ইতিহাস

কিউবিয়ান বিপ্লব, ফিদেল কাস্ত্রো ও যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫, ২০: ১০

দ্বীপদেশ কিউবা একসময় ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনস্থল ও আমেরিকার প্রভাবাধীন এক কৃষিনির্ভর দেশ ছিল। কিন্তু ১৯৫৯ সালের এক উত্তাল বিপ্লব সব পাল্টে দেয়। এক তরুণ আইনজীবী ও বিপ্লবী, ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে সংঘটিত হয় এমন এক রাজনৈতিক পরিবর্তন, যা শুধু কিউবাকেই বদলে দেয়নি, বদলে দিয়েছে বিশ্ব রাজনীতির চেহারা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও দম্ভকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল।

কিউবিয়ান বিপ্লব কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং এটি দীর্ঘদিনের সামাজিক অবিচার, বৈষম্য ও বিদেশি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে একটি সংগঠিত ক্ষোভের ফল। ১৯৫০-এর দশকে কিউবা শাসন করতেন ফুলজেনসিও বাতিস্তা নামের এক স্বৈরশাসক, যিনি মার্কিন সমর্থনে ক্ষমতায় ছিলেন। বাতিস্তার আমলে কিউবার অর্থনীতি অনেকটাই ছিল চিনি রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল, আর এই শিল্পের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করত আমেরিকান কোম্পানিগুলো।

গ্রামের কৃষক ও শহরের দরিদ্র মানুষের মধ্যে ছিল চরম বৈষম্য। চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থান—সবই ছিল বিত্তশালীদের জন্য সংরক্ষিত। এই বাস্তবতায় ফিদেল কাস্ত্রো, চে গেভারা ও আরও কিছু বিপ্লবী যুবক অস্ত্র হাতে তুলে নেন।

১৯৫৩ সালে ফিদেল কাস্ত্রো মনকাডা ব্যারাকে হামলা চালিয়ে প্রথম আলোচনায় আসেন। যদিও সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তিনি কারাবন্দি হন, পরে ক্ষমার সুযোগে মুক্ত হয়ে মেক্সিকো চলে যান। সেখান থেকেই গড়ে তোলেন তাঁর বিপ্লবী বাহিনী ‘২৬ জুলাই আন্দোলন’।

১৯৫৬ সালে ‘গ্রানমা’ নামের একটি ছোট নৌকায় করে মাত্র ৮২ জন সঙ্গী নিয়ে তিনি কিউবায় ফিরে আসেন। বেশিরভাগ সঙ্গী সেসময় নিহত হন। কিন্তু সিয়েরা মায়েস্ত্রা পর্বতের জঙ্গলে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে বেঁচে থাকা বিপ্লবীরা ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকেন।

এই সময় কাস্ত্রো শুধু অস্ত্র দিয়ে নয়, জনগণের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে থাকেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জমির ন্যায্য বণ্টনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। অবশেষে ১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে বাতিস্তা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান এবং কাস্ত্রোর বিপ্লব বিজয়ী হয়।

এই বিপ্লবের ঠিক পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার সম্পর্ক ক্রমে অবনতির দিকে যেতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র, যারা এতদিন কিউবাকে একপ্রকার নিজেদের প্রভাবাধীন এলাকা হিসেবে দেখত, তারা কাস্ত্রোর সমাজতান্ত্রিক নীতিকে ভালোভাবে নেয়নি। কাস্ত্রো মার্কিন কোম্পানিগুলোর সম্পদ জাতীয়করণ শুরু করলে ওয়াশিংটন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

যুক্তরাষ্ট্র তখন কাস্ত্রোকে সরাতে নানা গোপন কৌশল অবলম্বন করে। এর মধ্যে সবচেয়ে চিহ্নিত ঘটনা হলো ১৯৬১ সালের “বে অব পিগস ইনভেশন” বা শূকরের উপসাগরে হামলা। এই হামলায় সিআইএ’র সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র প্রশিক্ষিত প্রায় ১৪০০ কিউবান শরণার্থী কাস্ত্রো সরকার উৎখাতের উদ্দেশ্যে কিউবায় প্রবেশ করে।

কিন্তু তারা এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের শিকার হয়। কিউবান বাহিনী মাত্র তিন দিনের মধ্যেই এই আক্রমণ ব্যর্থ করে দেয়। প্রায় ১১৮০ জন আক্রমণকারী বন্দি হয় এবং বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এই ঘটনার বিষয়ে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইতিহাসবিদ ড. পিটার কর্নব্লু বলেন, “বে অব পিগস আক্রমণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি ভয়াবহ ভুল হিসাব, যা কিউবার বিপ্লবকে ধ্বংস করতে পারেনি, বরং কাস্ত্রোর অবস্থান আরও শক্ত করে তোলে।”

এই ব্যর্থতা মার্কিন প্রশাসনের মধ্যে দারুণ অস্বস্তি তৈরি করে। প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এই হামলার দায়িত্ব নেন এবং বলেন, “আমিই দায়ী।” কাস্ত্রোও এই ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রচারণা আরও জোরদার করেন।

এই ঘটনার কিছুদিন পর যুক্তরাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ শুরু করে, যা আজও বহু অংশে বলবৎ। কিউবা এই সময় থেকে আরও ঘনিষ্ঠ হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে। এর ফলেই ১৯৬২ সালে ঘটে “কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস”—একটি ঘটনার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র বসানোর চেষ্টা করে, আর আমেরিকা তা দেখে ভয় পায়। অবশেষে দুই পরাশক্তি সমঝোতায় পৌঁছায়, কিন্তু এই সংকট কিউবাকে বিশ্ব রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।

প্রখ্যাত মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি কিউবান বিপ্লবকে আমেরিকার এক নৈতিক পরাজয় বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “কিউবার বিপ্লব প্রমাণ করেছে, একটি ছোট দেশও যদি নিজের জাতিগত গর্ব নিয়ে দাঁড়াতে চায়, তাহলে শত চাপেও তা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি ছিল এক অসম্ভব কূটনৈতিক ব্যর্থতা।”

কিউবার ওপর চাপ, নিষেধাজ্ঞা, গুপ্তহত্যার ষড়যন্ত্র—সবকিছুই একভাবে কাস্ত্রোকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। কাস্ত্রো নিজেই বলেছিলেন, “আমাকে হত্যার জন্য আমেরিকা ৬০০ বারেরও বেশি চেষ্টা করেছে, কিন্তু প্রতিবার আমি বেঁচে গেছি।”

তবে কিউবিয়ান বিপ্লব কেবল মার্কিন বিরোধিতার প্রতিক্রিয়া ছিল না। এটি ছিল দারিদ্র্য, বৈষম্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একটি গণআন্দোলন। এবং এটিকে সফল করেছিলেন একজন ব্যক্তি—ফিদেল কাস্ত্রো।

তিনি তাঁর দেশে গণস্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। আজও কিউবায় সাক্ষরতার হার ৯৯% এর কাছাকাছি, এবং স্বাস্থ্যসেবার দিক থেকে দেশটি বিশ্বে প্রশংসিত। এসব অর্জনের পেছনে ফিদেল কাস্ত্রোর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব কাজ করেছে।

অবশ্য কিউবায় বাকস্বাধীনতা ও রাজনৈতিক বিরোধিতার ওপর কড়াকড়ি থাকায় তাঁর শাসনব্যবস্থার সমালোচনাও রয়েছে। তবে বাইরের চাপ ও অবরোধের মধ্যে একটি ছোট দ্বীপদেশকে স্বাধীন ও আত্মনির্ভর রাখতে পারাটাই ছিল তাঁর বড় সাফল্য।

আজ ফিদেল কাস্ত্রো নেই, কিন্তু কিউবান বিপ্লব ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। এটি শুধু একটি দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং এটি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, ক্ষমতাবানদের প্রতিপক্ষ হতে গেলে দরকার আস্থা, সাহস ও জনগণের সমর্থন।

যুক্তরাষ্ট্র এত যন্ত্রপাতি, গুপ্তচর, অর্থ ও বাহিনী দিয়েও এই বিপ্লব দমন করতে পারেনি। আর সে কারণেই কিউবান বিপ্লব ইতিহাসে রয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত ও নৈতিক পরাজয়ের প্রতীক হিসেবে।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

আইএইএ’র সাথে সম্পর্ক স্থগিতে সম্মতি ইরানি পার্লামেন্টের

আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থগিতের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছেন ইরানি পার্লামেন্ট সদস্যরা। এই প্রস্তাবের বিপক্ষে কোনো প্রতিনিধি ভোট দেননি।

৯ ঘণ্টা আগে

তেহরান থেকে আজ রওনা দেবেন ৩৫ বাংলাদেশি

ইরান থেকে দেশে ফেরার জন্য এরই মধ্যেই ২৫০ জন বাংলাদেশি তেহরান দূতাবাসে নিবন্ধন করেছেন। এসব বাংলাদেশিকে ধাপে ধাপে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হবে।

১০ ঘণ্টা আগে

ইরানে যেসব কারনে ব্যর্থ হলো ইসরায়েল

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কি ধ্বংস করতে পেরেছে ইসরায়েল? উত্তরটি সম্ভবত “না”। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার আগেই ইরান সম্ভবত অত্যন্ত সুরক্ষিত ও ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক স্থাপনা ফোর্দোতে থাকা গোপন ফিসনযোগ্য পদার্থ সরিয়ে নেয়, যা ছিল দেশটির পুরো পারমাণবিক কর্মসূচির প্রধান বা মূল বিষয়। ফলে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির

১০ ঘণ্টা আগে

গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ইরানে ৭ শতাধিক গ্রেপ্তার

ইরান জানিয়েছে ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধকালীন সম্পর্ক থাকার অভিযোগে ৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আরও ৩ জনকে মোসাদ এজেন্ট হিসেবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।

১০ ঘণ্টা আগে