top ad image
top ad image
home iconarrow iconফিচার

সাহিত্য

মনসামঙ্গল: বাংলার অমর প্রেমগাথা

মনসামঙ্গল: বাংলার অমর প্রেমগাথা
চ্যাটজিপিটির চোখে বেহুলা-লখীন্দার

বাংলার মাটির সঙ্গে মিশে আছে অসংখ্য লোককাহিনি, মিথ ও বিশ্বাস। তারই মাঝে বেহুলা-লখিন্দরের গল্প যেন এক চিরন্তন প্রেম, সাহস আর আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে আছে। এই কাহিনি শুধু একটি ভালোবাসার গল্প নয়, বরং বাংলার প্রাচীন সমাজ-সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং নারীর সাহসিকতার এক অনন্য দলিল। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের “মনসামঙ্গল” কাব্যে এই গল্পের সবচেয়ে বিখ্যাত বিবরণ পাওয়া যায়। বেহুলা ও লখিন্দরের নাম আজও বাংলার লোকমুখে অমর হয়ে আছে।

“মনসামঙ্গল” কাব্য বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন “মঙ্গলকাব্য” ধারার অন্যতম অংশ। এই ধারার প্রধান দুটি কাব্য চণ্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল হলেও মনসামঙ্গলকে ধরা হয় তুলনামূলকভাবে প্রাচীনতর। এই কাব্য মূলত দেবী মনসাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তিনি সাপের দেবী, আর বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি এই মনসার পূজা নিয়ে এক বিরাট দ্বন্দ্ব ও আত্মত্যাগের ইতিহাস।

এই কাহিনির মূল পুরুষ চরিত্র চাঁদ সওদাগর। তিনি ছিলেন চম্পকনগরের একজন বিত্তবান ব্যবসায়ী এবং শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি কখনোই মনসাকে দেবী হিসেবে স্বীকার করতে চাননি। কারণ, মনসাকে তিনি মনে করতেন অনার্য ও লৌকিক দেবী, যাকে আর্য সমাজ কখনো স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু মনসার ইচ্ছা ছিল, তাকে যেন মানুষ পূজা করে দেবী হিসেবে মেনে নেয়। সেই কারণেই চাঁদের সঙ্গে শুরু হয় মনসার বিরোধ।

এই বিরোধ থেকে জন্ম নেয় এক করুণ পরিণতি। মনসা চাঁদকে শাস্তি দিতে তার ছয় ছেলেকে বিষাক্ত সাপে কাটিয়ে মেরে ফেলে। এরপরেও চাঁদ মনসাকে পূজা করতে রাজি হন না। শেষ অবধি চাঁদের আর একমাত্র জীবিত পুত্র লখিন্দরের বিয়ের সময়ও মনসা বাধা দেন। বিয়ের রাতে লখিন্দরকে এক বিষধর সাপে কামড়ে হত্যা করে। তবে এখানেই গল্প শেষ হয় না।

গল্পের আসল নায়িকা হলেন বেহুলা — লখিন্দরের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। স্বামী মারা যাওয়ার পর কোনো নারীর যা করা সম্ভব নয়, বেহুলা তা করেছিলেন। তিনি স্বামীর মৃতদেহ ভেলায় ভাসিয়ে বহু দুর্দশা পেরিয়ে সরাসরি দেবতাদের দ্বারে গিয়ে হাজির হন। নানা বিপদের মুখোমুখি হয়ে, ঝড়-তুফান আর দৈত্য-দানবের সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে স্বর্গের দেবতাদের মন জিতে নেন। ইন্দ্রের সভায় নাচ প্রদর্শন করে তাদের সন্তুষ্ট করেন এবং তার বিনিময়ে স্বামীকে জীবিত করে ফিরিয়ে আনেন। শুধু তাই নয়, স্বামীসহ চাঁদ সওদাগরের ডুবে যাওয়া সমস্ত জাহাজ ও ধনসম্পদও ফিরে পান।

এই কাহিনির মাধ্যমে একদিকে যেমন নারীর সতীত্ব, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের নিদর্শন পাওয়া যায়, অন্যদিকে সমাজের ভেদাভেদ, ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং লৌকিক বিশ্বাসের সঙ্ঘর্ষও ফুটে ওঠে। মনসা যেমন একজন অনার্য দেবী থেকে স্বীকৃত হিন্দু দেবীতে পরিণত হন, তেমনি বেহুলা হয়ে ওঠেন নারীর সাহস ও ধৈর্যের প্রতীক।

মনসামঙ্গলের প্রধান দেবতা মনসা আসলে একটি লৌকিক বিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। প্রাচীন যুগে ভারতে আদিবাসী সমাজে সাপের পূজা করা হতো, যাতে বর্ষাকালে বিষধর সাপ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মনসা সেই সংস্কৃতির ধারক। পরবর্তীতে হিন্দু সমাজের ব্রাহ্মণ্যধর্মে তিনি জায়গা করে নেন। যদিও প্রাচীন পুরাণে মনসার নাম নেই, কিন্তু পরে ব্রহ্মবৈবর্ত ও দেবীভাগবত পুরাণে তার উল্লেখ পাওয়া যায়।

চাঁদ সওদাগর ও মনসার দ্বন্দ্ব যতই তীব্র হোক, শেষ পর্যন্ত চাঁদ যখন মনসার মাহাত্ম্য স্বীকার করে পূজা দেন, তখনই মনসা সত্যিকারের দেবী হিসেবে স্বীকৃতি পান। আর এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলেন সাহসিনী বেহুলা।

এই গল্পকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে অসংখ্য কাব্য। কানা হরিদত্ত, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, বিপ্রদাস পিপলাই, বিজয় গুপ্ত, দ্বিজ বংশীদাস প্রমুখ কবি মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণ নামে বিভিন্ন সংস্করণে এই কাহিনি লিখেছেন। দুই বাংলার নানা অঞ্চলে এ কাহিনির লোকমুখে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পাওয়া যায়।

লোককাহিনির চেয়ে বাস্তব ইতিহাস কতটা মিলে যায়, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বেশ কিছু ভৌগোলিক স্থান আজও “বেহুলা-লখিন্দরের স্মৃতি” বহন করে চলেছে। যেমন বাংলাদেশের বগুড়া জেলার গোকুল গ্রামে রয়েছে “লখিন্দরের মেধ” নামে একটি প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এটিকে বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর বলে মনে করা হয়। শত শত বছর ধরে এই স্থানটিকে ঘিরে নানা বিশ্বাস ও কাহিনি প্রচলিত আছে।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বিনসাড়া গ্রাম। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এখানেই ছিল বেহুলার পিত্রালয়। গ্রামের মানুষেরা আজও বিশ্বাস করে, এখানেই জন্মেছিলেন বেহুলা। এখানে এখনো দেখা যায় একটি পুরনো কুয়ো, যাকে বলা হয় “বেহুলার জিয়নকূপ”। অনেকেই মনে করেন, বেহুলা এই কূপের জলেই স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে এনেছিলেন। স্থানীয় মানুষেরা এখনও এই কূপকে পবিত্র মনে করে, এবং দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসে এই ঐতিহাসিক স্থান দেখতে।

আজকের আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে আমরা বেহুলার মতো সাহসিনী নারীর গল্প শুনে শুধু মুগ্ধ হই না, বরং তা থেকে শিক্ষা নিই। নারীর আত্মত্যাগ, ভালোবাসা ও আত্মসম্মান যে কতটা দৃঢ় হতে পারে, তা বেহুলার কাহিনিতে বারবার উঠে আসে। একই সঙ্গে মনসা দেবীর কাহিনিতে আমরা দেখি কীভাবে একটি লৌকিক বিশ্বাস ধীরে ধীরে সমাজের মূলধারায় জায়গা করে নেয়।

বেহুলা-লখিন্দরের এই গল্প শুধু একটি ধর্মীয় বা কাব্যিক গল্প নয় — এটি বাংলার ইতিহাস, সমাজ ও সংস্কৃতির জীবন্ত দলিল। এই কাহিনি মনে করিয়ে দেয়, বাংলার মাটি, নদী, লোকসংস্কৃতি আর মানুষের বিশ্বাস কতটা গভীর ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। কালের প্রবাহে বহু কিছু হারিয়ে গেলেও বেহুলা ও লখিন্দরের অমর প্রেম আজও বাংলার লোককাহিনির আকাশে জ্বলজ্বল করে।

r1 ad
top ad image