সাহিত্য
শার্লক হোমসের হারানো গল্প

২০১৫ সালের শীতকাল। স্কটল্যান্ডের এক ছোট শহর সেলকির্কে বসবাসকারী এক বৃদ্ধ লোক, ওয়াল্টার এলিয়ট, প্রতিদিনের মতোই সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ঘরের কাজকর্মে হাত দিলেন। বয়স আশির কোঠায়, কিন্তু শরীরে এখনো কিছুটা বল আছে। পেশায় তিনি কাঠুরে ছিলেন, অবসরের পর এখন সময় কাটান বই পড়ে আর পুরনো ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে।
সেই দিনটা একটু আলাদা ছিল, কারণ ওয়াল্টার ঠিক করেছিলেন বাড়ির চিলেকোঠা পরিষ্কার করবেন। বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা পুরনো কাগজপত্র, বইপত্র, ম্যাগাজিন—সব মিলিয়ে যেন এক ইতিহাসের জঙ্গল। এসব ঘাঁটতে ঘাঁটতেই একটা ধুলো জমা বইয়ের দিকে নজর গেল তার। পুরনো খয়েরি মলাট, ছেঁড়া-ফাটা প্রায়, কিন্তু তবুও তার চোখে পড়ল বইটির শিরোনাম—"দ্য বুক ও' দ্য ব্রিগ"।
৪৮ পাতার পাতলা এক পুস্তিকা। বই বলা ঠিক হবে না। বইটা যে কীভাবে তার কাছে এল, সেটা এলিয়টের মনেই পড়ে না। হয়তো কোনো বন্ধুর কাছ থেকে নিয়েছিলেন, হয়তো পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কিনেছিলেন—কে জানে। কৌতূহলবশে পাতা উল্টাতে লাগলেন তিনি। হঠাৎ একটা পাতায় এসে তার চোখ আটকে গেল। লেখা আছে—"শার্লক হোমস"। নিচে গল্পের নাম: "ডিসকভারিং দ্য বর্ডার বার্গস, অ্যান্ড, বাই ডিডাকশন, দ্য ব্রিগ বাজার"।
তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। শার্লক হোমস—বিশ্বখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র, যিনি সাধারণ মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে চলা তথ্য থেকে অসাধারণ বিশ্লেষণ করে সত্য বের করে আনেন। আর সেই শার্লকের নাম যে তার নিজের শহরের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে, সেটা তো তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।
গল্পটা মাত্র তিন পৃষ্ঠার। তবুও তাতে শার্লক হোমস আর ডা. ওয়াটসনের পরিচিত আলাপচারিতা আছে। গল্পে শার্লক হোমস বলে দেয়, ওয়াটসন সেলকির্কে যাচ্ছেন ব্রিজ মেরামতের কাজে, অথচ ওয়াটসন নিজে সেটা বলেননি। এ যেন একদম সেই পুরনো শার্লকের ভঙ্গিতে লেখা!
এতদিন এই লেখাটির কথা কেউ জানে না, কোনো শার্লক হোমস সংকলনে এর উল্লেখ নেই। সবচেয়ে অবাক করার মতো ব্যাপার হলো—যে সময়ের কথা গল্পে বলা হয়েছে, সেই সময় স্কটল্যান্ডের সেলকির্ক শহরে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল নিজেই উপস্থিত ছিলেন।
এলিয়ট আরেকটু গভীরে গিয়ে দেখলেন—পুস্তিকাটি ১৯০৩ সালে ছাপা হয়েছিল, প্রকাশক ছিল জর্জ লুইস এন্ড কো। তাহলে বইটা একশোরও বেশি বছরের পুরনো! বইটির উৎপত্তি খুঁজতে গিয়ে তিনি জানতে পারলেন ১৯০২ সালে সেলকির্ক শহরে ভয়াবহ এক বন্যা হয়েছিল। শহরের কাঠের ব্রিজ ভেঙে পড়ে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নতুন ব্রিজ বানাতে টাকা দরকার ছিল, আর সেই টাকা তোলার জন্যই আয়োজন করা হয় তিনদিনব্যাপী এক বিশেষ বাজার—“বর্ডার বার্গস বাজার”।
বাজারে তহবিল সংগ্রহের জন্যই "দ্য বুক ও’ দ্য ব্রিগ" পুস্তিকাটি তৈরি করা হয়েছিল। স্যার আর্থার কোনান ডয়েল সেই বাজারে উপস্থিত ছিলেন এবং শেষ দিনের উদ্বোধকও ছিলেন তিনি। এমনকি একটি দিন তিনি শহরের একটি হলে নিজের লেখা পড়ে শোনান এবং বলেছিলেন, তার পাঠ থেকে যা আয় হবে তা ব্রিজ তৈরির তহবিলে দান করা হবে।
এত প্রমাণ থাকার পরও লেখাটি কোনান ডয়েল নিজে লিখেছেন কিনা—তা নিয়ে তৈরি হয়েছে রহস্য। বইয়ের কোথাও লেখকের নাম নেই। ডয়েলের মতো একজন খ্যাতিমান লেখক যদি লেখেন, তাহলে নাম না থাকা কেন? আবার বইয়ের ধরণ, ভাষা, ভঙ্গি—সব কিছুতেই ডয়েলের পরিচিত ছায়া নেই বলে কিছু বিশেষজ্ঞ সন্দেহ প্রকাশ করেন।
কিন্তু ঘটনা আবার মোড় নেয় নতুন দিকে। সেলকির্কের এক নারী, জিন, সামনে আনলেন একই বইয়ের আরেকটি কপি, যার মলাটে রয়েছে স্বয়ং স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের স্বাক্ষর!
তা হলে কি তিনিই সত্যি লেখক?
এর আগে পঞ্চাশের দশকে ডয়েলের কাগজপত্রের ভেতর থেকে আরেকটি হারানো লেখা পাওয়া গিয়েছিল—“দ্য ম্যান হু ওয়াজ ওয়ান্টেড”। তখন সেটাকেও শার্লকের হারানো গল্প মনে করা হয়। পরে জানা যায়, সেটি আরেকজন লেখক আর্থার হুইটেকারের লেখা, যিনি ডয়েলকে তার লেখা পাঠিয়েছিলেন মতামত চাওয়ার জন্য।
এইসব মিলিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেননি, “দ্য বুক ও’ দ্য ব্রিগ” -এ থাকা তিন পাতার শার্লক হোমসের গল্পটা আদতে ডয়েলের লেখা কি না। আবার এটাও নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, এটা কোনো ছদ্মনামধারী লেখকের কাজ।
আসলে গল্পটা যতটা না শার্লকের, তার চেয়েও বেশি মনে হয় নিজেই এক রহস্যে ঘেরা কাহিনি। এক শতাব্দীর বেশি সময় আগের একটি দুর্লভ বই, এক লুকানো লেখার খোঁজ, এক নামহীন লেখকের অদ্ভুত সৃষ্টি—সব মিলে যেন সত্যিকারের শার্লক হোমসের গল্পকেও হার মানায়।
হয়তো একদিন ভবিষ্যতের কোনো সাহসী গবেষক বা একেবারে শার্লক হোমসের মতো তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন কেউ এই রহস্যের জট খুলে দিতে পারবে। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত, এই লেখাটি হয়ে থাকবে একটি প্রাচীন, ধুলোমাখা, কিন্তু গভীরভাবে কৌতূহলোদ্দীপক রহস্যর গল্প—যার মূলে রয়েছে সেই প্রিয় চরিত্র, শার্লক হোমস।