধ্যেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশেও বন্যা হবে কি না। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এখনই বন্যার ঝুঁকি নেই।

১৫ ঘণ্টা আগে

বাংলা উপন্যাসে বর্ষা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর উপন্যাসে বর্ষাকে কখনো কাব্যিক আবহে তুলে ধরেছেন, কখনোবা ব্যবহার করেছেন মনোজাগতিক উত্তরণের প্রতীক হিসেবে।

১ দিন আগে