হজ যাত্রার সূচনা: বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিক হজ কার্যক্রমের নতুন অধ্যায়

বাংলাদেশে হজযাত্রীদের সৌদি আরব অভিমুখে যাত্রার মধ্য দিয়ে শুরু হলো ২০২৫ সালের হজের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর আশকোনা হজক্যাম্পে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে হজ ফ্লাইটের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন।
প্রথম ফ্লাইট ছাড়ার আগে এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়। সাদা কাপড়ে মোড়ানো হজযাত্রীরা চোখে-মুখে শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসার আবেশ নিয়ে দেশের মাটিকে শেষ সালাম জানিয়ে পবিত্র মক্কা-মদিনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। এ যেন এক বৈশ্বিক মুসলিম উম্মাহর অংশ হিসেবে বাংলাদেশের আত্মার উচ্চারণ।
অনুষ্ঠানে ধর্ম উপদেষ্টা হজযাত্রীদের প্রতি শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আপনাদের আচরণ, ব্যবহার, দায়িত্বশীলতা ও সততা— সবকিছুতেই দেশের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব রয়েছে।’ সৌদি আরবে অবস্থানকালে ওই দেশের আইন-কানুন মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই বাংলাদেশের হজযাত্রীরা সবার কাছে শ্রেষ্ঠতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন।’
ধর্ম উপদেষ্টা জানান, সরকার হজ ব্যবস্থাপনাকে আরও সহজ, সাশ্রয়ী ও যাত্রীবান্ধব করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করছে। নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজীকরণ, খরচ যৌক্তিক রাখা ও সফরকে আরও স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হয়েছে। এ বছরের হজ ব্যবস্থাপনায় এরই মধ্যে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে, যা আগামী দিনে আরও উন্নত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সৌদি গন্তব্যের দিকে প্রথম হজ ফ্লাইট
সোমবার দিবাগত রাত ২টা ১৫ মিনিটে বাংলাদেশি হজযাত্রী বহনকারী প্রথম বিমানটি রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সৌদি আরবের জেদ্দার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সৌদি আরবের জাতীয় ক্যারিয়ার সাউদিয়া পরিচালিত এসভি ৩৮০৩ ফ্লাইটের মাধ্যমে ৩৯৮ জন হজযাত্রী এই শুভযাত্রায় অংশ নেন।
প্রথম দিনে মোট ১০টি ফ্লাইটের মাধ্যমে ৪ হাজার ১৮০ জন হজযাত্রী সৌদি আরব পৌঁছান। এর মধ্যে আটটি ফ্লাইট জেদ্দার কিং আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ও দুটি মদিনার প্রিন্স মুহাম্মদ বিন আব্দুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এর মধ্য দিয়ে হজযাত্রী পরিবহনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হলো।
অনুষ্ঠানে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব এ কে এম আফতাব হোসেন প্রামানিকের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য দেন হজ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মতিউল ইসলাম। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, সচিব নাসরীন জাহান, বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স আবদুল আজিজ ফাহাদ এম আল ইব্রাহিম, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবির ভূঁইয়া এবং হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি সৈয়দ গোলাম সরওয়ার ও মহাসচিব ফরিদ আহমদ মজুমদার।
এবারের হজ ব্যবস্থাপনায় নতুনত্বের ছোঁয়া
এ বছরের হজ ব্যবস্থাপনায় সরকার নানা নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। হজযাত্রীদের জন্য মোবাইল অ্যাপ চালু করা হয়েছে, যেখানে যোগাযোগ সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় সব তথ্য সহজেই পাওয়া যাবে। হজযাত্রীদের জন্য প্রিপেইড কার্ড ও মোবাইল সিমের রোমিং সুবিধাও চালু হয়েছে, যেন সৌদি আরবে থেকে দেশের সাথে সংযোগ বজায় রাখা সহজ হয়।
এ ছাড়া এ বছর হজ ফ্লাইট পরিচালনায় অংশ নিচ্ছে তিনটি এয়ারলাইন্স— বাংলাদেশ বিমান, সাউদিয়া ও ফ্লাইনাস। মোট ২৩২টি প্রাক-হজ ফ্লাইটের মাধ্যমে হজযাত্রী পরিবহন করা হবে। বাংলাদেশ বিমান পরিচালনা করবে ১১৮টি ফ্লাইট, যেখানে পরিবাহিত হবেন ৪৪ হাজার ৩০৭ জন যাত্রী। সাউদিয়া ৮০টি ফ্লাইটে ৩২ হাজার ৭৪০ জন ও ফ্লাইনাস ৩৪টি ফ্লাইটে ১৩ হাজার ৬৫ জন হজযাত্রী পরিবহন করবে।
৩১ মে প্রাক-হজ ফ্লাইট শেষ হবে এবং চাঁদ দেখাসাপেক্ষে পবিত্র হজ পালন করা হবে ৫ জুন। হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ১০ জুন থেকে শুরু হবে ফিরতি ফ্লাইট।
বাংলাদেশ থেকে এ বছর মোট ৮৭ হাজার ১০০ জন হজযাত্রী সৌদি আরবে যাচ্ছেন, যার মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৫ হাজার ২০০ জন ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৮১ হাজার ৯০০ জন।
হজযাত্রীদের অনুভূতি ও সন্তুষ্টি
অনুষ্ঠানে দুজন হজযাত্রী নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। তারা সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত ব্যবস্থাপনা ও সুযোগ-সুবিধার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তারা জানান, এবারের হজ ব্যবস্থাপনায় সুশৃঙ্খলতা, স্বচ্ছতা ও সহানুভূতির ছাপ রয়েছে। দীর্ঘদিনের ভোগান্তির যে অভিযোগ ছিল, তা অনেকাংশেই এবার দূর হয়েছে বলে তারা অভিমত দেন।
সরকারি পর্যায়ে যেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তেমনি বেসরকারি পর্যায়ে হজ এজেন্সিগুলোও এবার অধিকতর দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে বলে জানিয়েছেন অনেকে।
হজ: আত্মিক পরিশুদ্ধির মহান আহ্বান
হজ শুধু ভ্রমণ নয়; এটি এক মহামিলন, আত্মার পরিশুদ্ধি, আত্মনিবেদন ও আত্মসমর্পণের প্রতীক। সারা বিশ্ব থেকে লাখ লাখ মুসলিম নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পবিত্র ভূমিতে একত্রিত হন, আল্লাহর মহত্ব ঘোষণা করেন এবং সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও একাত্মতার অঙ্গীকার নবায়ন করেন।
বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের কাছে হজ এক গভীর আকাঙ্ক্ষার নাম। এ দেশের গ্রাম থেকে শহর, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মেট্রোপলিস পর্যন্ত হাজারও মানুষ প্রতিদিন স্বপ্ন দেখেন একবার হলেও পবিত্র কাবাঘর দর্শনের। কারও জন্য এটি আজীবনের সঞ্চয়ের ফসল, কারও জন্য অশ্রুভেজা প্রার্থনার উত্তর।
এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের হজ ব্যবস্থাপনায় ক্রমাগত উন্নতি দেশের সম্মান ও মর্যাদাকে যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি হজযাত্রীদের মানসিক প্রশান্তিতেও বড় অবদান রাখছে।
হজ ব্যবস্থাপনায় চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
যদিও অনেক উন্নয়ন হয়েছে, তারপরও এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। হজযাত্রীদের নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আরও বাড়াতে হবে। হজ এজেন্সির তদারকি কঠোর করতে হবে। প্রতারকচক্রের বিরুদ্ধে নিয়মিত ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ ছাড়া হজ প্রোগ্রামে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার আরও উন্নয়ন দরকার, যেন হজযাত্রীদের যেকোনো সমস্যায় তাৎক্ষণিক সমাধান দেওয়া সম্ভব হয়। মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ও হজ ইনফরমেশন সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে এ প্রয়াস আরও জোরদার করা যেতে পারে।
শেষ কথা
বাংলাদেশের হজ ব্যবস্থাপনায় সাম্প্রতিক উন্নতি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে, যেন আগামী বছরগুলোতে আরও বেশি মানুষ নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও সম্মানজনকভাবে হজ পালন করতে পারেন।
হজ একটি মহান আত্মিক ভ্রমণ, যেখানে হৃদয় পরিশুদ্ধ হয়, জীবনের গভীরতর অর্থ উপলব্ধি হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি হজযাত্রী যেন নিরাপদে হজ সম্পন্ন করে এবং দেশে ফিরে আসেন, এই কামনাই আজ আমাদের সবার।
লেখক: গণসংযোগ কর্মকর্তা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন
bbqif1983@gmail.com