top ad image
top ad image
home iconarrow iconবিশ্ব রাজনীতিarrow iconফিচার

ইতিহাস

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ
শিল্পীর দৃষ্টিতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ — এই শব্দ দুটি শুধু ভারতবর্ষের ইতিহাসে নয়, বিশ্বসভ্যতার চিন্তা-চেতনায় এক অনন্য জায়গা করে নিয়েছে। মহাভারতের কাহিনিতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ এক বিশাল ঘটনা। দুই মহাশক্তিশালী বংশ, কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে চলা এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ যেন ন্যায়ের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সংঘাত। তবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা যদি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, এটি কেবল ধর্মীয় বা পৌরাণিক কাহিনি নয়, বরং একটি বড় সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিতও বহন করে।

মহাভারত এক বিশাল মহাকাব্য, যেখানে প্রায় এক লক্ষ শ্লোক আছে। তার একটি বড় অংশই জুড়ে আছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। মহাভারতের বর্ণনায় বলা হয়, এই যুদ্ধ হয়েছিল কুরুক্ষেত্র নামক স্থানে, যেখানে ধর্ম ও ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করা হয়েছিল। তবে ঐতিহাসিক গবেষকরা মনে করেন, মহাভারতের যুদ্ধ আসলে প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন গোষ্ঠী বা রাজ্যগুলোর মধ্যে সংঘটিত প্রকৃত কোনো বড় সংঘর্ষের স্মৃতি হতে পারে, যা কালের বিবর্তনে পৌরাণিক রূপ পেয়েছে।

ঐতিহাসিকভাবে, কুরু রাজবংশ ছিল বৈদিক যুগের এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১২০০ থেকে ৮০০ সালের মধ্যে কুরু রাজারা উত্তর ভারতের একটি বড় অংশ শাসন করত। এই সময়টিতে ছোট ছোট গোত্র এবং রাজ্যগুলোর মধ্যে ক্ষমতার জন্য দ্বন্দ্ব চলত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সম্ভবত এমনই কোনো বড় রাজনৈতিক সংঘাতের প্রতিফলন, যেখানে দুই বা ততোধিক শক্তিশালী গোষ্ঠীর মধ্যে আধিপত্যের লড়াই হয়েছিল।

মহাভারতে বলা হয়, যুদ্ধের মূল কারণ ছিল সিংহাসনের দাবি। পাণ্ডবরা মনে করত তারা হস্তিনাপুরের সিংহাসনের বৈধ উত্তরাধিকারী, কিন্তু কৌরবরা, বিশেষ করে দুর্যোধন, সেই দাবি মানতে রাজি হয়নি। এই বিরোধ থেকেই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। যদিও কাহিনির স্তরে যুদ্ধের কারণ খুব ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক বলে মনে হয়, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ছিল রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। গোত্রীয় সমাজের পর যখন ধীরে ধীরে রাজ্যব্যবস্থা গড়ে উঠছিল, তখন এমন ক্ষমতার সংঘাত অস্বাভাবিক ছিল না।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সম্পর্কে মহাভারত যে বিশদ বিবরণ দিয়েছে, তা অবশ্যই অতিরঞ্জিত। কাহিনিতে বলা হয়, দুই পক্ষ মিলিয়ে প্রায় ৩৮ লক্ষ সৈন্য যুদ্ধ করেছিল এবং মাত্র আঠারো দিনে প্রায় সবাই মারা যায়। বাস্তবতা হলো, প্রাচীন ভারতের জনসংখ্যা এবং যুদ্ধের সামর্থ্য বিবেচনা করলে এত বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করা সম্ভব ছিল না। তাই ইতিহাসবিদরা মনে করেন, যুদ্ধটি ছিল আকারে ছোট বা মাঝারি ধরনের, তবে এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব এত গভীর ছিল যে, পরবর্তী সময়ে কল্পনার রঙে রঙিন হয়ে মহাকাব্যের রূপ পেয়েছে।

মহাভারতের যুদ্ধের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব। এই যুদ্ধের আগে এবং সময়কালে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে গীতা উপদেশ দেন, তা শুধু যুদ্ধের নীতিকথা নয়, বরং জীবনের সমস্ত দ্বন্দ্বের, দায়িত্বের এবং আত্ম-অনুসন্ধানের প্রতিফলন। ঐতিহাসিকভাবে দেখলে, এই সময়কাল ভারতীয় সমাজে ধর্মীয় চিন্তাভাবনায় বড় পরিবর্তনের যুগ। বৈদিক যুগের যজ্ঞকেন্দ্রিক ধর্মাচরণের পরিবর্তে আত্ম-অনুসন্ধান, কর্মযোগ, ধর্ম ও মোক্ষের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। গীতা সেই পরিবর্তনশীল যুগের চিন্তাধারার এক প্রতীক।

কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যও কুরুক্ষেত্র অঞ্চলের প্রাচীনতার ইঙ্গিত দেয়। ‘পেন্টেড গ্রে ওয়্যার’ সংস্কৃতি, যা খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৬০০ সালের মধ্যে বিস্তৃত ছিল, কুরুক্ষেত্র অঞ্চলে পাওয়া গেছে। এই সংস্কৃতি সাধারণত বৈদিক সমাজের সঙ্গে যুক্ত। যদিও সরাসরি মহাভারতের যুদ্ধের নিদর্শন মেলেনি, তবে প্রাচীন শহর আর বসতির ধ্বংসাবশেষ দেখে অনুমান করা যায়, সেই সময় বড় বড় সংঘাত হয়েছিল।

বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রমেশ চন্দ্র মজুমদার মনে করেন, মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সম্ভবত কোনো বাস্তব ঐতিহাসিক সংঘাতের ছায়া। তবে সময়ের ব্যবধানে সেই স্মৃতি নানা অলৌকিক কাহিনির সঙ্গে মিশে বিশালায়িত হয়ে গেছে। তার মতে, ‘মহাভারতের যুদ্ধ কোনো একক দিনের ঘটনা নয়, বরং এটি বহু বছরের ছোট-বড় সংঘাতের ঐতিহাসিক স্মৃতি।’

বিখ্যাত ভারতীয় ইতিহাসবিদ ড. রোমিলা থাপার বলেন, "মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সম্ভবত গোষ্ঠীগত সংঘাতের প্রতীক, যেখানে ক্ষুদ্র জনপদগুলোর মধ্যে আধিপত্যের লড়াই হয়েছিল।" তার মতে, মহাভারতকে পুরোপুরি ইতিহাস হিসাবে না দেখলেও, এটি প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতির মূল্যবান আভাস দেয়।

ড. ভি.এস. আগরওয়াল মনে করেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতার পুনর্বণ্টনের সময়কালীন সংঘাত। তার ভাষায়, "যুদ্ধের পর দেখা যায়, পুরনো রাজবংশের পতন ঘটে এবং নতুন নেতৃত্ব সমাজ গঠনে এগিয়ে আসে, যা ইঙ্গিত করে একধরনের সামাজিক রূপান্তর।"

বিশ্বখ্যাত গবেষক জন ব্রকিংটন মনে করেন, "মহাভারত এবং এর যুদ্ধের কাহিনি একেবারে শূন্য থেকে সৃষ্টি হয়নি। বরং এগুলোর পেছনে প্রাচীন বৈদিক যুগের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও ঐতিহাসিক টানাপোড়েন কাজ করেছে।"

আধুনিক ভাষায় পুরাণ বিশ্লেষক ড. দেবদত্ত পট্টনায়ক, যিনি বলেন, "মহাভারতের যুদ্ধ শুধু বাহ্যিক সংঘর্ষের গল্প নয়, এটি মানুষের মানসিক ও নৈতিক যুদ্ধের প্রতীক। ইতিহাসের স্তরে এটা সমাজের একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের প্রতিফলন।"

এছাড়া, বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ বি.বি. লাল হরিয়ানা ও কুরুক্ষেত্র অঞ্চলে খনন করে জানান, "প্রাচীন সভ্যতার কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে, যা ইঙ্গিত করে যে এই অঞ্চল একসময় অত্যন্ত সক্রিয় বসতি এলাকা ছিল। তবে সরাসরি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রমাণ মেলেনি।" তাই তিনি মহাভারতের ঘটনাকে আংশিক ঐতিহাসিক সত্য এবং আংশিক সাহিত্যিক কল্পনা বলে মনে করেন।

মজার বিষয় হলো, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুধু ভারতবর্ষের ইতিহাসেই নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্র গঠনে প্রভাব ফেলেছিল বলে অনেক গবেষক মনে করেন। বৈদিক যুগের ছোট ছোট গোষ্ঠী বা জনপদগুলো এক সময় একীভূত হয়ে বড় রাজ্য গড়ে তোলে। মহাভারতের যুদ্ধ সেই প্রক্রিয়ার একটি ধাক্কা হতে পারে — যেখানে কিছু রাজবংশ নিশ্চিহ্ন হয়, আবার কিছু রাজ্য শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এটি ছিল গোত্রসমাজ থেকে রাজ্যসমাজে উত্তরণের এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আরেকটি বিশেষ দিক হলো, এটি যুদ্ধের নীতিবোধের প্রশ্ন তোলে। মহাভারতে দেখা যায়, দুই পক্ষই কখনো কখনো নিয়মভঙ্গ করে, কখনো প্রতারণার আশ্রয় নেয়। যুদ্ধে ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণের মতো মহান বীররাও নানা জটিল নৈতিক প্রশ্নের মুখে পড়েন। অর্জুন পর্যন্ত যুদ্ধ করতে দ্বিধা বোধ করেন। ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বোঝায়, বাস্তব জীবনে ন্যায় আর অন্যায়ের রেখা সবসময় স্পষ্ট থাকে না। অনেক সময় ন্যায়ের পক্ষে লড়তেও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

আজকের ঐতিহাসিক গবেষণা বলে, মহাভারতের যুদ্ধ হয়তো একদিনে বা আঠারো দিনে শেষ হয়নি। সম্ভবত দীর্ঘ সময় ধরে ছোট ছোট সংঘাত, ষড়যন্ত্র এবং রাজ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার ভারসাম্য বদলেছে। কিন্তু পরবর্তী যুগের কাহিনিকাররা সবকিছুকে এক নাটকীয় যুদ্ধের আকার দিয়েছেন, যাতে গল্পের নায়ক-খলনায়কদের সংগ্রাম স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং নৈতিক শিক্ষার রূপ নেয়।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরে প্রাচীন ভারতের সমাজেও বড় পরিবর্তন আসে বলে ধারণা করা হয়। সমাজ আরও বেশি কৌলীন্য বা জাতিভিত্তিক নিয়মে বিভক্ত হয়ে পড়ে। যুদ্ধের পরে মহাভারতের কাহিনিতে দেখা যায়, বহু বীর, রাজা মারা গেছেন, নতুন রাজাদের হাতে রাজ্য গঠিত হচ্ছে। এতে বোঝা যায়, যুদ্ধ একটি বড় সামাজিক ধ্বংস আর পুনর্গঠনের চিহ্ন রেখে যায়।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ একটি প্রতীকি ঘটনা। এটি একদিকে প্রাচীন ভারতের রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা আর ধর্মীয় চিন্তাধারার পরিবর্তনের দিক দেখায়; অন্যদিকে এটি মানুষের চিরন্তন নৈতিক দ্বন্দ্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধের পরিণামে যে ধ্বংস আসে, সেই ধ্বংস নতুন সভ্যতার জন্ম দেয়। আর সেই সভ্যতা থেকেই গড়ে ওঠে ভারতীয় সংস্কৃতির নতুন ধারা, যা পরবর্তী সময়ে বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে মহাজনপদ যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আজও আমাদের শিক্ষা দেয় — শুধু বাহ্যিক বিজয় নয়, আত্মিক বিজয়ই মানুষের আসল লক্ষ্য। মহাভারতের এই যুদ্ধ দেখায়, বাহ্যিক যুদ্ধে জয়লাভ করলেও যদি নৈতিকতা হারিয়ে যায়, তবে সেই জয়ও বৃথা। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ তাই এক চিরন্তন মানবিক শিক্ষার মঞ্চ, যেখানে আমরা প্রতিবার নতুন করে সত্য, ধর্ম আর কর্তব্যের মর্ম বুঝতে পারি।

সূত্র: হিস্ট্রি ডট কম

r1 ad
top ad image