স্বপ্নের ডানায় ভর করে শিশুশ্রমের শৃঙ্খল ভাঙা কি আদৌ সম্ভব?

জাকির আহমদ খান কামাল
প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৫, ১৯: ৪৯

১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শিশুশ্রম বন্ধ করতে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করে। সেই সুবাদে ২০০২ সালের ১২ জুন থেকে প্রতিবছর বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়ে আসছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল— ‘স্বপ্নের ডানায় ভর করি,/ শিশুশ্রমের শৃঙ্খল ছিড়ি,/ এগিয়ে চলি দৃপ্ত পায়ে,/ আশার আগুন বুকে জ্বালি।’ ১২ জুন ঈদুল আজহার ছুটি থাকায় দিবসটি পালন করা হয় ১৯ জুন।

দেশে প্রায় ৩৫ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে এবং ১০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত— এ তথ্য জানিয়ে শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, শিশুশ্রম প্রতিরোধে শিশুদের কাজে নিয়োগ করা ব্যক্তিদের শাস্তি কয়েকগুণ বাড়ানো হবে। সেই সঙ্গে পরিবর্তন করা হবে শিশুশ্রমের সংজ্ঞা।

এরই ধারাবাহিকতায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আলোচনা সভা, র‍্যালি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশু, যারা সবেতন বা অবৈতনিক হিসেবে দৈনিক এক বা একাধিক ঘণ্টা কাজ করে তাদের শিশু শ্রমিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্যদিকে জাতিসংঘের শিশু জরুরি তহবিল (ইউনিসেফ) শিশুশ্রমকে এমন কার্যকলাপকে সংজ্ঞায়িত করে, যা শিশুর স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে প্রভাবিত করে।

যদি শিশুশ্রম আটকানো না যায়, তাহলে স্বপ্ন দেখা শিশুর স্বপ্নগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ ধারায় শিশুদের সুবিধাপ্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে। এ নিয়ে বিশেষ আইনও রয়েছে, যা শ্রম আইন ২০০৬ নামে পরিচিত।

এই আইনে বলা রয়েছে, কাজে যোগদানের বয়স কমপক্ষে ১৪ বছর, আর ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে ১৮ বছর। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, ১৪ বছর হওয়ার আগেই শিশুদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করা হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য যেসব কাজ ঝুঁকিপূর্ণ, সেসব কাজেও কোমলমতি শিশুদের নিয়োগ করা হচ্ছে। এর একটি প্রধান কারণ হলো— শিশু শ্রমিকদের তুলনামূলকভাবে কম মজুরি দিয়ে কাজ করানো যায়। তাই নিয়োগকারীরা শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগায় এবং কাজ বেশি করিয়ে নেয়।

শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ শ্রম আইন (সংশোধন) ২০১৮-এর খসড়ায় বলা রয়েছে, কেউ শিশু শ্রমিক নিয়োগ দিলে তাকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। কিন্তু অশিক্ষা, অসচেতনতা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে শিশুশ্রমমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে প্রধান বাধা। তাই শিশুশ্রম রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

কথায় আছে— ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।’ বর্তমানে কথাটির যথার্থতা কি আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় বিদ্যমান? নিঃসন্দেহে এর অর্থ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। কারণ বর্তমান সময়ে শিশুশ্রম একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিরাট একটি অংশ নিজেদের সক্রিয়তা হারাতে বসেছে।

দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের ভরণপোষণ ও শিক্ষার খরচ মেটাতে পারে না। তাই শিশুরা কাজে যেতে বাধ্য হয়। পরিবারের আর্থিক সংকট শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত হতে বাধ্য করে। কারণ তারা মনে করে, তাদের কাজ করা দরকার পরিবারের জন্য।

অনেক ক্ষেত্রে শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। তাদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থাকে না। ফলে তারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়। শুধু তাই নয়, সমাজের কিছু অংশে শিশুদের কাজ করাকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখা হয় এবং তাদের শিক্ষার চেয়ে কাজকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।

কিছু ক্ষেত্রে অবহেলা বা যত্নের ঘাটতির কারণেও শিশুরা শ্রমে লিপ্ত হতে পারে। অনেক সময় শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য যে আইন ও নীতি রয়েছে, সেগুলো আবার সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয় না। এটিও শিশুশ্রমের একটি কারণ।

বাস্তবতার কাছে হার মানতে হচ্ছে দরিদ্র ও অসচ্ছল পরিবারগুলোকে। তাই পরিবারের দায়িত্ব শিশুদের কাঁধে তুলে দিয়ে অভিভাবকরা নিজেদের অজান্তেই তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। কল-কারখানা থেকে শুরু করে পাথর ভাঙা, মানুষের বাসাবাড়ি নির্মাণ, বিভিন্ন হোটেল-রেস্টুরেন্ট, গাড়ির গ্যারেজসহ অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে ফেলছেন শিশুদের।

এ বছরের বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবসে আইএলও ও ইউনিসেফ যৌথ উদ্যোগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক প্রচেষ্টার ফলে শিশুশ্রম উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ২০২৪ সালে বিশ্বে প্রায় ১৩ কোটি ৮০ লাখ শিশুশ্রমে যুক্ত ছিল, যার মধ্যে পাঁচ কোটি ৪০ লাখ শিশুই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। এ কারণে তাদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের হার ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২২ সালে তা কমে ২ দশমিক ৭ শতাংশ (প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার শিশু) হয়েছে। তবে একই সময়ে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে শ্রমে যুক্ত থাকার সামগ্রিক হার ৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে সামান্য বেড়ে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে। ক্ষতিকর কাজে যুক্ত শিশুশ্রমের হারও ৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।

ইউনিসেফের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, গত দুই দশকে বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বাড়ায় বাংলাদেশের অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম নির্মূলের লক্ষ্যে পৌঁছানোর সঠিক গতিতে নেই বাংলাদেশ। শ্রমে যুক্ত অধিকাংশ শিশু কাজ করছে অনানুষ্ঠানিক খাতে, যেখানে তারা দীর্ঘ সময় ধরে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।

শিশুশ্রম শিশুদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি তাদের শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে সীমিত করে দেয়।

সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হলে শিশুশ্রমের সংজ্ঞা পরিবর্তন এবং শিশুদের কাজে নিয়োগকারী ব্যক্তিদের শাস্তি কয়েকগুণ বাড়ানো দরকার। সংজ্ঞা পরিবর্তন ও শাস্তি বৃদ্ধি শিশুশ্রম প্রতিরোধে কতটুকু সহায়ক হবে, তা সময়সাপেক্ষে। তবে সবার আগে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন ও প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগ। পাশাপাশি দারিদ্র্য নিরসন, শিক্ষার প্রসার, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং হতদরিদ্র পরিবারগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা দানের সঙ্গে প্রয়োজন শিশু অধিকার সংশ্লিষ্ট আইনগুলোর সঠিক প্রয়োগ। সে ক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতি আমার আহ্বান থাকবে— সরকারের পাশাপাশি আপনারাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। কেননা সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই কেবল শিশুশ্রমমুক্ত সমাজ গড়তে পারে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও কলাম লেখক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

মহররমের প্রথম ১০ দিন: ইতিহাস, আমল ও করণীয়

বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর জন্য এই ১০ দিন শুধু আবেগ নয়, আত্মশুদ্ধি ও আত্মজিজ্ঞাসারও উপলক্ষ্য। ইসলামি ইতিহাসে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেমন— আশুরা দিবস, তেমনিভাবে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত এ মাসকে দিয়েছে অমরতা।

১০ দিন আগে

নীরবেই চলে গেলেন ভাষাবিজ্ঞানী শফিউল আলম

আমি শফিউল আলম স্যারের সরাসরি ছাত্র। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এ ভবিষ্যৎবাণী করেছিলাম। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কথাটা সত্য হলো। ২০২৫ সালের ২৪শে জুন তিনি পরলোকে গমন করলেন, অত্যন্ত চুপিসারে, কাউকে না জানিয়ে। ২৩শে জুন দিবাগত রাত ৩টায়—ঘড়ির কাঁটায় তখন ২৪শে জুন শুরু হয়েছে। এ নিয়ে কোনো কাগজে খবর প্রকাশিত হয়নি। আমাদ

১৩ দিন আগে

সংকটের দোলাচলে দেশের অর্থনীতি

নতুন অর্থবছরের জন্য ৭ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের এই বাজেট আগামী ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হবে। গত ২ জুন ঘোষিত বাজেটে কী ছিল এবং পরবর্তীতে কী অনুমোদিত হয়েছে, এ নিয়ে জনমনে কৌতূহল থাকারই কথা।

১৩ দিন আগে

একটি মেয়ে, একটি পরীক্ষা— এক নিষ্ঠুর প্রত্যাখ্যান

বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫। একবিংশ শতকে এসেও আমরা এমন একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছি, যেখানে একজন ছাত্রী পরীক্ষা কেন্দ্রে এসে পৌঁছেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি পেল না! এই শিক্ষার্থী একজন বাবাহীন কন্যা, যে মাকে হাসপাতালে রেখে এসেছে শুধু পরীক্ষা দিতে। অথচ তাকে ঘরে ফেরত যেতে হলো!

১৪ দিন আগে