ভূরাজনীতি

নিষেধাজ্ঞার পাহাড় মাথায় নিয়েও ইরানের অর্থনীতি কীভাবে টিকে আছে

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৫, ০০: ৩৪

একটা দেশ বছরের পর বছর ধরে কঠোর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে থাকলেও যদি তার অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে না পড়ে, বরং ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়, তাহলে নিঃসন্দেহে সেটা এক বিশ্ব অর্থনৈতিক কৌতূহলের বিষয় হয়ে ওঠে। এমন একটি দেশ হলো ইরান। পারমাণবিক কর্মসূচি, মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক ভূমিকা ও পশ্চিমা বিশ্ববিরোধী অবস্থানের কারণে ইরান গত চার দশক ধরে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে। অথচ এত দীর্ঘ সময় ধরে এই অর্থনৈতিক চাপের মধ্যেও দেশটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। বরং কখনো জোরালোভাবে, কখনো ধীরগতিতে সে চালিয়ে যাচ্ছে টিকে থাকার লড়াই। এই টিকে থাকার গল্প শুধু রাজনীতির নয়, অর্থনীতি, কূটনীতি ও কৌশলেরও।

১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই ইরানের ওপর আরোপিত হয় অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। সবচেয়ে কঠিন নিষেধাজ্ঞা আসে ২০১0-২০১৫ সালের মধ্যে, যখন পশ্চিমা দেশগুলো অভিযোগ তোলে—ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। এসব নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে তেল রপ্তানি, ব্যাংকিং সেবা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, এমনকি বেসামরিক বিমান চলাচল পর্যন্ত। এর ফলে দেশটির মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়, মুদ্রা মান পড়ে যায়, বেকারত্ব ও দ্রব্যমূল্য উল্লম্ফন করতে থাকে। তবু দেশটি একেবারে ভেঙে পড়েনি। বরং ধীরে ধীরে একটি আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা শুরু করে।

ইরানের অর্থনৈতিক টিকে থাকার মূল ভিত্তি হলো তাদের তেল ও গ্যাস সম্পদ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জ্বালানি বিশ্লেষক ম্যাথিউ রিড বলেন, “ইরান বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস রিজার্ভ ও চতুর্থ বৃহত্তম প্রমাণিত তেল রিজার্ভের মালিক। এমন একটি দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে চিরতরে নিঃশেষ করে ফেলা সহজ নয়।” তিনি ব্যাখ্যা করেন, নিষেধাজ্ঞার পরও ইরান ‘গোপন রপ্তানি চ্যানেল’ তৈরি করেছে, যেখানে তারা ‘ছায়া ট্যাংকার’ ও বিকল্প আর্থিক ব্যবস্থার মাধ্যমে তেল বিক্রি করে চীন, সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া ও কখনো কখনো রাশিয়াসহ কিছু দেশের কাছে।

আরও চমকপ্রদ দিক হলো—ইরান নিষেধাজ্ঞাকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছে কিছু ক্ষেত্রে। স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় দেশটি। শিল্প ও কৃষিখাতে নির্ভরতা বাড়াতে শুরু করে। খাদ্য ও ওষুধ উৎপাদনে তারা ‘ঘরে যা আছে তা দিয়ে’ প্রযুক্তির বিকল্প বের করেছে। জার্মানির হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ ড. মার্টিন বোহম্যান বলেন, “ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিতে গাড়ি, ট্রাক, ট্রাক্টর থেকে শুরু করে কৃত্রিম ওষুধ উৎপাদনে অগ্রগতি করেছে। নিষেধাজ্ঞার আগে যে পণ্য ৮০ শতাংশ আমদানি হতো, তা এখন ৬০-৭০ শতাংশ দেশেই তৈরি হয়।” ড. বোহম্যানের মতে, ‘ইম্পোর্ট সাবস্টিটিউশন’ বা আমদানি প্রতিস্থাপন কৌশলে ইরান খানিকটা সাফল্য পেয়েছে।

নিষেধাজ্ঞা ঠেকাতে ইরান আরও এক কৌশল নেয়—আঞ্চলিক বাণিজ্য ও মুদ্রা ব্যবস্থার বিকল্প তৈরি। ডলারের পরিবর্তে তারা চীনা ইউয়ান, রাশিয়ান রুবল, এমনকি দ্বিপাক্ষিক বিনিময় ব্যবস্থায় বাণিজ্য শুরু করে। রাশিয়া, চীন, ভারত, তুরস্ক, কাতারসহ নানা দেশের সঙ্গে তারা চুক্তি করে, যাতে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে চলা যায়। ২০২১ সালে চীনের সঙ্গে তারা ২৫ বছর মেয়াদি এক স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপে চুক্তি করে, যার আওতায় চীন ইরানে ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং ইরান দীর্ঘমেয়াদে তেল সরবরাহ করতে রাজি হয়। এই চুক্তিকে অনেকে বলেন ‘নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বড় হাতিয়ার’।

তবে সবকিছুই যে উজ্জ্বল তা নয়। ইরানের সাধারণ মানুষ নিষেধাজ্ঞার কারণে কঠিন বাস্তবতায় দিন কাটায়। খাদ্যপণ্য, চিকিৎসা ও ভোক্তাপণ্য অনেক ক্ষেত্রেই ঘাটতি থাকে। দারিদ্র্যের হার বেড়েছে, বেকারত্বও সমস্যা। কিন্তু তবুও ইরান সরকার জনসমর্থন ধরে রাখতে পেরেছে ‘বিরোধিতার রাজনীতি’ ও ‘আত্মমর্যাদা’র আবেগ দিয়ে। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনেয়ী বারবার বলেছেন, “নিষেধাজ্ঞা আমাদের ভাঙতে পারেনি। বরং আমাদের আত্মনির্ভরতা ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলেছে।”

ইরানের টিকে থাকার আরেকটি দিক হলো—অপূরিত অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ব্যবহার। ইরান এক বিশাল বাজার, ৮ কোটির বেশি জনসংখ্যা, যুব জনগোষ্ঠী, কৌশলগত অবস্থান (মধ্যপ্রাচ্য, ককেশাস ও দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত), যা বহু দেশের কাছে আকর্ষণীয়। এ কারণে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও অনেক দেশ এবং বহুজাতিক কোম্পানি ‘ব্যাকচ্যানেল’ বা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ইরানে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

সর্বশেষ, ইরান একটি অর্থনৈতিক আদর্শ কৌশল হিসেবে ‘প্রতিরোধ অর্থনীতি’র (Resistance Economy) ধারণা চালু করেছে। যার মূল কথা হলো—বাহ্যিক নির্ভরতা হ্রাস, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি, বিকল্প প্রযুক্তি উদ্ভাবন, কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তোলা এবং জাতীয় পরিচয় রক্ষা করে অর্থনীতিকে সচল রাখা। ফ্রান্সের লিলে ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানী ড. সোফি গারদে বলেন, “ইরান হয়তো আজ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি নয়, কিন্তু এটা নিশ্চিতভাবে সবচেয়ে স্থিতিস্থাপক অর্থনীতির একটি উদাহরণ।”

সব মিলিয়ে, ইরানের অর্থনীতির গল্প এক প্রতিরোধের, কৌশলের এবং আত্মনির্ভরতার গল্প। নিষেধাজ্ঞা তাদের গতি কমিয়ে দিয়েছে, কিন্তু থামিয়ে দিতে পারেনি। বরং নতুন পথের সন্ধানে ইরান এগিয়ে চলেছে, যেভাবে মরুভূমির বুকে বয়ে চলে এক নিরবধি স্রোত। বিশ্ব রাজনীতি যদি একদিন বদলায়, হয়তো তখন আমরা আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারব—এই দীর্ঘ প্রতিরোধ শুধু বাধ্য হয়ে নয়, বরং এক কৌশলী বুদ্ধিমত্তা থেকেই গড়ে উঠেছিল।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

যুদ্ধ ও উপন্যাস: সাহিত্যের আয়নায় যুদ্ধের প্রতিচ্ছবি

বিশ্বসাহিত্যে এমন অসংখ্য উপন্যাস রয়েছে, যেগুলো যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লেখা হলেও তা শুধুই রাজনীতি বা কৌশলের গল্প নয়, বরং মানুষের গল্প।

১ দিন আগে

কিডনি সুস্থ রাখে যেসব খাবার

কিডনি সুস্থ রাখার প্রথম এবং সবচেয়ে সহজ উপায় হলো প্রচুর পানি পান করা। পানি আমাদের দেহের রক্ত তরল রাখে, কিডনির ফিল্টারিং প্রক্রিয়াকে সহজ করে এবং জমে থাকা ক্ষতিকর উপাদানগুলো ইউরিনের মাধ্যমে বের করে দেয়।

১ দিন আগে

হামাসের উত্থান কাহিনি

হামাসের জন্ম হয়েছিল ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ডাক হিসেবে। কিন্তু একে শুধু প্রতিরোধ বললে ভুল হবে। এটি ছিল ধর্ম, রাজনীতি আর সামাজিক সেবার এক অনন্য মিশেল।

১ দিন আগে

ওজন কমানোর সহজ উপায়

ওজন বাড়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, আমরা যত ক্যালোরি খাই, তার চেয়ে কম ব্যবহার করি। শরীর অতিরিক্ত ক্যালোরিকে ফ্যাট আকারে জমিয়ে রাখে।

১ দিন আগে