দেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি: এখনই প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি

ভূমিকম্পপ্রবণ হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। মাঝেমধ্যেই ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূকম্পনে কেঁপে উঠছে দেশ। এসব ভূমিকম্পে তেমন ক্ষয়ক্ষতি না হলেও সামনে বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সাম্প্রতিককালে একটির পর একটি স্বল্পমাত্রার ভূকম্পনের আঘাত ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। কোনো পূর্বাভাসের ব্যবস্থা না থাকায় মানুষের উদ্বেগ বাড়ছে।
গত ১০ দিনে চার দফা ছোট থেকে মাঝারি আকারের যে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, প্রায় প্রতিটিরই উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের সীমানার ভেতর বা আশপাশে। গত ৫ মার্চ বুধবারও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা কেঁপে উঠে ভূমিকম্পে। বেলা ১১টা ৩৬ মিনিটে এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পটির রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫.৬। ভূমিকম্পে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ক্ষতির তথ্য মেলেনি। যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ভারতের মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের ইয়ারিপক এলাকা। ভূমিকম্পটির গভীরতা ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার।
ভূমিকম্প নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা
ভূমিকম্প সাধারণ অর্থে ভূমির কম্পনকে বোঝায়, যা ভূতত্ত্ব বা জিওলজি বিষয়ের অন্তর্গত বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠপঠনে ও গবেষণায়। এই বিষয়টির একটি টেকনিক্যাল রূপ রয়েছে, যা সাধারণের কাছে একটি আতঙ্কের বিষয় হিসেবেই বেশি পরিচিত। এটি আমাদের সমাজজীবনকে অনেক ভাবনার মধ্যে আরও একটি ভাবনায় সংযোজিত করে থাকে। সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অনুযায়ী, ভূমিকম্প হয় প্লেট টেকটনিকের (Plate Tectonic) সংঘর্ষের ফলে। পাশাপাশি দুটি মহাদেশীয় প্লেটের সীমান্ত অঞ্চলে যে প্রবল পীড়নের (Stress/Oppression) সৃষ্টি হয়, সেই পীড়ন যখন বড়সড় চ্যুতির (Faul) সৃষ্টি করে এবং তার অন্তর্নিহিত শক্তি বের করে দেয়, তখন ভূমিকম্প হয়।
ভূপৃষ্ঠে বা ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি গভীরতায় বড় মাত্রার বিস্ফোরণ ঘটলে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের উত্পত্তি হতে পারে। তাছাড়া আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ও অগ্ন্যুত্পাতের সময় সাধারণত ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। প্রায় এক ডজন ছোট-বড় অংশ নিয়ে ভূত্বক গঠিত। এই অংশগুলোকে প্লেট টেকটনিক (Plate Tectonic) বলে। এই প্লেটগুলো নিচের অশক্ত ম্যান্টলের ওপর ভাসতে থাকে এবং প্লেটগুলো একে অন্যের সঙ্গে ঘষা খেতে থাকে।
কখনো একটি প্লেট অপরটির ওপরে উঠে যায় কিংবা নিচে চলে যায়, যাকে অধোগামী অঞ্চল (Subduction Zone) বলে। কোথাও আবার একে অপর থেকে দূরে সরে যায়, যাকে অপসারী অঞ্চল (Spreading Zone) বলে। কোনো স্থানে অতিরিক্ত খনিজ (গ্যাস, তেল ইত্যাদি) উত্তোলনের কারণে শিলার স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে ধ্বংসের সৃষ্টি হয়ে ভূমিকম্প দেখা দিতে পারে। ১৯৮৯ সালে অস্ট্রেলিয়ায় খনিজ উত্তোলনের কারণে নিউক্যাসল ভূমিকম্প এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। প্রাকৃতিকভাবেই কার্বন চক্রের প্রভাবে ভূমিকম্প হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও এর ব্যত্যয় হয় না।
ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এবং কাছাকাছি এলাকায় ২৮টি ভূমিকম্প হয়। ২০২৩ সালে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১টি এবং গত বছর ২০২৪ সালে দেশে ও আশপাশে ৫৩টি ভূমিকম্প হয়েছে। এটি ছিল আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ছোট ও মাঝারি ভূকম্পনে বড় শক্তি বের হওয়ার একটা প্রবণতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তার অর্থ, যেকোনো সময় একটি বড় ভূমিকম্প হতে পারে। ৭ মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ফেরত আসার একটি সময় হয়ে গেছে। তবে এই বড় ভূমিকম্প কবে হবে, সেটি নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। গত বছর হওয়া ‘আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট: রাজউক অংশ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৪০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যমতে, বাংলাদেশ ভূকম্পনের সক্রিয় এলাকায় অবস্থিত। দুর্যোগ সূচক অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে রয়েছে ঢাকা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছোটখাটো কম্পন দেশের আরও শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা নির্দেশ করে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যবেক্ষণাগারে ২০০৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের মে মাসের মধ্যে ৪ মাত্রার ওপরে মোট ৮৬টি ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। এই ছোটখাটো কম্পনগুলো ভারী ভূমিকম্পের আশঙ্কা নির্দেশ করে। বাংলাদেশ মূলত ভারত ও মিয়ানমারের ভূ-অভ্যন্তরের দুটি ভূ-চ্যুতির (Fault Lines) প্রভাবে আন্দোলিত হয়।
উল্লেখ্য, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ মূলত ভারতীয়, ইউরেশীয় ও মিয়ানমারের টেকটনিক প্লেটের মধ্যে অবস্থান করছে। ভারতীয় ও ইউরেশীয় প্লেট দুটি দীর্ঘদিন ধরে হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে। অপেক্ষা করছে বড় ধরনের নড়াচড়ার বা বড় ধরনের ভূকম্পনের। বাংলাদেশে আটটি ভূতাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা (Fault Zone) সচল অবস্থায় রয়েছে। বৃহত্তর সিলেটের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থিত হালুয়াঘাট চ্যুতির ডাউকী চ্যুতি অংশ ও শাহজীবাজার চ্যুতি (আংশিক ডাউকি চ্যুতি) উল্লেখযোগ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের গবেষণার তথ্য বলছে, সাম্প্রতিককালে বড় মাত্রার ভূমিকম্প না হলেও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। সবশেষ গত ২৯ মার্চ ৭টা ১৫ মিনিটের দিকে বাংলাদেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
ইউএসজিএস জানিয়েছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তি ছিল মিয়ানমারের মাওলাইতে। এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৪। ভূমিকম্পের কেন্দ্রে এর গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার। দেশের ১৩টি এলাকা ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূগর্ভস্থফাটল বা চ্যুতি থাকার কারণে ওই কম্পন হতে পারে। সবচেয়ে তীব্র ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা, সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকা ও ঢাকার টাঙ্গাইল জেলা।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার আট লাখ ৬৪ হাজার ৬১৯টি থেকে ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৬৮৫টি ভবন ধসে বা ভেঙে পড়বে, যা মোট ভবনের ৪০ দশমিক ২৮ শতাংশ থেকে ৬৪ দশামক ৮৩ শতাংশ। এ ছাড়া যদি সিলেট লাইনমেন্টে ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে ঢাকার ৪০ হাজার ৯৩৫টি থেকে তিন লাখ ১৪ হাজার ৭৪২টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা মোট ভবন সংখ্যার ১ দশমিক ৯১ থেকে ১৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্টের অধীনে পরিচালিত গবেষণায় এ তথ্য উঠে আসে, যা তুলে ধরেন রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী এবং প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল লতিফ হেলালী। তিনি জানান, রাজউক এলাকার অধীনে ঢাকায় ২১ লাখ ৪৭ হাজার ২১৯টি ভবন রয়েছে, যার মধ্যে পাকা ভবন পাঁচ লাখ ১৩ হাজার ৫০৭টি। তিন হাজার ২৫২টি (পাকা) ভবনের ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়। এগুলোর মধ্যে অতিঝুঁকিতে থাকা ৪২টি ভবন সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী সতর্ক করে বলেন, মধুপুর ফল্টে সকালের দিকে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় দুই লাখ ১০ হাজার থেকে তিন লাখ ১০ হাজার মানুষ নিহত হবে। দুপুরে হলে দুই লাখ ৭০ হাজার থেকে চার লাখ এবং রাতে হলে তিন লাখ ২০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ মানুষ নিহত হবে।
এদিকে দেশের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর ১০০ থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে সাত থেকে আট মাত্রার ভূমিকম্প হলে তীব্র কম্পন অনুভূত হতে পারে, যা এই শহরের দুর্বল ভবনগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ঢাকার সম্প্রসারিত বা নতুন নতুন আবাসিক এলাকার মাটি নরম ও দুর্বল। এ ধরনের মাটিতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা না মেনে বহুতল ভবন হলে তা মাঝারি মাত্রার কম্পনেই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা থাকে। লালমাটির এলাকায় যেসব এক থেকে তিনতলা ভবন নির্মিত হয়েছে, সেগুলোর ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। ভূমিকম্পে মানুষের মৃত্যুর ৯০ শতাংশই হয় ভবনধসে।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ভূমিকম্প গবেষক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশের ভেতরে ১৩টি ভূগর্ভস্থচ্যুতি রয়েছে। তবে তার সব কটি ঢাকা থেকে বেশ দূরে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে মাঝারি থেকে তীব্র ভূমিকম্প হলে ঢাকায় অনেক ভবন ভেঙে পড়তে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের একজন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বলেন, পার্বত্য সীমান্ত আর সিলেট অঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টির মতো শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে। যেখানে ভূমিকম্প হলে সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহসহ জনবহুল শহরগুলোতে বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ঝুঁকি প্রশমনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে ৭২ হাজার ভবন তাৎক্ষণিকভাবে ধসে পড়বে। এতে ব্যাপক প্রাণহানি ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটবে। বিশেষজ্ঞরা ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা বেড়ে গেলেও তাকে মোকাবিলায় যথাযথ প্রস্তুতির অভাব আছে বলেই তারা মনে করেন।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের গতিপ্রকৃতি
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সম্প্রতি বেশকিছু হালকা ও মাঝারি ধরনের ভূকম্পন এ ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে তুলেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বড় মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। ২০২৩ সালের ২ ডিসেম্বর সকালে সারাদেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থেকে আট কিলোমিটার পূর্ব-উত্তর-পূর্বে যার মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৬ যা বিগত ২৫ বছরের মধ্যে ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। এই ভূমিকম্প ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হল ও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে একটি পোশাক কারখানায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
একই বছরের ২৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ৩ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ৫ মে ঢাকা থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে দোহারে উৎপত্তি হওয়া ৪ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্পটি বেশ আতঙ্ক তৈরি করে মানুষের মধ্যে। একই মাসের ১৭ তারিখে ৩ দশমিক ৩ মাত্রার আরেকটি ভূকম্পন অনুভূত হয়। এর উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ১২৫ কিলোমিটার দূরে।
একই মাসের ১৭ তারিখে ৩ দশমিক ৩ মাত্রার আরেকটি ভূকম্পন অনুভূত হয় যার উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ১২৫ কিলোমিটার দূরে নেত্রকোনায়। এছাড়াও গত ২৯ ও ৩০ মে, ২০২১ সালে সিলেট শহর ও এলাকায় ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে ৪.১ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল । পরবর্তী সময়ে ৭ জুন সিলেট শহরে মৃদু মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর কিছু সময় পরেই গত ৭ জুলাই সিলেট, ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে, ৮ই আগস্ট তারিখে চট্টগ্রাম ও আশপাশে, ১০ই আগস্ট মিয়ানমারে ৫.৬ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
এর আগে ১৯৯৮ সালের মে তে সিলেটের বড়লেখায় ৫ দশমিক ৮ মাত্রার একটি ভূকম্পন সৃষ্টি হয়েছিল। রাজধানীর বাইরে রায়পুরা, ভোলা, খুলনা, কোটালীপাড়া, চট্টগ্রাম, দেবীদ্বার, ঝালকাঠি, বরগুনা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, চুয়াডাঙ্গা, নোয়াখালী, কুষ্টিয়ায় তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এর কারণ হিসাবে উল্লেখিত হয়েছে জলাধার নির্মাণ, পারমাণবিক পরীক্ষা, খনিজ উত্তোলন ইত্যাদি। কোনো স্থানে অতিরিক্ত খনিজ (গ্যাস, তেল ইত্যাদি) উত্তোলনের কারণে শিলার স্থতিস্থপকতা নষ্ট হয়ে ধ্বংসের সৃষ্টি হয়ে ভূমিকম্প দেখা দিতে পারে; যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অহরহ ঘটে চলছে বলে প্রতীয়মান।
গত ৫ মার্চ বুধবারও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা কেঁপে উঠে ভূমিকম্পে। বেলা ১১টা ৩৬ মিনিটে এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পটির রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫.৬। ভূমিকম্পে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ক্ষতির তথ্য মেলেনি। ইউএসজিএস জানিয়েছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ভারতের মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের ইয়ারিপক এলাকা। ভূমিকম্পটির গভীরতা ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের কর্মকর্তা জানান, ঢাকা থেকে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের দূরত্ব ৪৪৯ কিলোমিটার। ভূমিকম্পে ঢাকা ছাড়াও গাজীপুর, চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সিলেটসহ বেশ কয়েকটি স্থানে কম্পন টের পাওয়া গেছে। এ নিয়ে গত ১০ দিনে দেশে চার বার ভূমিকম্প অনুভূত হলো।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তনের কারণে এসব সিসমিক কর্মকাণ্ড ঘটছে, যা স্বাভাবিক হলেও তাতে জনমনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। প্রতিটি ভূমিকম্পের পর নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সিসমিক বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, এসব ভূমিকম্প দেশের ভূতাত্ত্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত। তারা আরও বলেন, ভূমিকম্পের মাত্রা কম হলেও এর পরিণতি হতে পারে বড়, তাই নাগরিকদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এবং কাছাকাছি এলাকায় ২৮টি ভূমিকম্প হয়। ২০২৩ সালে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১টি এবং গত বছর ২০২৪ সালে দেশে ও আশপাশে ৫৩টি ভূমিকম্প হয়েছে। এটি ছিল আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রম
ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ইতিমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ভূমিকম্পসহ সব দুর্যোগের সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের করণীয় নির্ধারণ করে ‘দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলি, ২০১৯ (Standing Orders on Disaster, 2019)’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর অধীন দুর্যোগকালীন কার কী করণীয় তা নিরূপণ করা হয়েছে। নীতিমালার অধীন প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল (NDMC) গঠন করা হয়েছে। উক্ত স্থায়ী আদেশাবলির অধীন মাঠ পর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড পর্যন্ত অংশীজনের করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সে মোতাবেক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
তার ওপর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সমন্বয়ে জরুরি প্রতিক্রিয়া সংস্থাগুলোর জন্য জাতীয় কন্টিনজেন্সি প্ল্যান প্রস্তুত করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় বিল্ডিং কোড (BNBC) অনুমোদন লাভ করেছে। এরই মধ্যে ভূমিকম্প-পরবর্তী অনুসন্ধান ও উদ্ধার সরঞ্জাম কিনে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে হস্থান্তর করা প্রয়োজন। ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ঝুঁকি প্রশমনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলার প্রয়োজন।
ভূমিকম্পের ক্ষতি নিরসনে বিবেচ্য বিষয়
বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন ভূমিকম্পের উৎসস্থল চিহ্নিত করা গেলে সেসব এলাকার ভবনগুলো ভূমিকম্প সহনশীল করে নির্মাণ করার নির্দেশ দেওয়াসহ সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস, স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলোর লোকবল ও পর্যাপ্ত উদ্ধার যন্ত্রপাতি প্রস্তুত রাখার আগাম ব্যবস্থা করা যাবে। বড় ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির নিরসনে বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড মেনে চলতে হব যেমন উচ্চতা ও লোডের হিসাব অনুযায়ী শক্ত ভিত দেওয়া, রিইনফোর্সড কংক্রিট ব্যবহার, এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি নিরাপদ দূরত্বে বাড়ি নির্মাণ, গ্যাস ও বিদুৎ লাইন নিরাপদভাবে স্থাপন, নরম মাটি কিংবা গর্ততে ভবন নির্মাণ না করা, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সংস্কার কিংবা ভেঙে ফেলা ইত্যাদি।
ভূমিকম্পের কোনো আগাম পূর্বাভাস পাওয়া যায় না যা অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বেলায় সম্বব হয়। তাই জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সীমিত সম্পদ ও ক্ষমতার আওতার মধ্যেই এ দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি সম্ভব। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পরিকল্পিত নগরায়ণ জরুরি। সত্যি বলতে ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরে ভূমিকম্প হলে মানবিক মহাবিপর্যয় ঘটবে, যা সহজেই অনুমেয়।
২০১৫ সালে নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর দেশে ‘ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার’ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। এর আগে বাংলাদেশে ফায়ার সার্ভিসের উদ্যোগে ভূমিকম্প মহড়া হলেও সেটি আর অব্যাহত নেই। এমনকি ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এনডিএমআইএস) নামে যে ওয়েবসাইট নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল সেটিও হয়নি। এমন উদাসীনতার পরেও দেশটাকে সঠিকভাবে এগিয়ে নিতে হবে। এ জন্য প্রশাসনের ভূমিকা জরুরি। প্রস্তাবিত ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) যথাযথ অনুমোদন নিয়ে স্থাপনা নির্মাণ হতে হবে। সাথে সাথে নাগরিক শিক্ষা ও মহড়া-উভয়ই বড় জরুরি।
লেখক : অধ্যাপক (অর্থনীতি), সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা), সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা