অপারেশন সিঁদুর ভারতের সেনাশক্তিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে: মোদি

কলকাতা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৫, ০১: ৪৬
সোমবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে বিরতির পর এই প্রথম ভাষণ দিলেন তিনি। ছবি: পিটিআই

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক অভিযান ‘অপারেশন সিঁদুর’ ভারতের সেনাশক্তিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

তিনি বলেন, ভারত অতীতেও যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করেছে। মরুভূমি হোক বা পাহাড়— ভারতের সেনারা সব জায়গায় দক্ষ। পাশাপাশি, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যুদ্ধেও ভারত দক্ষতা দেখিয়েছে। এই অপারেশনের সময় ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ প্রতিরক্ষা সামগ্রীর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। এখন গোটা বিশ্ব দেখছে, ভারতের তৈরি অস্ত্র ও প্রযুক্তি একবিংশ শতাব্দীর যুদ্ধক্ষেত্রে বড় শক্তি হয়ে উঠেছে।

সোমবার (১২ মে) ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সম্প্রতি অস্ত্রবিরতির মাধ্যমে শেষ হওয়া ভারত-পাকিস্তান সংঘাত এবং ভারতের অপারেশন সিঁদুর পরিচালনার পর এই প্রথম জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন তিনি।

ভারতে নরেন্দ্র মোদি তার দেশের ‘দুর্দান্ত’ সশস্ত্র বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও বিজ্ঞানীদের প্রতি প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের পক্ষ থেকে স্যালুট জানান। অপারেশন সিঁদুরের লক্ষ্য পূরণে ভারতীয় সৈনিকদের অটল সাহস, বীরত্ব, সহনশীলতা ও অপরাজেয় মনোভাবকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তাদের এই বীরত্বকে দেশের প্রতিটি মা, বোন ও কন্যার প্রতি উৎসর্গ করেন।

গত ২২ এপ্রিল ভারতশাসিত কাশ্মিরের পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ২৬ পর্যটক নিহত হন। এ হামলাই মূলত ভারত-পাকিস্তান সংঘাতকে উসকে দেয়।

এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে মোদি বলেন, এ ঘটনা শুধু জাতিকে নয়, গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। তিনি একে জঘন্য সন্ত্রাসের নিদর্শন হিসেবেও বর্ণনা করেন। বলেন, পুরো জাতি— প্রত্যেক নাগরিক, প্রতিটি সম্প্রদায়, সমাজের প্রতিটি অংশ ও প্রতিটি রাজনৈতিক দল— সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের দাবিতে একত্রিত হয়েছে।

ভারত সরকার সশস্ত্র বাহিনীকে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে বলে জানান মোদি। অপারেশন সিঁদুরকে লাখ লাখ ভারতীয়ের ‘আবেগের প্রতিফলন’ ও ‘ন্যায়বিচারের প্রতি অটল অঙ্গীকার’ বলে উল্লেখ করেন।

‘পাকিস্তানিদের মনোবল ভেঙে পড়েছিল’

প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানে সন্ত্রাসীদের আস্তানা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে সুনির্দিষ্ট হামলা চালিয়েছে, যা একটি চূড়ান্ত আঘাত। সন্ত্রাসীরা কখনো কল্পনাও করেনি যে ভারত এত সাহসী পদক্ষেপ নেবে। পাকিস্তানে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটিতে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা কেবল তাদের অবকাঠামোই নয়, তাদের মনোবলও ভেঙে দিয়েছে। অভিযানে শতাধিক বিপজ্জনক সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকে কয়েক দশক ধরে ভারতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ষড়যন্ত্র করে আসছিল।

নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারতের সুনির্দিষ্ট ও শক্তিশালী হামলায় পাকিস্তান গভীর হতাশায় ডুবে গিয়ে চরম ভীত ও মরিয়া অবস্থায় পৌঁছে যায়। সেই উত্তেজনার মুহূর্তে পাকিস্তান বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার পরিবর্তে বেপরোয়া আচরণ করে—ভারতের স্কুল, কলেজ, গুরুদ্বারা, মন্দির ও সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি লক্ষ্য করে হামলা চালায়, পাশাপাশি সামরিক ঘাঁটিও টার্গেট করে। এই আগ্রাসন পাকিস্তানের দুর্বলতা প্রকাশ করেছে, কারণ তাদের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ভারতের উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সামনে খড়কুটোর মতো ভেঙে পড়ে।

হামলার মাধ্যমে পাকিস্তানের কী কী ক্ষয়ক্ষতি করা হয়েছে তা তুলে ধরে মোদি বলেন, পাকিস্তান যখন ভারতের সীমান্তে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ভারত পাকিস্তানের মূল কেন্দ্রে জোরালো আঘাত হানে। ভারতীয় ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র অত্যন্ত নির্ভুল হামলা চালায়, পাকিস্তানের বিমান ঘাঁটিগুলোর মারাত্মক ক্ষতি করে, যেগুলো নিয়ে তারা দীর্ঘদিন ধরে গর্ব করত।

‘মুক্তির জন্য পাকিস্তান বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন জানায়’

মোদি আরও বলেন, ভারতের প্রতিক্রিয়ার প্রথম তিন দিনের মধ্যেই পাকিস্তান তাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসের শিকার হয়। ভারতের আগ্রাসী পালটা ব্যবস্থার পরে পাকিস্তান উত্তেজনা হ্রাস করার উপায় খুঁজতে শুরু করে, ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা থেকে মুক্তির জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন জানায়।

পাকিস্তানের পক্ষ থেকেই সংঘাত বন্ধের জন্য যোগাযোগ করা হয় জানিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, গুরুতর ক্ষতির শিকার হওয়ার পরে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ১০ মে বিকেলে ভারতের ডিজিএমওর (ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশন) সঙ্গে যোগাযোগ করে। ততক্ষণে ভারত বৃহৎ আকারের সন্ত্রাসী অবকাঠামো ভেঙে দিয়েছে, মূল জঙ্গিদের নির্মূল করেছে এবং পাকিস্তানের সন্ত্রাস কেন্দ্রগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে।

‘অপারেশন সিঁদুর ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের স্থায়ী নীতি’

দুই দেশের মধ্যে অস্ত্রবিরতি স্থায়ী কিছু নয় উল্লেখ করে ভাষণে নরেন্দ্র মোদি বলেন, পাকিস্তান তাদের বার্তায় আশ্বাস দিয়েছে যে তারা ভারতবিরোধী সমস্ত সন্ত্রাসী তৎপরতা ও সামরিক আগ্রাসন বন্ধ রাখবে। এই বিবৃতির আলোকে ভারত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী ও সামরিক স্থাপনার বিরুদ্ধে তার পালটা অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়।

‘তবে এই স্থগিতাদেশ কোনো চূড়ান্ত সমাপ্তি নয়। পাকিস্তানের প্রতিটি পদক্ষেপ ভারত পর্যবেক্ষণ করবে এবং নিশ্চিত করবে যে পাকিস্তান তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করছে,’— বলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

তিনি আরও বলেন, অপারেশন সিঁদুর এখন ভারতের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের একটি স্থায়ী নীতি হয়ে উঠেছে, যা ভারতের কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে বড় পরিবর্তন এনেছে। এই অপারেশন ভারতের প্রতিরক্ষা নীতি ও সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

‘ভারত পারমাণবিক হুমকিকে ভয় পায় না’

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ভারতের নিরাপত্তা নীতির তিনটি প্রধান স্তম্ভের কথা তুলে ধরেন নরেন্দ্র মোদি— দৃঢ় প্রতিশোধ, যার অধীনে ভারতের ওপর কোনো সন্ত্রাসী হামলা হলে তার জবাব কড়া ও শক্তভাবে দেওয়া হবে; পারমাণবিক হুমকিকে কোনো গুরুত্ব নয়, অর্থাৎ ভারত কোনো পারমাণবিক হুমকিকে ভয় পায় না; এবং সন্ত্রাসবাদী ও তাদের আশ্রয়দাতা সরকার দুই-ই এক, যার অধীনে সন্ত্রাসবাদী ও তাদের আশ্রয়দাতাদের আর আলাদা করে দেখা হবে না।

নরেন্দ্র মোদি বলেন, অপারেশন সিঁদুরের সময় বিশ্ব আবারও দেখেছে পাকিস্তানের আসল চেহারা, সেখানে উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তারা নিহত সন্ত্রাসীদের জানাজায় অংশ নিয়েছেন, যা রাষ্ট্রের মদতপুষ্ট সন্ত্রাসে পাকিস্তানের গভীরভাবে জড়িত থাকাকে প্রমাণ করে।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা ঘোষণা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্য ভারতের সবচেয়ে বড় শক্তি। এই যুগ যুদ্ধের যুগ নয়, তবে এটি সন্ত্রাসবাদেরও যুগ হতে পারে না। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতাই একটি উন্নত বিশ্বের নিশ্চয়তা প্রদান করে।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে অপ্রত্যাশিত বিজয়ী চীন?

কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনেকে কেন্দ্র করে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চার দিনব্যাপী সামরিক সংঘর্ষ যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শেষ হলেও দুই দেশই নিজেদের বিজয়ী বলে দাবি করছে। তবে এ সংঘাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে চীন। এতে অপ্রত্যাশিত বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীনের প্রতিরক্ষা শিল্প। ভারত-পাকিস্তা

১৯ ঘণ্টা আগে

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি যুক্তরাজ্য-কানাডা-ফ্রান্সের

যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং কানাডা ইসরায়েলকে সতর্ক করে বলেছে, ফিলিস্তিনে অবরুদ্ধ ও বিধ্বস্ত গাজায় নতুন করে শুরু করা সামরিক আগ্রাসন বন্ধ না করলে এবং ত্রাণ প্রবেশে বিধিনিষেধ তুলে না নিলে ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে প্রভাবশালী এই তিন দেশ। খবর রয়টার্সের।

২১ ঘণ্টা আগে

দ্রুত যুদ্ধবিরতির আলোচনা শুরু করবে রাশিয়া-ইউক্রেন: ট্রাম্প

রাশিয়া এবং ইউক্রেন অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির জন্য আলোচনা শুরু করবে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সোমবার (১৯ মে) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে ফোনে কথা বলার পর এ কথা জানান ট্রাম্প। তবে ক্রেমলিন জানিয়েছে, প্রক্রিয়াটিতে একটু সময় লাগতে পারে।

১ দিন আগে

গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আরও ৩৮ ফিলিস্তিনির প্রাণহানি

ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিনের গাজায় কমপক্ষে আরও ৩৮ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। হামলার জেরে নিহতের মোট সংখ্যা প্রায় ৫৩ হাজার ৫০০ জনে পৌঁছেছে। গত ১৮ মার্চ গাজায় নতুন করে ইসরায়েলি হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ৩৩৫০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার পৃথকভাবে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা ও বার্তাসং

১ দিন আগে