ইতিহাস

ইরানে ইসলামি বিপ্লবের ইতিহাস

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৫, ০৯: ৪৪

বিশ্ব ইতিহাসে এমন কিছু আন্দোলন রয়েছে যেগুলো শুধু একটি দেশের নয়, বরং গোটা অঞ্চলের রাজনৈতিক-সামাজিক কাঠামোকে পাল্টে দিয়েছে। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লব তেমনই এক ঘটনা, যা আধুনিক ইরানের জন্ম দেয়। রাজতন্ত্রের পতন, ধর্মীয় নেতার উত্থান, পশ্চিমা প্রভাবের অবসান এবং জনগণের জাগরণ—সব কিছু মিলিয়ে এই বিপ্লব আজও আলোচিত, প্রশংসিত এবং সমালোচিত। এই বিপ্লবের পিছনের কারণ, ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রভাব—সব কিছু নিয়েই রয়েছে নানা বিশ্লেষণ, মতবিরোধ এবং গবেষণা।

ইরানে ইসলামি বিপ্লব ঘটে এক দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক চাপ, সামাজিক ক্ষোভ এবং ধর্মীয় পুনর্জাগরণের প্রেক্ষাপটে। ১৯৪১ সালে ইরানের সিংহাসনে বসেন মোহাম্মদ রেজা পাহলভি। তিনি নিজেকে "শাহেনশাহ" অর্থাৎ রাজাদের রাজা হিসেবে অভিহিত করতেন। তাঁর শাসনকাল ছিল আধুনিকায়নের নামে কঠোর, পশ্চিমাপন্থী, অথচ ভেতরে ছিল দুর্নীতি, দমন-পীড়ন আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ। এ সময়েই ইরানের সমাজে এক গভীর বিভাজন তৈরি হয়—একদিকে ছিল একদল উচ্চবিত্ত পশ্চিমঘেঁষা এলিট, অন্যদিকে ধর্মীয় বিশ্বাসে ও মূল্যবোধে জাগ্রত সাধারণ মানুষ।

১৯৫৩ সালে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় ইরানে এক অভ্যুত্থান ঘটে, যার মাধ্যমে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মসাদ্দেককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে পুনরায় শক্তিশালী হন শাহ। এই অভ্যুত্থান সাধারণ মানুষের মনে গভীর ক্ষোভ সৃষ্টি করে। যাঁরা বিশ্বাস করতেন ইরান তার সম্পদ—বিশেষ করে তেল—নিয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, তাঁরা হঠাৎ বুঝতে পারেন তাঁদের দেশের উপর আবারও বিদেশি প্রভাব কায়েম হয়েছে।

ইরানের ইসলামি বিপ্লবের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। তিনি ছিলেন একজন শিয়া ধর্মীয় নেতা যিনি সাহসিকতার সঙ্গে শাহের নীতির বিরোধিতা করেন। ১৯৬৩ সালে ‘হোয়াইট রেভল্যুশন’ নামে শাহ যে আধুনিকায়নের কর্মসূচি নেন, তা নিয়ে খোমেনি প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন। এর জেরে তাঁকে গ্রেপ্তার ও পরে নির্বাসনে পাঠানো হয়। কিন্তু নির্বাসনে থেকেও তিনি তাঁর অনুসারীদের চিঠি ও রেকর্ডকৃত বার্তার মাধ্যমে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করতেন।

যিনি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ মার্ক গ্যাসিয়োরোস্কি বলেন, "খোমেনির নেতৃত্বে একটি ধর্মীয় চেতনার ওপর ভিত্তি করে যে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল, তা ছিল ইরানের ইতিহাসে নজিরবিহীন। তাঁর বার্তাগুলো শুধু ধর্ম নয়, রাজনৈতিক স্বাধীনতাও দাবি করত।"

১৯৭৮ সাল থেকে ইরানে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে তা ছিল ছোট আকারের প্রতিবাদ—তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা রূপ নেয় গণআন্দোলনে। মানুষ রাস্তায় নামে, ধর্মীয় শ্লোগানে মুখরিত হয় শহর। তেহরান, কোম, ইসফাহান, তাবরিজ—সর্বত্র মানুষ শাহের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। শাহের পুলিশ ও সেনাবাহিনী এ বিক্ষোভ দমন করতে কঠোর হাতে নামলে সংঘর্ষ, হতাহতের সংখ্যা ও জনরোষ আরও বেড়ে যায়।

এই সময় পশ্চিমা বিশ্ব—বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র—চুপচাপ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিল। শাহ তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে শাহ চিরতরে ইরান ছাড়েন এবং ফেব্রুয়ারিতে নির্বাসিত আয়াতুল্লাহ খোমেনি দেশে ফিরে আসেন। খোমেনির ইরানে প্রবেশ ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। হাজার হাজার মানুষ বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানায়। এরপর কিছুদিনের মধ্যেই সেনাবাহিনী খোমেনির প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে এবং ইরানে এক নতুন শাসনব্যবস্থার সূচনা হয়—ইসলামি প্রজাতন্ত্র।

এই নতুন শাসনব্যবস্থায় ধর্মীয় নেতারা রাষ্ট্র পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা নিতে শুরু করেন। আয়াতুল্লাহ খোমেনি হন ‘সর্বোচ্চ নেতা’। গণভোটের মাধ্যমে ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হয় এবং একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা হয় যেখানে ধর্মীয় আইনের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার নীতি গ্রহণ করা হয়।

ইতিহাসবিদ এরিক হোগল্যান্ড এই বিপ্লবকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে: “এই ছিল এমন এক বিপ্লব যা একদিকে মার্কসবাদীদের, অন্যদিকে ইসলামপন্থীদের আকাঙ্ক্ষাকে একত্র করেছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছিল ধর্মীয় মতবাদের।”

তবে বিপ্লবের পরপরই নানা বিতর্ক এবং সমস্যাও সামনে আসে। বিপ্লবের প্রথম দিকে যাঁরা শাহ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন—কমিউনিস্ট, বামপন্থী, উদারপন্থী বুদ্ধিজীবী—তাঁদের অনেকেই বিপ্লবের পর কোণঠাসা হন, অনেককে কারাবন্দি করা হয়, অনেকে প্রাণও হারান। একদল গণতান্ত্রিক ইরান আশা করলেও, ইসলামি বিপ্লব একটি কঠোর ধর্মীয় শাসনের জন্ম দেয়।

১৯৭৯ সালের নভেম্বরেই এক বড় ঘটনা ঘটে—তেহরানে মার্কিন দূতাবাস দখল ও ৫২ জন কূটনীতিককে জিম্মি করে রাখা হয় ৪৪৪ দিন ধরে। এই ঘটনাকে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ‘ব্রেকিং পয়েন্ট’ হিসেবে ধরা হয়। পশ্চিমা বিশ্ব ইরানকে এক অস্থির রাষ্ট্র হিসেবে দেখা শুরু করে। এর ফল হিসেবে ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়।

যিনি ইরান নিয়ে বহু বছর গবেষণা করেছেনবিশ্লেষক রবিন রাইট। তিনি বলেন, “ইরানি বিপ্লব ছিল অতীতের রাজতন্ত্রকে উল্টে দেওয়ার এক সাহসী পদক্ষেপ, কিন্তু বিপ্লব-পরবর্তী কাঠামো ছিল একধরনের ধর্মীয় কর্তৃত্ববাদ।”

ইরান বিপ্লব শুধু দেশের ভেতর নয়, মুসলিম বিশ্বেও বড় প্রভাব ফেলে। এটি দেখায় ধর্মীয় ভাবধারার ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র কেমন হতে পারে। একইসঙ্গে, এটি সৌদি আরবের মতো রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর জন্য একধরনের হুমকির উদাহরণ হয়ে ওঠে। ফলে ইরান-সৌদি আরব সম্পর্কে উত্তেজনা বাড়তে থাকে।

ইরানের ইসলামি বিপ্লব এখন চার দশক পার করেছে। এই সময়ের মধ্যে বহু চড়াই-উৎরাই পার করেছে দেশটি—ইরাকের সঙ্গে আট বছরের যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা, পরমাণু কর্মসূচি ঘিরে বিরোধ, এবং সাম্প্রতিক ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধ। কিন্তু এই বিপ্লব এখনো ইরানি সমাজ ও রাজনীতির মূল ভিত্তি হয়ে আছে।

ইরানের জনগণের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদের সংমিশ্রণ এই বিপ্লবকে টিকিয়ে রেখেছে। যদিও সমসাময়িক সময়ে ইরানের তরুণ সমাজের একটি অংশ আরও বেশি স্বাধীনতা ও সংস্কার চায়, তবুও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের গড়ন এখনো ভেঙে পড়েনি।

ad
ad

বিশ্ব রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

ইসরাইলি হামলায় ২৪ ঘণ্টায় ৭২ ফিলিস্তিনি নিহত

ফিলিস্তিনের গাজায় বুধবার (১৯ জুন) থেকে ইসরাইলি হামলায় আরও ৭২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে ২৯ জন ত্রাণ সংগ্রহের জন্য অপেক্ষার সময় নিহত হয়েছেন। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের বরাতে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।

৪ ঘণ্টা আগে

ইরান-ইসরাইল সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত না হওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ

ইসরাইল ও ইরানের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যেন জড়িত না হয় তার বিরোধিতা করে হোয়াইট হাউসের সামনে বিক্ষোভ করছেন একদল বিক্ষোভকারী। এক প্রতিবেদনে বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) এক প্রতিবেদনে আলজাজিরা জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা ইরানে ইসরাইলি বোমা হামলা ও ইসরাইলি বাহিনীকে কোটি কোটি ডলার সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ

৫ ঘণ্টা আগে

ইসরাইলের ক্ষেপণাস্ত্রের ধোঁয়া দেখে ভবনে ঢুকে পড়ল বাস

৬ ঘণ্টা আগে

ইরানে ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৬৩৯

ইসরাইলের হামলায় ইরানে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৩৯ জন নিহত হয়েছেন ও আহত হয়েছেন এক হাজার ৩২০ জনেরও বেশি মানুষ। ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্টস এ তথ্য জানিয়েছে। খবর আলজাজিরার।

৬ ঘণ্টা আগে