রাজনীতি

হরমুজ প্রণালী ইরানের কৌশলগত অস্ত্র

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৫, ১৫: ৩৯

বিশ্ব মানচিত্রে হরমুজ প্রণালী একটি সরু জলপথ, কিন্তু এর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বিশাল। এটি পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগর ও ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। এই প্রণালী দিয়েই বিশ্বের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ জ্বালানি তেল রপ্তানি হয়। তাই বলাই যায়, হরমুজ প্রণালী হচ্ছে বৈশ্বিক জ্বালানির শিরা-উপশিরা। আর এ কারণেই, ইরান বহু বছর ধরে এটিকে একটি ‘রাজনৈতিক অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করছে।

হরমুজ প্রণালীর ইতিহাস বহু পুরনো। প্রাচীনকালে এটি ছিল মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধু সভ্যতার মধ্যে বাণিজ্যপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে এর গুরুত্ব বেড়ে যায় ১৯৩০-এর দশকে, যখন মধ্যপ্রাচ্যে বিশাল তেল মজুত আবিষ্কৃত হয়। তখন থেকেই এই অঞ্চলের উপর আন্তর্জাতিক নজরদারি শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রণালীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, নিজেদের সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে থাকে।

ইরান এই প্রণালীর উত্তর তীরে অবস্থিত। এর দক্ষিণ তীরে রয়েছে ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। হরমুজ প্রণালীর সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ মাত্র ২১ মাইল প্রশস্ত, যার মধ্যে দুটো পৃথক শিপিং লেন রয়েছে—একটি তেল রপ্তানির জন্য, অন্যটি খালি ট্যাঙ্কার ফেরত যাওয়ার জন্য। এই নিয়ন্ত্রণ এবং ভৌগোলিক অবস্থান ইরানকে দিয়েছে এক ধরনের ক্ষমতা, যাকে কূটনীতিকরা বলেন “choke point advantage”। এর মানে হলো, ইরান চাইলে এই প্রণালী বন্ধ করে দিয়ে বৈশ্বিক তেল সরবরাহে ভয়ানক ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ‘চোক পয়েন্ট’ ইরানের এক ধরনের "ডিটারেন্স অস্ত্র"। লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকসের আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক ড. জেনি ক্লার্ক বলেন, “ইরান জানে, সামরিক দিক দিয়ে হয়তো সে পশ্চিমা জোটের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না। কিন্তু হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার হুমকি দিয়ে সে কূটনৈতিকভাবে একটি বড় কার্ড খেলতে পারে।” (‘Iran and the Strait of Hormuz’, LSE Journal of Strategic Studies, 2022)

ইরান ১৯৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলাকালে হরমুজ প্রণালীর কৌশলগত ব্যবহার শুরু করে। তখন একে একে দু’পক্ষই তেল ট্যাঙ্কার হামলার মাধ্যমে বিশ্ববাজারে চাপ সৃষ্টি করে। একে বলা হয়েছিল “ট্যাঙ্কার যুদ্ধ”। এই সময়েই যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো বড় আকারে নৌবাহিনী মোতায়েন করে এই অঞ্চলে।

এরপর থেকে যখনই যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল ইরানের ওপর চাপ বাড়িয়েছে—পরমাণু চুক্তি নিয়ে হোক বা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে—তখনই ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। যদিও পুরোপুরি বন্ধ কখনো করেনি, কিন্তু বারবার এই হুমকি বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে (২০২3 সালের ১৭ জানুয়ারি) আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক পিটার বার্জার বলেন, “হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার হুমকি মানে হলো, তেল দামের হঠাৎ বেড়ে যাওয়া, যা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং এমনকি চীনকেও কাঁপিয়ে দিতে পারে। এটাই ইরানের আসল ক্ষমতা।”

ইরান শুধু হুমকি দিয়েই থেমে থাকেনি। তারা এই প্রণালীর কাছাকাছি দ্বীপগুলোতে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করেছে। বিশেষ করে আবু মুসা, গ্রেট তুনব ও লিটল তুনব দ্বীপে তাদের নৌ ও ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি রয়েছে। এ ছাড়া ইরান রেভোলিউশনারি গার্ডের নৌ শাখা ‘ইরানি প্যাসদারান’ নিয়মিত এই অঞ্চলে টহল দেয় এবং কখনো কখনো বিদেশি জাহাজ আটকের ঘটনাও ঘটিয়েছে।

২০২২ সালের জুলাই মাসে ইরান একটি দক্ষিণ কোরিয়ান তেল ট্যাঙ্কার আটক করে। এর কয়েকদিনের মধ্যেই মার্কিন নৌবাহিনী অঞ্চলটিতে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে। তখন মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের মুখপাত্র জন কারবি বলেছিলেন, “এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কারও হাতে এই সমুদ্রপথ জিম্মি হতে দেব না।”

তবে ইরান বলে, তারা কেবলমাত্র নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই এসব পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বারবার বলেছেন, “আমরা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করতে চাই না। কিন্তু যদি আমাদের বিরুদ্ধে কোনো শত্রুতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তবে আমাদের প্রতিক্রিয়া কঠোর হবে।”

এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের মতে, ইরান হরমুজ প্রণালীকে একটি ‘বিকল্প পারমাণবিক অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করে। নিউ হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. ইথান রুডার বলেন, “ইরানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র না থাকলেও, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার ক্ষমতাই তাদের হাতে এমন এক ছায়া-অস্ত্র দিয়েছে, যা ভয় দেখিয়ে কূটনৈতিক লাভ আদায় করতে সহায়ক।”

তবে শুধু ইরান নয়, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতও এই প্রণালীর উপর দখল রাখতে চায়। তাই এখানে সামরিক মোতায়েন, সামুদ্রিক মহড়া ও গুপ্তচর তৎপরতা সবসময়ই চলে। ফলে এটি হয়ে উঠেছে এক বিপজ্জনক 'ফ্ল্যাশপয়েন্ট', যেখান থেকে যেকোনো সময় বড় যুদ্ধের সূচনা হতে পারে।

এই প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন একবার বলেছিলেন, “মধ্যপ্রাচ্যে যদি পরবর্তী বড় যুদ্ধ হয়, তাহলে হরমুজ প্রণালী থেকেই তার সূচনা হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।”

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন এবং রাশিয়াও এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। চীন বিশেষ করে ইরানের সঙ্গে একাধিক চুক্তি করে হরমুজ প্রণালী এলাকায় বন্দর নির্মাণ, রেলপথ সংযোগ এবং সামরিক সহযোগিতা শুরু করেছে। ২০২১ সালে ইরান-চীন ২৫ বছরের একটি কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি করে, যার অংশ হিসেবে চীন এই অঞ্চল থেকে নিরাপদে জ্বালানি নিতে চায়।

সব মিলিয়ে, হরমুজ প্রণালী একদিকে যেমন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক করিডোর, অন্যদিকে তা হয়ে উঠেছে এক রকম ভূরাজনৈতিক বারুদের স্তূপ। ইরান এর অবস্থানগত সুবিধাকে ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলা করে, কূটনৈতিক লাভ তোলে এবং নিজের নিরাপত্তার গ্যারান্টি আদায়ের চেষ্টা করে।

এই ভূরাজনৈতিক 'ব্যালান্স অব পাওয়ার'-এর খেলা চলবে আরও বহুদিন, আর হরমুজ প্রণালী থাকবে তার কেন্দ্রবিন্দুতে। একে যারা শুধু একটি সরু জলপথ মনে করে, তারা হয়তো ভুলই করে। কারণ হরমুজ এখন আর কেবল ভৌগোলিক এলাকা নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে বিশ্ব রাজনীতির এক অত্যন্ত সংবেদনশীল ‘প্রেশার পয়েন্ট’।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার কতটা ক্ষতি হয়েছে জানালেন ট্রাম্প

৫ ঘণ্টা আগে

হরমুজ প্রণালি খোলা রাখতে চীনের হস্তক্ষেপ চাইল যুক্তরাষ্ট্র

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরান যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে, তাহলে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং পুরো বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে ভয়াবহ সংকট দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় চীনের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

৬ ঘণ্টা আগে

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লো

মার্কিন হামলার পর থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল যে, তেল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কায় বাজারে তেলের দাম বাড়বে।এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর বিশ্ব বাণিজ্যের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুট হরমুজ প্রণালি বন্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছে ইরানের পার্লামেন্ট। তবে এই সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিত

৬ ঘণ্টা আগে

মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে আগ্রহ নেই যুক্তরাষ্ট্রের: জেডি ভ্যান্স

মধ্যপ্রাচ্যে ‘দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে’ জড়ানোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আগ্রহ নেই বলে জানিয়েছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শান্তি নিশ্চিত করার জন্যই শনিবার রাতে ইরানে সীমিত পরিসরে হামলা চালানো হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

৭ ঘণ্টা আগে