অব্যাহত টানা বর্ষণ, বন্যার আশঙ্কা কতটা?

প্রতিবেদক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ১১: ৪৪
প্রবল বর্ষণে নাকাল ফেনী। জেলা শহরের প্রায় সব এলাকাই তলিয়ে গেছে পানিতে। এ জেলাতেই দুটি নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকলে। মঙ্গলবার বিকেলে তোলা। ছবি: ফোকাস বাংলা

আষাঢ়ের শুরু থেকেই বৃষ্টিপাত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এর মধ্যে গত চার দিন ধরে চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিভাগে টানা ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি ঝরেই চলেছে। এর সঙ্গে আগের ২৪ ঘণ্টায় যুক্ত হয়েছে ঢাকা বিভাগও। বাকি বিভাগগুলোতেও বৃষ্টি চলছে থেমে থেমে।

বর্ষা মৌসুমের টানা বৃষ্টিতে দেশের অন্তত ৬৮টি নদীর পানি আগের ২৪ ঘণ্টায় বেড়ে যাওয়ার তথ্য দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। তাদের তথ্য বলছে, ফেনী জেলার মুহুরি ও সেলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। অন্য সব নদীর পানিও বাড়বে।

দেশে এমন অব্যাহত বর্ষণের মধ্যেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। আকস্মিক ভয়াবহ বন্যার শিকার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসও। এসব বন্যায় ব্যাপক প্রাণহানির তথ্যও মিলছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে। প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশেও বন্যা দেখা দেবে কি না। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এবং আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এখনই বন্যার ঝুঁকি নেই।

বাংলাদেশে সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস বন্যাপ্রবণ সময় হিসেবে ধরা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে জুলাই মাসে। এ সময়ে মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকার কারণে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা পেরিয়ে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়। গত বছরও আগস্টে নজিরবিহীন বন্যা দেখা দেয় বেশ কয়েকটি জেলায়।

এবারও বর্ষার শুরু থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে সারা দেশে। এর মধ্যে সোমবার রাত থেকে দেশের প্রায় সব বিভাগে টানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে। কোনো কোনো অঞ্চলের নদীর পানি বেড়ে বিপৎসীমার কাছাকাছিও চলে এসেছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও সংলগ্ন এলাকায় একটি লঘুচাপ অবস্থান করছে। এ ছাড়া মৌসুমি বায়ুর অক্ষের বর্ধিতাংশ এখন রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, লঘুচাপের কেন্দ্রস্থল ও বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত। এর একটি বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত।

Rain Waterlog Flood News Photo 08-07-2025 (2)

মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি হচ্ছে সারা দেশেই। মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা থেকে তোলা। ছবি: ফোকাস বাংলা

এ পরিস্থিতির কারণে মৌসুমি বায়ু এখন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সক্রিয়, অন্যান্য জায়গায় মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় রয়েছে। ফলে দেশের সব বিভাগের কোথাও না কোথাও এখন হালকা থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে।

এর মধ্যে জুলাইয়ের শুরু থেকেই ব্যাপক বৃষ্টিপাত হচ্ছে সর্বদক্ষিণের জেলা কক্সবাজারে। মাসের প্রথম সপ্তাহের তিন দিনেই বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে ১০০ মিলিমিটারে বেশি।

কক্সবাজার আবহাওয়া কার্যালয়ের দায়িত্বে থাকা সহকারী আবহাওয়াবিদ মো. আব্দুল হান্নান মঙ্গবলবার রাতে রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘জুলাই মাসের এই সময়ে এমন বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক। এখন যে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে এটি হয়তো আগামীকাল (বুধবার) থেকে কমবে। তবে জুলাই মাস জুড়েই কমবেশি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে।’

গতকাল মঙ্গলবার অবশ্য সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে ফেনীতে। ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে পটুয়াখালীতেও। চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগ জুড়েই ছিল বৃষ্টি।

মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সময়ের তথ্য জানিয়ে আবহাওয়াবিদ খো. হাফিজুর রহমান বলেন, আগের ২৪ ঘণ্টায় ফেনীতে ৪৪০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। ২৪৮ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে পটুয়াখালীতে, রামগতিতে বৃষ্টি হয়েছে ২২৫ মিলিমিটার। চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের বাকি এলাকাতেও কোথাও ভারী, কোথাও অতি ভারী বৃষ্টি হয়েছে।

মৌসুমি বায়ুর পাশাপাশি লঘুচাপের কারণে উত্তর বঙ্গোপসাগর, উপকূলীয় এলাকা ও সমু্দ্র বন্দরে দমকা বা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কসংকেতও দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। অন্যদিকে খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার নদীবন্দরগুলোকেও ১ নম্বর সতর্কসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

আবহাওয়াবিদরা জানাচ্ছেন, মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে জুলাই মাসের ২২ থেকে ২৪ দিন বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। তবে আপাতত লঘুচাপের প্রভাব কেটে গেলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও প্রবণতা কিছুটা কমে আসবে।

Rain Waterlog Flood News Photo 08-07-2025 (1)

টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধ পটুয়াখালী শহর। বলতে গেলে জেলা শহর পুরোটাই একন পানির নিচে। সড়ক পেরিয়ে পানি ঢুকে গেছে বাসাবাড়ি-দোকানপাটেও। মঙ্গলবার বিকেলে তোলা। ছবি: ফোকাস বাংলা

ভারতের আলিপুর আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও সংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপ ক্রমশ ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিশগড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ওপর এর প্রভাব কমতে শুরু করেছে।

এদিকে প্রবল বর্ষণে ভারতের হিমাচল প্রদেশে বন্যায় এখন পর্যন্ত ৭৮ জনের মৃত্যুর তথ্য এসেছে গণমাধ্যমে। ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে প্রবল বর্ষণ থেকে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় প্রাণহানি ১০০ ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এবং আবহাওয়া অধিদপ্তর অবশ্য এখনই বন্যার আশঙ্কা করছে না। তারা বলছে, ভারতে বাংলাদেশের উজানের অঞ্চলগুলোতেও বন্যা নেই বলে বন্যার আশঙ্কা কম।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সবশেষ যে নদনদীর পানির পরিস্থিতি জানিয়েছে তাতে বুধবার মাত্র দুটি নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি যাওয়ার আভাস দেওয়া হয়েছে। নদী দুটি হলো— ফেনীর মুহুরী ও সেলোনিয়া।

কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, ফেনীর মুহুরি-সেলোনিয়াসহ চট্টগ্রাম-বান্দরবানের সাঙ্গু নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি যেতে পারে। তবে বৃষ্টি কমে গেলে আবার এসব নদীর পানি কমে আসবে।

কেন্দ্রের তথ্য আরও বলছে, চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী, হালদা ও মাতামুহুরি নদীর পানির সমতল বাড়ছে। গোমতী নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল। এসব নদীর পানি সমতল একদিন বেড়ে দুই দিন স্থিতিশীল থাকতে পারে।

Rain Waterlog Flood News Photo 08-07-2025 (4)

মঙ্গলবার দিনভরই বৃষ্টি হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। তাতে দুর্ভোগ নেমেছে নাগরিক জীবনে। মঙ্গলবার বিকেলে জিরো পয়েন্ট এলাকা থেকে তোলা। ছবি: ফোকাস বাংলা

অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার নদ-নদীগুলোর পানি সমতল তিন দিন বাড়লেও পরের দুই দিন কমবে। গঙ্গা-পদ্মার নদীগুলোতে পানি বাড়বে পাঁচ দিন পর্যন্ত। আর সুরমা কুশিয়ারার পানি সমতল স্থিতিশীল থাকবে আগামী তিন দিন। তবে এ সময়ের মধ্যে সব নদীর পানিই সার্বিকভাবে থাকবে বিপৎসীমার নিচে।

সরদার উদয় রায়হান বলেন, কোনো নদীর পানিই আগামী কয়েক দিনে বিপৎসীমা পেরোনোর সম্ভাবনা নেই। আমাদের উজানেও আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় বা বিহারে বন্যা নেই। তাই ভারী বৃষ্টিপাত হলেও এবং নদীগুলোর পানি কিছুটা বাড়লেও বন্যার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

বাংলা গানে বর্ষা: ভালোবাসা, বিরহ আর প্রকৃতির আবগীয় অনুরণন

প্রাচীন কবি-গান থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, অতুল প্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় থেকে আধুনিক যুগের সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, রুনা লায়লা কিংবা বর্তমান প্রজন্মের অনুপম রায়, শিলাজিৎ—সবাই বর্ষার রোমান্টিকতায় মজেছেন।

১২ ঘণ্টা আগে

বর্ষায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এত বেশি কেন, কীভাবে বাঁচবেন এর থেকে?

বর্ষায় চারদিকে জমে থাকে পানি। খোলা ড্রেন, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, ফুলদানি, এমনকি এসির নিচে রাখা কনডেনসড পানির বাটি—সবখানেই জন্ম নিতে পারে এডিস ইজিপটাই ও এডিস অ্যালবোপিক্টাস নামের মশা, যারা ডেঙ্গু ভাইরাস বহন করে।

১২ ঘণ্টা আগে

বাংলা উপন্যাসে বর্ষা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর উপন্যাসে বর্ষাকে কখনো কাব্যিক আবহে তুলে ধরেছেন, কখনোবা ব্যবহার করেছেন মনোজাগতিক উত্তরণের প্রতীক হিসেবে।

১ দিন আগে

কাঁচা রসুন কেন খাবেন?

কাঁচা রসুনের মূল গুণ হলো এর জীবাণুনাশক শক্তি। বহু শতাব্দী আগে থেকেই বিভিন্ন সংস্কৃতিতে এটি প্রাকৃতিক ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

১ দিন আগে