স্বাস্থ্য

বর্ষায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এত বেশি কেন, কীভাবে বাঁচবেন এর থেকে?

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১২: ৫১

বাংলাদেশে প্রতি বছরই বর্ষাকালে ডেঙ্গু জ্বর যেন এক দুঃস্বপ্ন হয়ে ফিরে আসে। কোথাও জমে থাকা পানিতে জন্ম নেয় এডিস মশা, আর সেখান থেকেই ছড়াতে থাকে ডেঙ্গু ভাইরাস। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্ষার সঙ্গে ডেঙ্গুর এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মূলত পরিবেশগত ও জলবায়ুগত কারণে। তবে শুধু প্রকৃতি নয়, আমাদের অজ্ঞানতা, অসতর্কতা আর অব্যবস্থাপনাও ডেকে আনছে এই প্রাণঘাতী রোগ।

বর্ষায় চারদিকে জমে থাকে পানি। খোলা ড্রেন, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, ফুলদানি, এমনকি এসির নিচে রাখা কনডেনসড পানির বাটি—সবখানেই জন্ম নিতে পারে এডিস ইজিপটাই ও এডিস অ্যালবোপিক্টাস নামের মশা, যারা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে। এই মশা দিনের বেলায় কামড়ায়, বিশেষ করে সকাল ও বিকেলের দিকে। আর তাদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হলো নগরজীবনের আশপাশে জমে থাকা পরিষ্কার পানি।

যুক্তরাষ্ট্রের "সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন" বা সিডিসি (CDC) জানিয়েছে, “এডিস মশার ডিম শুকনো অবস্থায়ও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে। একবার পানি পেলেই তা থেকে বংশ বিস্তার শুরু হয়।” এই তথ্যটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে বর্ষাকালের প্রেক্ষাপটে। কারণ বৃষ্টির পানিতে পুরোনো শুকনো ডিমগুলো নতুন প্রাণ পায়। ফলে বর্ষা এলে মশার সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়ে যায়।

মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও নাগরিক উদাসীনতাও এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। শহরের অলিগলিতে অজস্র জায়গায় পানি জমে থাকে দিনের পর দিন। অনেকে নিজের বাসার ছাদ, বারান্দা, এমনকি ফ্রিজের ট্রের দিকেও খেয়াল রাখেন না। এই সব জায়গাতেই মশা বংশবিস্তার করে। সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির জনস্বাস্থ্য গবেষক ড. ক্লারা হু বলেন, “ডেঙ্গু মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় বাধা হলো মানুষের আচরণগত অনীহা। সবাই ভাবে, 'আমার বাড়িতে তো মশা নেই', অথচ পাশের বাড়িতে জমে থাকা পানির জন্য সেও আক্রান্ত হতে পারে।”

আবহাওয়া পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবও ডেঙ্গুর বিস্তারকে উৎসাহ দিচ্ছে। তাপমাত্রা যত বেশি, মশার প্রজনন তত দ্রুত। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা মিলে এডিস মশার জীবনচক্র হয়ে ওঠে আরও গতিশীল। অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির মশা ও রোগবিষয়ক গবেষক ড. ক্যামেরন সিমন্স বলেন, “গ্লোবাল ওয়ার্মিং ডেঙ্গুর বিস্তারকে বাড়িয়ে তুলছে। মশার জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি হচ্ছে ক্রমেই।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, এটি সামাজিক এবং পরিবেশগত সংকট। তাই এ থেকে মুক্তি পেতে হলে চাই সম্মিলিত উদ্যোগ। নিজেদের বাড়িঘর পরিষ্কার রাখা যেমন জরুরি, তেমনি আশপাশের এলাকাও নজরে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন কোথাও পানি জমে না থাকে, কিংবা জমলেও তা এক-দুদিনের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়।

যেসব বাসায় ফুলগাছ রয়েছে, সেগুলোর নিচে যেন পানি না জমে, তা নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। পাখির পাত্রে বা অ্যাকুয়ারিয়ামে পানি বদলাতে হবে সপ্তাহে অন্তত একবার। এসির নিচের ট্রে বা ফ্রিজের পেছনের ড্রেনও নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। আর বাচ্চাদের খেলনার ভেতরে কিংবা বাইরে রাখা পুরোনো বালতি, টায়ার বা প্লাস্টিকের বোতলও সাবধানে রাখতে হবে।

রাতে মশারি ব্যবহার করা দরকার হলেও দিনের বেলাতেও সাবধান থাকতে হবে। বিশেষ করে সকাল ও বিকেলে। যারা অফিস বা স্কুলে যান, তারা হাত-পা ঢাকা জামা-কাপড় পরলে উপকার পাবেন। ঘরে মশা ঢুকতে না দেওয়ার জন্য দরজা-জানালায় জাল ব্যবহার করা উচিত। এছাড়া বাজারে এখন নানা ধরণের মশানাশক স্প্রে বা ক্রিম পাওয়া যায়, যেগুলোর সঠিক ব্যবহার করলেও মশা কিছুটা দূরে রাখা সম্ভব।

সরকারি পর্যায়েও উদ্যোগ প্রয়োজন। মশা নিধনের জন্য নিয়মিত ফগিং, পরিচ্ছন্নতা অভিযান, মশা প্রজননস্থল ধ্বংস এবং জনসচেতনতা কার্যক্রম চালাতে হবে। তবে বাস্তবতা হলো, অনেক সময়েই এসব উদ্যোগ অকার্যকর থেকে যায়। তাই ব্যক্তি পর্যায়ে সাবধানতাই এখন প্রধান অস্ত্র।

ডেঙ্গু হলে প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয় জ্বর, চোখের পেছনে ব্যথা, মাথাব্যথা, শরীরে র‍্যাশ, হাড় ও সন্ধিতে ব্যথা। অনেক সময় বমি ও পেট ব্যথাও হতে পারে। এই জ্বর সাধারণত তিন থেকে সাত দিন স্থায়ী হয়। তবে যদি জ্বর সেরে যাওয়ার পর শরীর আরও দুর্বল হয়ে পড়ে, ঘন ঘন বমি শুরু হয়, রক্তপাত হয় কিংবা শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে যেতে হবে। কারণ এসব হতে পারে 'ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার' বা 'ডেঙ্গু শক সিনড্রোম'-এর লক্ষণ।

যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন-এর রোগতত্ত্ববিদ ড. জোনাথন কেলি বলেন, “ডেঙ্গু নিয়ে উদাসীনতা মানে মৃত্যু ডেকে আনা। শুরুতে সতর্ক থাকলে এবং রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়ালে ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে লড়াই অনেক সহজ হয়ে যাবে।”

বর্ষা যত সুন্দরই হোক, তার ছায়াতলে লুকিয়ে থাকে ডেঙ্গুর ভয়াল থাবা। একটু সচেতনতা, একটু যত্ন, আর একসাথে কাজ করার মানসিকতা আমাদের এই সংকট থেকে বাঁচাতে পারে। ঘরে-বাইরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, জমে থাকা পানি দ্রুত সরিয়ে ফেলা এবং নিজের ও আশপাশের মানুষদের সতর্ক করা—এই তিনটি কাজই হতে পারে ডেঙ্গু প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এই বর্ষায় তাই শুধু ছাতা হাতে বৃষ্টিতে ভেজা নয়, বরং সতর্কতার ছাতাও তুলে ধরতে হবে ডেঙ্গুর ভয় থেকে রক্ষার জন্য।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

বাংলা গানে বর্ষা: ভালোবাসা, বিরহ আর প্রকৃতির আবগীয় অনুরণন

প্রাচীন কবি-গান থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অতুল প্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় থেকে আধুনিক যুগের সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, রুনা লায়লা কিংবা বর্তমান প্রজন্মের অনুপম রায়, শিলাজিৎ—সবাই বর্ষার রোমান্টিকতায় মজেছেন।

৬ ঘণ্টা আগে

অব্যাহত টানা বর্ষণ, বন্যার আশঙ্কা কতটা?

দেশে এমন অব্যাহত বর্ষণের মধ্যেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশেও বন্যা হবে কি না। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এখনই বন্যার ঝুঁকি নেই।

৭ ঘণ্টা আগে

বাংলা উপন্যাসে বর্ষা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর উপন্যাসে বর্ষাকে কখনো কাব্যিক আবহে তুলে ধরেছেন, কখনোবা ব্যবহার করেছেন মনোজাগতিক উত্তরণের প্রতীক হিসেবে।

১ দিন আগে

কাঁচা রসুন কেন খাবেন?

কাঁচা রসুনের মূল গুণ হলো এর জীবাণুনাশক শক্তি। বহু শতাব্দী আগে থেকেই বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এটি প্রাকৃতিক ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

১ দিন আগে