সাহিত্য

পল্লীবর্ষা কবিতায় গ্রামবাংলার দৃশ্যকল্প

অরুণাভ বিশ্বাস
আপডেট : ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৭: ৪৯
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

বর্ষা আমাদের হৃদয়ে অন্য রকম এক আবেগের তৈরি করে। আকাশের কান্না, মাটির গন্ধ, মাঠের জলজ উৎসব, আর মানুষের অন্তরে জেগে ওঠা এক অনির্বচনীয় ভালোবাসা—সব মিলিয়ে বর্ষা যেন জীবনের এক আবশ্যিক অনুষঙ্গ। আর এই বর্ষাকেই যিনি কবিতায় প্রাণ দিয়ে তুলির মতো এঁকেছেন, তিনি কবি জসীমউদ্দীন। তাঁর 'পল্লীবর্ষা' কবিতা যেন শুধু প্রকৃতির নয়, বরং এক একটি মানুষের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। এই কবিতায় বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে বর্ষার এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে, যা পাঠককে নস্টালজিয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

জসীমউদ্দীন ছিলেন গ্রামবাংলার প্রকৃত কবি। তিনি গ্রামের মানুষ যেমন দেখেছেন, তাঁদের মনের ভেতরটায় পর্যন্ত ঢুকে গিয়ে দৃশ্যকল্প এঁকেছেন তাঁরা কবিতার ছত্রে ছত্রে। ‘পল্লীবর্ষা’ কবিতায় তিনি বর্ষার ছবি এঁকেছেন, তা নিছক প্রকৃতির বর্ণনা নয়, বরং তার ভেতরে আছে জীবন, আবেগ, কষ্ট, আনন্দ, আতঙ্ক, প্রেম ও নিঃসঙ্গতা। এই কারণে এই কবিতা শুধু বর্ষার কবিতা নয়, এটি বাংলা সংস্কৃতির একটি চিরন্তন দলিল।

এই কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়, যেন আমরা একটি সিনেমার দৃশ্যের মধ্যে ঢুকে গেছি। ‘আজিকার রোদ ঘুমায়ে পড়িছে ঘোলাটে মেঘের আড়ে’—এই প্রথম লাইনেই এক রহস্যময় আবহ তৈরি হয়। বর্ষার ঘোলাটে মেঘ যেন দিনের আলোকে ঢেকে দিয়ে এক ঘুমপাড়ানি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। পাঠক সেই সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়ে এক নিঃসঙ্গ, নিঃশব্দ, অথচ অন্তর্গত আবেগে ভরা গ্রামীণ জগতে।

এই কবিতার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর চিত্রকল্প। প্রতিটি চরণ যেন জলরঙে আঁকা একটি করে ছবি। কবি শুধু বলছেন না—দেখাচ্ছেন। যেমন:

"বাদলের জলে নাহিয়া সে-মেয়ে হেসে কুটি কুটি হয়,
সে হাসি তাহার অধর নিঙাড়ি লুটাইছে বনময়।"

এখানে একটি তরুণীর হাসি এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, যেন সেই হাসি তার ঠোঁট ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বনের বুকে। এটি নিছক রোমান্টিক নয়—এটি বর্ষার প্রাণবন্ত রূপের প্রতীক।

আবার,

"চিঠির ওপরে চিঠি ভেসে যায় জনহীন বন-বাটে,
না জানি তাহারা ভিড়িবে যাইয়া কার কেয়া-বন-ঘাটে!"

এখানে বর্ষার জলে ভেসে যাওয়া কল্পিত চিঠিগুলো যেন ভালোবাসার দূত, যাদের গন্তব্য অজানা, কিন্তু আশায় ভরপুর। এই রূপক কল্পনা কবিতাটিকে বাস্তবের বাইরেও এক অলীক রোমান্সে তুলে এনেছে।

কবিতাটির দ্বিতীয় অংশে আমরা দেখি একেবারে গ্রামীণ চিত্র—চাষিদের দল, হুঁকার ধোঁয়া, কাঠের কাজ, লাঠিতে ফুল আঁকা, গল্পে ভরে ওঠা দলিজা। অথচ এই অংশটি একঘেয়ে নয়, বরং বর্ষার পটভূমিতে তা হয়ে ওঠে প্রাণময়।

"গাঁয়ের চাষিরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়,
গল্পে গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!"

বর্ষার দিনে যখন মাঠে কাজের সুযোগ নেই, তখন মানুষ বসে গল্প করে, গান করে, স্মৃতি ও আশায় বাঁচে। এই চিত্র একদিকে বাস্তব, অন্যদিকে অনন্য কল্পনা ও সৃষ্টিশীলতার উদাহরণ।

এই কবিতায় প্রকৃতি একাই প্রধান চরিত্র নয়—মানুষ, বিশেষত নারীদের অবস্থানও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কবি বলেছেন:

"বউদের আজ কোনো কাজ নাই, বেড়ায় বাঁধিয়া রশি,
সমুদ্রকলি শিকা বানাইয়া নীরবে দেখিছে বসি।"

নারীদের অবসর, তাদের চিন্তা, কিংবা হয়তো কারো স্মৃতিময় অপেক্ষা—সবই মিশে গেছে বর্ষার পটভূমিতে। তারা হয়তো কারো জন্য পথ চেয়ে আছে, হয়তো কারো কথা মনে পড়েছে। তাদের সেই মৌন উপস্থিতি কবিতাটিকে দেয় এক অতল আবেগ।

‘পল্লীবর্ষা’ শুধু একটি বর্ষার কবিতা নয়—এটি সময়, স্মৃতি, কল্পনা ও রূপান্তরের কবিতা। এটি যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, বর্ষা শুধু ভেজা পথ বা মেঘের গর্জন নয়, বরং তা এক ধরনের নিঃসঙ্গতা, প্রেম, অবসর, অপেক্ষা এবং শৈল্পিকতা।

জসীমউদ্দীন এই কবিতায় তাঁর চেনা সহজ-সরল ভাষা রেখে এমন এক মাধুর্য সৃষ্টি করেছেন, যা আধুনিক কবিতার কাব্যশৈলীকেও ছুঁয়ে যায়। এবং সবচেয়ে বড় কথা, এই কবিতা আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় এক সময়হীন গ্রামে—যেখানে বর্ষা মানে শুধু বৃষ্টি নয়, বরং জীবনের আরেক নাম।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

ফারুকীর অ্যাপেনডিক্সের অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন: তিশা

কক্সবাজার সফরে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। পরে রাতে তাকে একটি হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। গতকাল রোববার (১৭ আগস্ট) এই উপদেষ্টার অ্যাপেনডিক্সের অপারেশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশা।

১৯ ঘণ্টা আগে

বদহজম দূর করার উপায়

এক গ্লাস হালকা গরম পানি খেলে বদহজমের সমস্যা অনেকটাই কমে যায়। পানি খাবার হজমে সাহায্য করে এবং পেটের ভেতরে জমে থাকা অতিরিক্ত এসিডকে পাতলা করে দেয়।

২০ ঘণ্টা আগে

সাপ কেন আঁকাবাঁকা হয়ে পথ চলে?

সাপের মেরুদণ্ডে অসংখ্য হাড় আর পেশী আছে। এই হাড় ও পেশীর সাহায্যে তারা শরীর বাঁকায়, সঙ্কুচিত করে আবার প্রসারিত করে। একেকটা অংশ মাটিতে ধাক্কা দেয়, আর নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী মাটিও পাল্টা চাপ দিয়ে সাপকে সামনে এগিয়ে দেয়।

২ দিন আগে

গণতন্ত্রের গলদ

গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র জনগণই ক্ষমতার উৎস। সেটা আজকাল কেউ মানে বলে মনে হয় না। সে বাংলাদেশেই হোক বা যুক্তরাষ্ট্র—ক্ষমতাসীন নেতাদের সবাই নিজেদের সর্বেসর্বা মনে করে। গণতন্ত্রের অন্যতম পুরোধা সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় বলেছিলেন, ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য

২ দিন আগে