ইতিহাস

মোহেনজোদড়ো ও সুরুজোদড়ো যুদ্ধ কেন হয়েছিল?

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

সিন্ধু সভ্যতা মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম নগর সভ্যতাগুলোর একটি। আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে গড়ে ওঠা এই সভ্যতা শুধু স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনার জন্যই নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর জটিলতার জন্যও বিখ্যাত। এই সভ্যতার দুটি প্রধান নগরকেন্দ্র ছিল মোহেনজোদড়ো ও হরপ্পা। তবে সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় আরেকটি নগরের নাম পাওয়া যায়—সুরুজোদড়ো। এই নগরও ছিল সমৃদ্ধ, সুশৃঙ্খল এবং উন্নত পরিকল্পনায় গড়ে ওঠা। ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, একসময় এই দুই নগর—মোহেনজোদড়ো ও সুরুজোদড়ো—মধ্যে সংঘর্ষ বা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সেই যুদ্ধের কারণ ও প্রেক্ষাপট নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। যদিও চূড়ান্ত সত্য আজও রহস্যময়, তবু ইতিহাসের আলোকে এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে কিছু অনুমান ও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।

মোহেনজোদড়ো ছিল সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রীয় নগর, যা সিন্ধু নদীর তীরে অবস্থিত ছিল। অন্যদিকে সুরুজোদড়োও ছিল প্রায় সমসাময়িক নগর, যেখানে উন্নত স্থাপত্য, পাকা রাস্তা, নর্দমা ব্যবস্থা এবং বাজারের চিহ্ন পাওয়া গেছে। উভয় নগরের মানুষের জীবনযাত্রা ছিল সমৃদ্ধ। কিন্তু ইতিহাসের নিয়মেই সমৃদ্ধির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা জড়িয়ে থাকে। ক্ষমতা ও সম্পদের নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে শহরগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। প্রত্নতত্ত্ববিদেরা ধারণা করেন, এই দ্বন্দ্ব থেকেই জন্ম নেয় মোহেনজোদড়ো ও সুরুজোদড়ো যুদ্ধ।

ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার জন মার্শাল, যিনি ১৯২০-এর দশকে সিন্ধু সভ্যতার উৎখনন কাজের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে মোহেনজোদড়োর ধ্বংসস্তূপে বহু কঙ্কাল পাওয়া গেছে। সেগুলোর ভঙ্গি দেখে মনে হয় তারা হঠাৎ আক্রমণের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছিল। মার্শালের মতে, এই আক্রমণ বাইরের কোনো জাতির হতে পারে, আবার এটি প্রতিবেশী নগরের সঙ্গেও যুক্ত থাকতে পারে। তিনি লিখেছিলেন, “সিন্ধু সভ্যতার অন্তিম পর্বে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের প্রমাণ পাওয়া যায়, যা হয়তো অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফল।” এই ব্যাখ্যা থেকেই ইতিহাসবিদরা ধারণা করেন, সুরুজোদড়ো নগরের সঙ্গে মোহেনজোদড়োর সংঘর্ষ হয়েছিল।

ভারতের আধুনিক প্রত্নতত্ত্ববিদ রাকেশ শর্মা বলেন, “মোহেনজোদড়ো ও সুরুজোদড়ো একই ভৌগোলিক অঞ্চলে দুটি শক্তিশালী নগররাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। দুটির মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা ও নদীভিত্তিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়া খুব স্বাভাবিক।” শর্মার মতে, নদীপথ নিয়ন্ত্রণ যে কোনো সভ্যতার জন্য ছিল টিকে থাকার মূল শর্ত। সিন্ধু নদীর তীরবর্তী বাণিজ্য ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি যে নগর নিয়ন্ত্রণ করতে পারত, সে-ই ছিল প্রভাবশালী। তাই এই দুই নগরের মধ্যে যুদ্ধ হওয়া ছিল ইতিহাসের অনিবার্য অংশ।

কিছু গবেষক আবার মনে করেন, এই সংঘর্ষ ছিল রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। মার্কিন প্রত্নতত্ত্ববিদ গ্রেগরি পোসেল লিখেছেন, “সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলো স্বশাসিত ছিল, কিন্তু মাঝে মাঝে প্রভাব বিস্তারের জন্য একে অপরের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ত। মোহেনজোদড়ো ও সুরুজোদড়োর যুদ্ধ সম্ভবত সেই প্রেক্ষাপটেই হয়েছিল।” পোসেলের মতে, এই ধরনের যুদ্ধ শুধু সামরিক কারণে নয়, বরং সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব কুক্ষিগত করার প্রবণতা থেকেও জন্ম নিতে পারে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো জলবায়ু পরিবর্তন। প্রত্নতত্ত্ববিদরা দেখেছেন যে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে সিন্ধু অঞ্চলে জলবায়ুতে বড় পরিবর্তন এসেছিল। নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছিল, কখনো খরা, কখনো অতিবৃষ্টির কারণে ফসল নষ্ট হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে নগরগুলোর মধ্যে খাদ্য ও সম্পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র হতে পারে। ফরাসি গবেষক অঁরি-পল ফ্রাঁসোয়া মন্তব্য করেন, “পরিবেশগত চাপ প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ ডেকে আনে। মোহেনজোদড়ো ও সুরুজোদড়োর যুদ্ধও হয়তো এই কারণেই হয়েছিল।”

তবে কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, এটিকে যুদ্ধ বলা পুরোপুরি সঠিক নাও হতে পারে। তাদের মতে, এটি হয়তো ছিল নগরগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ, বিদ্রোহ কিংবা সামাজিক অস্থিরতা। জার্মান গবেষক ইয়োহান কেলার বলেন, “আমরা যা যুদ্ধ বলে ধরে নিচ্ছি, তা হয়তো ছিল নগরবাসীর বিদ্রোহ অথবা ক্ষমতার পালাবদলের সময়ের সহিংসতা। ইতিহাসের ছায়ায় অনেক কিছুই অস্পষ্ট থেকে যায়।”

তবে যুদ্ধের চিহ্ন হিসেবে প্রত্নতাত্ত্বিকরা যে প্রমাণগুলো দেখান, তা উপেক্ষা করা যায় না। মোহেনজোদড়োর একটি এলাকায় ৪০টির বেশি কঙ্কাল একসঙ্গে পাওয়া গেছে। তাদের শরীরে অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পাশাপাশি নগরের প্রাচীর ও স্থাপনায় ধ্বংসের চিহ্নও স্পষ্ট। এগুলোই প্রমাণ করে যে হঠাৎ একসময় নগরে সহিংস আক্রমণ হয়েছিল। যদি বাইরের কোনো জাতি এই আক্রমণ চালিয়ে থাকে, তবে সুরুজোদড়োকে তার মিত্র বা সহযোগী হিসেবে দেখা যেতে পারে। আবার যদি অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, তবে সরাসরি মোহেনজোদড়ো ও সুরুজোদড়োর সংঘর্ষের কথাই উঠে আসে।

বাণিজ্য নিয়েও দুটি নগরের মধ্যে টানাপোড়েন ছিল বলে ধারণা করা হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া গেছে বিভিন্ন ধরণের মুদ্রা, পণ্য বিনিময়ের চিহ্ন এবং বিদেশি বাণিজ্যের প্রমাণ। সুরুজোদড়োতে মেলে মণি-মুক্তো, রত্ন ও ধাতব দ্রব্যের নিদর্শন, যা ইঙ্গিত করে তারা সমৃদ্ধ বাণিজ্য করত। অন্যদিকে মোহেনজোদড়োও ছিল বাণিজ্যকেন্দ্র। প্রতিযোগিতার এই প্রেক্ষাপটও যুদ্ধের অন্যতম কারণ হতে পারে।

আজকের দৃষ্টিতে আমরা যতই খুঁজি, ইতিহাসের এই অধ্যায় পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। প্রত্নতত্ত্বের সীমাবদ্ধতার কারণে নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব হয় না যুদ্ধটি ঠিক কেন হয়েছিল, কারা জিতেছিল, আর এর ফলাফল কী হয়েছিল। তবে একথা নিশ্চিত যে এই সংঘর্ষ সিন্ধু সভ্যতার পতনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সভ্যতার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, পরিবেশগত বিপর্যয় এবং বাইরের আক্রমণ মিলে একসময় এই মহান সভ্যতা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

আমরা যখন মোহেনজোদড়ো ও সুরুজোদড়োর যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তখন বুঝতে পারি মানুষের লোভ, ক্ষমতার লড়াই, সম্পদের দখল—এসবই সভ্যতার উত্থান-পতনের চালিকাশক্তি। আধুনিক যুগেও আমরা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে একই দৃশ্য দেখি। ইতিহাস তাই শুধু অতীতের গল্প নয়, বরং বর্তমানের প্রতিফলনও বটে।

আপনি চাইলে আমি এই ফিচারটি আরও বিস্তৃত করে ১৫০০+ শব্দে নিয়ে যেতে পারি, যেখানে যুদ্ধের সম্ভাব্য কারণগুলো আরও বিশদে আলাদা আলাদা অনুচ্ছেদে তুলে ধরা হবে এবং প্রতিটি গবেষকের মতামত আরও বিস্তারিতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কি আমি সেটি করে দেব?

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

ডাকসুর মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও জমার সময় বাড়ল

বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, এই নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহীরা মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) বিকেল ৫টা পর্যন্ত মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে পারবেন। মনোনয়ন ফরম জমা দিতে পারবেন বুধবার (২০ আগস্ট) বিকেল ৫টা পর্যন্ত।

১৯ ঘণ্টা আগে

ডাকসু নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হয়নি : ছাত্রদল

তিনি বলেন, ‘আজকে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সংসদ এবং কেন্দ্রীয় ডাকসুর মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের শেষ দিন। তারই ধারাবাহিকতায় ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের ছাত্রদলের কিছু শিক্ষার্থী এবং কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে যায় বিকাল সাড়ে ৩টার পরে। ঠিক সেই সময় ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের একদল উগ্র শ

২১ ঘণ্টা আগে

ডাকসু নির্বাচন— কোন প্যানেলে ভিপি-জিএস প্রার্থী কারা

এর বাইরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিচিতমুখ উমামা ফাতেমার নেতৃত্বে রয়েছে একটি স্বতন্ত্র প্যানেল। ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ’ স্লোগান নিয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদ সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা লড়বেন আরেকটি প্যানেল নিয়ে। রয়েছে আরও কিছু স্বতন্ত্র প্যানেল, যেগুলো এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

১ দিন আগে

শেষ দিনে ৪৪২-সহ ডাকসুর মনোনয়ন সংগ্রহ ৫৬৫ প্রার্থীর

ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক জসীম উদ্দিন বলেন, সপ্তম দিনে ডাকসুর বিভিন্ন পদে জন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছে ৪৪২ জন। এখন পর্যন্ত সাত দিনে ডাকসুতে মোট মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন ৫৬৫ জন এবং ১৮টি হল সংসদের জন্য মোট মনোনয়ন সংগ্রহ করেছে এক হাজার ২২৬ জন।

১ দিন আগে