‘মানবিক করিডোর’ নিয়ে অসন্তোষের যত কারণ\n
এখন ইস্যু যদি হয় ত্রাণসামগ্রী মিয়ানমার সীমান্তে পৌঁছে দেওয়া, সেটি বড় কোনো সমস্যা না। এর জন্য জাতিসংঘেরও প্রয়োজন হয় না। কারণ মিয়ানমারের সীমান্তে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে। বাংলাদেশে দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম একটি দেশ। প্রতিবেশী দেশ চাইলে সে এই সহায়তাটুকু করতেই পারে।
মিয়ানমার যদি বলে যে দেশের মধ্যে দিয়ে ত্রাণ নেওয়া সম্ভব না, তাহলে বাংলাদেশ সীমান্তে ত্রাণ পৌঁছে দিতেই পারে। এর জন্য বাইরের দেশের যুক্ত হওয়ার প্রয়োজন দেখি না। কারণ করিডোর দেওয়ার পর সেই করিডোরের অপব্যবহারের দৃষ্টান্ত আছে কিছু দেশে। তাই আমার দেশের মাটি অন্যকে ব্যবহার করতে দেওয়ার আগে অনেক কিছু ভাবতে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে— মিয়ানমার এমন সহায়তা আমাদের কাছে চেয়েছে কি না। কারণ সেখানে সেনা সমর্থিত সরকারের পাশাপাশি বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। তারা পৃথকভাবে বা যৌথভাবে বাংলাদেশকে এ রকম করিডোর দেওয়ার অনুরোধ করেছে কি না, সেটি জানতে হবে। তাদের কারও পক্ষ থেকে এ রকম কোনো অনুরোধ যদি না থাকে, তাহলে কেন আমরা এর মধ্যে জড়াব?
মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক না। সেখানে দুটি পক্ষই শক্তিশালী। আবার আরাকান আর্মির সঙ্গে আমরা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কথা বলছি। সেটি হয়তো মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ভালোভাবে দেখবে না। তাই সেনাবাহিনী বা আরাকান আর্মি করিডোর দেওয়ার এই উদ্যোগকে পছন্দ নাও করতে পারে। তারা নিজেরা এত মারামারি করছে, সেখানে আমাদের দিকে একটি বোমা ছুড়ে দিলে তার দায় কে নেবে? জাতিসংঘ? নাকি অন্য কোনো দেশ?
তাছাড়া আমরা পারছি না, তোমরা সহায়তা করো— এমন আহ্বানও মিয়ানমারের কোনো পক্ষ জানায়নি। তাহলে কীসের ভিত্তিতে আমরা সেখানে নাক গলাতে চাই? আমরা আরেকটি দেশের সার্বভেৌমত্ব খণ্ডন করছি কি না, সেটিও ভেবে দেখার বিষয়।
আরেকটি বড় প্রশ্ন রয়েছে। এই করিডোরের মধ্যে কি বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ইস্যু আছে? এখনো রোহিঙ্গারা ঢুকছে। আমরা কি তাদের ঢোকা সহজ করব? নাকি ফেরত পাঠানোর উপায় খুঁজব?
এ রকম অনেক প্রশ্ন সামনে চলে আসে। এসব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে যদি আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, তাতে দেশের লাভ হবে না।
দেখতে হবে, ওই করিডোরের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট দূর হবে কি না। যেখানে জাতিসংঘ নিজেই বলছে তাদের অর্থ কমে গেছে, রোহিঙ্গাদের জন্য আর সহায়তা দিতে পারবে না, সেখানে হঠাৎ মানবিক সহায়তার এই অর্থ কোথা থেকে আসছে? জাতিসংঘে প্রতিনিধিত্বকারী যেসব দেশ আছে তারা এ বিষয়ে কী বলছে, সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার।
দেখা গেল, এই করিডোর সুবিধা দিতে গিয়ে রোহিঙ্গা সংকট ও দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকট আরও বেড়ে গেল। তখন কী হবে? তাদের (জান্তা সরকার ও আরাকান আর্মি) লড়াইয়ের মধ্যে আমরা যেন কোনোভাবে যুক্ত হয়ে না যাই, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে না। তাহলে আমরা কীভাবে জানব ওই করিডোরে কী হবে? তাই সবার আগে করিডোরের উদ্দেশ্য ও শর্তগুলো স্পষ্ট করা প্রয়োজন।
সবচেয়ে বড় কথা, এই যে মানবিক করিডোর দেওয়ার প্রশ্ন, এটি তো অন্তবর্তী সরকারের কাজ না। এই সরকারের কাজ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা, প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা। মানবিক করিডোর দেওয়ার ইস্যুতে না জড়িয়ে সেই মৌলিক দায়িত্বের দিকে মনোযোগী হওয়াটাই সরকারের জন্য ভালো হবে।
লেখক: আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক