ইতিহাস
বক্সারের যুদ্ধ: ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিরঙ্কুশ শাসন নিরঙ্কুশ হয়

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের সূচনা হয়। কিন্তু তার আট বছরের মাথায় ঘটে আরেকটি বড় যুদ্ধ—বক্সারের যুদ্ধ। ১৭৬৪ সালের ২২ অক্টোবর বিহারের বক্সার নামক স্থানে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। অনেকেই একে ব্রিটিশদের ভারত জয়ের প্রকৃত সূচনা বলে মনে করেন। এই যুদ্ধে একদিকে ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং অন্যদিকে ছিল তিনটি শক্তিশালী ভারতীয় পক্ষ—বিহারের নবাব মীর কাশিম, বাংলার মুঘল সম্রাট শাহ আলম দ্বিতীয় এবং অউধের নবাব শুজাউদ্দৌলা। এই তিনজন মিলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একটি সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাস্তবে এই প্রতিরোধ সফল হয়নি।
বক্সারের যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাদের নেতৃত্বে ছিলেন হেক্টর মুনরো। তিনি কোম্পানির অভিজ্ঞ ও কৌশলী এক সামরিক কর্মকর্তা। যুদ্ধের আগে থেকেই কোম্পানির মধ্যে মীর কাশিমের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মীর কাশিম চেয়েছিলেন নিজের স্বাধীনতা বজায় রাখতে, কিন্তু ব্রিটিশরা তাকে একটি পুতুল নবাব বানিয়ে রাখতে চেয়েছিল। তাই তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং শাহ আলম ও শুজাউদ্দৌলাকে নিয়ে একটি জোট গঠন করেন। তাদের মিলিত সেনা সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ হাজার, আর কোম্পানির পক্ষে ছিল প্রায় ৭ হাজার সেনা। কিন্তু আধুনিক অস্ত্র, সংগঠন এবং সামরিক কৌশলের দিক দিয়ে কোম্পানি ছিল অনেক এগিয়ে।
বক্সারের যুদ্ধে কোম্পানির জয় কেবল একটি যুদ্ধ জয়ের ঘটনা ছিল না, বরং এটি একটি যুগান্তকারী রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা করে। এই যুদ্ধের পর মুঘল সম্রাট শাহ আলম কোম্পানির সঙ্গে এক চুক্তি করতে বাধ্য হন, যার ফলে বাংলার দেওয়ানি—অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের অধিকার—কোম্পানির হাতে চলে যায়। একে অনেকেই বলেন, ব্রিটিশ শাসনের প্রাতিষ্ঠানিক সূচনা। ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল বলেন, “বক্সারের যুদ্ধের পর থেকেই কোম্পানি একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে পরিণত হয় এক দুর্ধর্ষ রাজনৈতিক শক্তিতে।” তাঁর মতে, এই যুদ্ধ ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামো পাল্টে দেওয়ার সূচনা করে।
এই যুদ্ধ নিয়ে মতামত দিয়েছেন আরেকজন বিদেশি গবেষক—যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসবিদ পিটার মার্শাল। তাঁর মতে, “পলাশীর যুদ্ধ কোম্পানিকে ক্ষমতার দ্বারে পৌঁছে দেয়, কিন্তু বক্সারের যুদ্ধ সেই দরজাটিই খুলে দেয়।” তাঁর পর্যবেক্ষণ বলছে, এই যুদ্ধে জয় পেয়ে কোম্পানি কেবল বাংলার নয়, পুরো উত্তর ভারতের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো নিজের নিয়ন্ত্রণে আনে।
এই যুদ্ধের একটি বড় শিক্ষা হলো—বাংলার শাসকগণ, বিশেষত মীর কাশিম, শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলের কাছে হার মানেন। মীর কাশিম চেয়েছিলেন স্বাধীনতা, চেয়েছিলেন রাজস্ব ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে। তিনি ইউরোপীয়দের মতো একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন, সেনাদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। কিন্তু যেভাবে কোম্পানি কূটনীতি ও ঘুষের মাধ্যমে তার জোট ভাঙতে সক্ষম হয়, তা একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়, ব্রিটিশরা কীভাবে ভারতীয় শাসকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে শাসন প্রতিষ্ঠা করে।
শুধু সামরিক পরাজয় নয়, বক্সারের যুদ্ধ ভারতীয় সমাজের আর্থ-রাজনৈতিক ভিত নড়িয়ে দেয়। যুদ্ধের পর ব্রিটিশরা ভারতের কৃষি ও রাজস্ব ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ শুরু করে। তারা নতুন নতুন কর আরোপ করে, যেগুলোর প্রভাব পড়ে সাধারণ কৃষকের ওপর। ফরাসি ইতিহাসবিদ ক্লদ মার্কোঁ এক জায়গায় লিখেছেন, “বক্সারের যুদ্ধের পর ভারতীয় কৃষকের কাঁধে যে করের বোঝা চেপে বসে, তা ব্রিটিশ শাসনের পুরো সময়জুড়ে থেকে যায়।”
বক্সারের যুদ্ধ শুধু ইতিহাসের পাতায় লেখা একদিনের ঘটনা নয়। এটি ছিল এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে একটি বিদেশি কোম্পানি ধীরে ধীরে পরিণত হয় একটি সাম্রাজ্যে। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, কেবল সেনাবাহিনী থাকলেই চলবে না—দরকার কূটনৈতিক চতুরতা, সংগঠিত প্রশাসন এবং মানুষের আস্থা। আর এ দিক দিয়েই ব্রিটিশরা এগিয়ে ছিল।
অনেকেই ভাবতে পারেন, মীর কাশিম, শাহ আলম বা শুজাউদ্দৌলা যদি আরও সংগঠিত হতেন, তাহলে ইতিহাসের গতি কি অন্যরকম হতে পারত? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা হয়তো কোনোদিনই জানতে পারব না। কিন্তু এটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বক্সারের যুদ্ধের পর ভারতের রাজনীতি আর কখনো আগের মতো থাকেনি।
আজকের ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাস বুঝতে গেলে বক্সারের যুদ্ধকে বাদ দিয়ে কোনো আলোচনা সম্ভব নয়। এই যুদ্ধ কেবল একটি রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল ছিল না, এটি ছিল একটি যুগের পতন এবং অন্য এক যুগের সূচনা।
বক্সারের যুদ্ধ থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। রাজনৈতিক ঐক্য, স্বার্থের সংঘাত, কূটনীতি—সবই ছিল এর পেছনে। এবং সব শেষে, এই যুদ্ধ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন একটি জাতি বিভক্ত হয়ে পড়ে, তখন বাইরের শক্তির কাছে পরাজিত হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাই ইতিহাস জানাও প্রয়োজন, আর ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়াও।
এই হলো বক্সারের যুদ্ধের সহজ, সরল কিন্তু গভীর এক চিত্র। ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আজও আমাদের শেখায়, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা ধরে রাখা অনেক বেশি কঠিন।
সূত্র: হিস্ট্রি ডট কম