সজীব রহমান
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট রাতেও তখনকার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ে বৈঠক হয়েছে। সেখানে আলোচনা হয়েছে কীভাবে আন্দোলন দমন করা যায়। পরদিন ৫ আগস্ট সকাল ১০টা পর্যন্ত ঢাকায় পুলিশের শক্তিশালী অবস্থান ছিল। ১১টার দিকে উত্তরা দিয়ে লাখ লাখ জনতা ঢাকায় ঢুকতে শুরু করলে এবং সেনাবাহিনী তাদের বাধা না দিলে তখন গিয়ে পুলিশ তাদের অবস্থান ছেড়ে দিতে শুরু করে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারের মুখোমুখি বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জবানবন্দিতে এসব তথ্য দিয়েছেন। গত মার্চের শেষ সপ্তাহে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই জুলাই আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র বা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
জুলাই আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের ওই মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
গত ১০ জুলাই এই তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এর মাধ্যমে জুলাইয়ের প্রথম কোনো মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু হয়। এ দিনই আদালতে ‘আমি জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত’ বলে অপরাধের দায় স্বীকার করেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। বলেন, তিনি রাজসাক্ষী হয়ে জুলাই আন্দোলনের সময়কার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ আদালতকে দেবেন।
এর আগেই গত ২৪ মার্চ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. জাকির হোসাইনের আদালতে জবানবন্দি দেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের শেষ তিন দিনে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকার চিত্রও তার এই জবানবন্দিতে উঠে এসেছে।
সাবেক আইজিপি অবশ্য বারবারই জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে নির্যাতন-নিপীড়নের দায় সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছেন। পুলিশ প্রধান হিসেবে ‘লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী’ বলে দায় সেরেছেন।
জবানবন্দিতে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ৩ আগস্ট সকাল ১১টায় গণভবনে তখনকার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তিন বাহিনীর প্রধানসহ তিনিও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আন্দোলন দমন করার বিষয়ে আলোচনা হয়। পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
জবানবন্দিতে বলা হয়েছে, ‘গোয়েন্দা প্রতিবেদন জানায় যে আন্দোলন গুরুতর পর্যায়ে চলে গেছে। তা দমন করা প্রয়োজন। সরকারের পরিবর্তন বা পতন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা চেষ্টা করেছি সরকারকে সঠিক তথ্য দিতে। সরকার তার দুর্বলতা শুনতে প্রস্তুত ছিল না।’ ওই বৈঠক চলাকালেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকলে বৈঠক মুলতবি করা হয় বলে জানান সাবেক আইজিপি।
৪ আগস্ট রাতে ফের গণভবনে বৈঠক ডাকেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে বৈঠকে শেখ হাসিনার বোন শেখ রোহানা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তিন বাহিনীর প্রাধান, সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, র্যাবের মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন তখনকার আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের জিওসি ও সাবেক এসএসএফ মহাপরিচালক (পরে বরখাস্ত) জেনারেল মুজিবুর রহমান। বৈঠককক্ষের বাইরে ছিলেন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলাম ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিআফআই) মহাপরিচালক।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ফাইল ছবি
জবানবন্দিতে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জবানবন্দিতে বলেন, ‘বৈঠকে খোলামেলা কথা হয়। ৫ আগস্ট কীভাবে আন্দোলন ও গণজমায়েত দমন করা যায়, তা নিয়ে কথা হয়। বাহিনী (ফোর্স) মোতায়েন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। প্রায় ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট বৈঠক হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বৈঠক শেষে আমি সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে চলে যাই। তিন বাহিনীর প্রধান, মেজর জেনারেল মুজিব, ডিজি র্যাব, গোয়েন্দা বাহিনী, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও আমি নিজে ছিলাম। সেখানে বাহিনী মোতায়েন নিয়ে কথা হয়। বৈঠক প্রায় রাত সাড়ে ১২টায় শেষ হয়।’
ওই বৈঠকে ঢাকা শহর ও ঢাকার প্রবেশমুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত হয়, সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে পুলিশ। পুলিশ প্রধান হিসেবে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের পর্যবেক্ষণ, ৫ আগস্ট সকাল ১০টা পর্যন্তও ঢাকার ভেতরে পুলিশের শক্ত অবস্থান ছিল।
সাবেক আইজিপি জবানবন্দিতে বলেন, এ সময় ঢাকার প্রবেশমুখ উত্তরা ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয়। আমি তখন পুলিশ সদর দপ্তরে অবস্থান গ্রহণ করি। ডিএমপি কমিশনারসহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ কর্মকর্তারা ঢাকা পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ছিলেন। সেখান থেকে তারা নির্দেশনা দিতে থাকেন।
তবে এসব নির্দেশনায় কাজ হয়নি। লাখ লাখ মানুষ সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে গণভবনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এই জনস্রোত আর আটকানো সম্ভব হয়নি বলে স্বীকার করে নিয়েছেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ১১টার দিকে উত্তরা থেকে লাখ লাখ লোক ঢাকার ভেতরে আসতে শুরু করেন। তখন জানতে পারি, সেনাবাহিনী তাদের বাধা দেয়নি। সেনাবাহিনীর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও বাহিনী আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেন। এর ফলে জনগণের গণভবন মুখী জনস্রোতকে দমন ও আটকানো সম্ভব হয়নি।
দুপুর সাড়ে ১২টা/১টার দিকে সরকার পতনের বিষয়টি বুঝতে পারেন বলে জানিয়েছেন সাবেক পুলিশ প্রধান। তিনি বলেন, দুপুর ১টার দিকে ঢাকার ভেতরে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পিএমও (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) থেকে আমাদের বলা হয় মহাখালী এলাকায় জনস্রোত আটকানোর জন্য। দুপুর সাড়ে ১২টা/১টার মধ্যে বুঝতে পারি, সরকারের পতন হবে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, এটা আমি এসবির মাধ্যমে জানতে পারি। তিনি ভারতে যাবেন কি না, তা জানতে পারিনি। সেনাবাহিনী তা জানায়নি।
জুলাইয়ের শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলেও মূলত ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার চীন সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনের পর রাত থেকে সে আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। এর মধ্যে ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদসহ ঢাকা ও চট্টগ্রামে আরও পাঁচজনের প্রাণহানি আন্দোলনকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। আন্দোলন দমনের কলাকৌশল ঠিক করতে ১৯ জুলাই থেকে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক হতো।
ওইসব বৈঠকে স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলম, অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক) টিপু সুলতান, অতিরিক্ত সচিব রেজা মোস্তাফা, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদ, র্যাবের মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুনুর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকি, আনসার মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হক, এনটিএমসির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান ও ডিজিএফআই প্রধানরা উপস্থিত থাকতেন।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জবানবন্দিতে বলেন, আসাদুজ্জমান খান কামালের বাসায় ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতে ৮টা/৯টার দিকে কোর কমিটির মিটিং হতো। আমি কোর কমিটির সদস্য হিসেবে মিটিং সময়ে উপস্থিত থাকতাম। সেখানে আন্দোলন দমন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারের বিভিন্ন নির্দশনা ও পরামর্শ আমাদের সঙ্গে করতেন।
গত বছরের ২২ জুলাই যাত্রাবাড়ী এলাকা পরিদর্শন করেন তখনকার আইজিপির দায়িত্বে থাকা চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। এ সময় এসবির প্রধান মনিরুল ইসলাম ও র্যাবের মহাপরিচালক হারুন-অর-রশিদ তার সঙ্গে ছিলেন। ছবি: সংগৃহীত
সাবেক আইজিপি জানাচ্ছেন, কোর কমিটির এমনই একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়দের আটকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়, যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিজিএফআই মহাপরিচালক ও ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদকে। ছাত্র আন্দোলনের সময় ডিবি কার্যালয়ে নাহিদ ইসলামসহ ছয় সমন্বয়ককে কয়েকদিন আটকে রাখা, তাদের দিয়ে জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা— এসব সিদ্ধান্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বলে জানিয়েছেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তার দাবি, কোর কমিটির বৈঠকে সমন্বয়কদের আটকের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি।
আন্দোলন দমন করতে হেলিকপ্টার মোতায়েন ও মারণাস্ত্র বা প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারের পক্ষে ছিলেন না এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাকে না জানিয়েই সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জবানবন্দিতে দাবি করেছেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। এসব সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক ছিল বলেও জানান তিনি।
তার ভাষ্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাইতেন যেকোনো মূল্যে আন্দোলন দমন করা হোক। শেখ হাসিনা নিজেই আসাদুজ্জামান খান কামালকে আন্দোলন দমন করতে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করতে বলেছিলেন বলে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে অতি উৎসাহী ছিলেন।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে একপর্যায়ে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আন্দোলনকে নজরদারি, গুলি করা ও ভীতিকর পরিবেশ তৈরির গোপন পরিকল্পনা করা হয়। আমি পরে জানতে পারি, র্যাব মহাপরিচালকের পরিকল্পনায় ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় হেলিকপ্টার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। পুলিশপ্রধান হিসাবে আমি ওই কার্যক্রমের যুক্ত ছিলাম না। মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয়।
প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার প্রসঙ্গে জবানবন্দিকে সাবেক পুলিশ প্রধান বলেন, আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে পরে সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র (লিথ্যাল উইপন) ও আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলোতে এলাকা ভাগ করে ব্লক রেইড পরিচালনার সিদ্ধান্ত সরাসরি রাজনৈতিকভাবে নেওয়া হয়। আসাদুজ্জামান খান কামাল নিজে আমাকে জানান, শেখ হাসিনার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন দমন করার জন্য প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এ সময় আমার সামনে অ্যাডিশনাল ডিআইজি (হেডকোয়ার্টার) প্রলয় জোয়াদ্দার উপস্থিত ছিলেন। তার মাধ্যমে ডিএমপি কমিশনারসহ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ওই নির্দেশনা (প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার) জানতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, এ ছাড়া ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরাসরি যোগাযোগ ছিল। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে অতি উৎসাহী ছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাইতেন, যেকোনোভাবেই হোক আন্দোলন দমন করতে হবে। ১৮ জুলাই ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান প্রকাশ্যে চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সাবেক পুলিশ প্রধানের দাবি, ওই সময়কার মন্ত্রিসভার সদস্যসহ রাজনৈতিক নেতৃত্ব জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমন করতে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারে উসকানি দিয়েছেন। আন্দোলন নির্মূল করার জন্যও তারা তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উসকানি দিতেন। এ ক্ষেত্রে তখনকার ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানকে তিনি মারণাস্ত্র ব্যবহারের জন্য দায়ী করেছেন।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জবানবন্দিতে বলেন, আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, সাবেক তথ্য ও সম্প্রাচার প্রতিমন্ত্রী মো. আলী আরাফাত, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন মারণাস্ত্র ব্যবহার করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে নির্মূল করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ এবং উসকানি দিতেন। দেশব্যাপী এত বেশি মানুষ মারা গেলেও তারা উসকানি বন্ধ করেননি কিংবা প্রধানমন্ত্রীকে থামতে বলেননি।
জবানবন্দিতে আরও বলা হয়েছে, ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর নৃশংস হামলা করে। সেখানে পুলিশ সঠিক ভূমিকা পালন করেনি। সেখানে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশে পুলিশ কাজ করে। ওবায়দুল কাদের ও জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ কিছু নেতা ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেন। আন্দোলন দমন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে র্যাব ও সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনী মোতায়েন করা হয়। আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার ব্যবহার ও প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে অনেক মানুষকে হতাহত করে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ফাইল ছবি
জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে ব্যাপক বলপ্রয়োগ এবং সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানি যখন ঘটেছে তখন পুলিশ বাহিনীর প্রধান ছিলেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তবে নির্বিচারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বলপ্রয়োগ ও হত্যার জন্য নিজেকে খুব একটা দায়ী বলে জবানবন্দিতে কোথাও উল্লেখ করেননি তিনি। এ ক্ষেত্রে নিজেকে বাদ দিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল থেকে শুরু করে শীর্ষস্থানীয় কিছু পুলিশ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা এবং এমনকি বুদ্ধিজীবী মহল ও সাংবাদিকদের দায় দেখছেন তিনি।
জবানবন্দিতে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, সরকারকে বিপথে পরিচালিত করে ও আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করার জন্য আওয়ামী লীগপন্থি বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, পুলিশ কর্মকর্তা সবাই আগ্রহী ছিলেন। ওবায়দুল কাদের অগ্রাসী বক্তব্য দেন। বক্তব্যের ফলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে যায়। ওবায়দুল কাদের ও নানক সাহেব ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে নির্দেশনা দিতেন।
নিজে পুলিশপ্রধান হিসেবে সরকারি নির্দেশ পালন ও অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তাদের কার্যক্রমের জন্য অনুতপ্ত বলে জানিয়েছেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। জবানবন্দির শেষভাগে গিয়ে তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে গিয়ে সরকারের নির্দেশনায় এবং অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তা ও পুলিশ বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ এবং জনগণের ওপর গুলি করাসহ নির্বাচারে নির্যাতন, গ্রেপ্তার ও অসংখ্য মানুষকে আহত ও হত্যা করায় সাবেক পুলিশপ্রধান হিসাবে আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট রাতেও তখনকার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ে বৈঠক হয়েছে। সেখানে আলোচনা হয়েছে কীভাবে আন্দোলন দমন করা যায়। পরদিন ৫ আগস্ট সকাল ১০টা পর্যন্ত ঢাকায় পুলিশের শক্তিশালী অবস্থান ছিল। ১১টার দিকে উত্তরা দিয়ে লাখ লাখ জনতা ঢাকায় ঢুকতে শুরু করলে এবং সেনাবাহিনী তাদের বাধা না দিলে তখন গিয়ে পুলিশ তাদের অবস্থান ছেড়ে দিতে শুরু করে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারের মুখোমুখি বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জবানবন্দিতে এসব তথ্য দিয়েছেন। গত মার্চের শেষ সপ্তাহে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেই জুলাই আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র বা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
জুলাই আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের ওই মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
গত ১০ জুলাই এই তিন আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এর মাধ্যমে জুলাইয়ের প্রথম কোনো মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু হয়। এ দিনই আদালতে ‘আমি জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত’ বলে অপরাধের দায় স্বীকার করেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। বলেন, তিনি রাজসাক্ষী হয়ে জুলাই আন্দোলনের সময়কার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ আদালতকে দেবেন।
এর আগেই গত ২৪ মার্চ ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম মো. জাকির হোসাইনের আদালতে জবানবন্দি দেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের শেষ তিন দিনে সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকার চিত্রও তার এই জবানবন্দিতে উঠে এসেছে।
সাবেক আইজিপি অবশ্য বারবারই জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে নির্যাতন-নিপীড়নের দায় সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছেন। পুলিশ প্রধান হিসেবে ‘লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী’ বলে দায় সেরেছেন।
জবানবন্দিতে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ৩ আগস্ট সকাল ১১টায় গণভবনে তখনকার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিরাপত্তা সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও তিন বাহিনীর প্রধানসহ তিনিও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আন্দোলন দমন করার বিষয়ে আলোচনা হয়। পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
জবানবন্দিতে বলা হয়েছে, ‘গোয়েন্দা প্রতিবেদন জানায় যে আন্দোলন গুরুতর পর্যায়ে চলে গেছে। তা দমন করা প্রয়োজন। সরকারের পরিবর্তন বা পতন নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। আমরা চেষ্টা করেছি সরকারকে সঠিক তথ্য দিতে। সরকার তার দুর্বলতা শুনতে প্রস্তুত ছিল না।’ ওই বৈঠক চলাকালেই পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকলে বৈঠক মুলতবি করা হয় বলে জানান সাবেক আইজিপি।
৪ আগস্ট রাতে ফের গণভবনে বৈঠক ডাকেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে বৈঠকে শেখ হাসিনার বোন শেখ রোহানা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তিন বাহিনীর প্রাধান, সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, র্যাবের মহাপরিচালক উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন তখনকার আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের জিওসি ও সাবেক এসএসএফ মহাপরিচালক (পরে বরখাস্ত) জেনারেল মুজিবুর রহমান। বৈঠককক্ষের বাইরে ছিলেন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলাম ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিআফআই) মহাপরিচালক।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ফাইল ছবি
জবানবন্দিতে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জবানবন্দিতে বলেন, ‘বৈঠকে খোলামেলা কথা হয়। ৫ আগস্ট কীভাবে আন্দোলন ও গণজমায়েত দমন করা যায়, তা নিয়ে কথা হয়। বাহিনী (ফোর্স) মোতায়েন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। প্রায় ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট বৈঠক হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘বৈঠক শেষে আমি সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে চলে যাই। তিন বাহিনীর প্রধান, মেজর জেনারেল মুজিব, ডিজি র্যাব, গোয়েন্দা বাহিনী, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও আমি নিজে ছিলাম। সেখানে বাহিনী মোতায়েন নিয়ে কথা হয়। বৈঠক প্রায় রাত সাড়ে ১২টায় শেষ হয়।’
ওই বৈঠকে ঢাকা শহর ও ঢাকার প্রবেশমুখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত হয়, সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে পুলিশ। পুলিশ প্রধান হিসেবে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের পর্যবেক্ষণ, ৫ আগস্ট সকাল ১০টা পর্যন্তও ঢাকার ভেতরে পুলিশের শক্ত অবস্থান ছিল।
সাবেক আইজিপি জবানবন্দিতে বলেন, এ সময় ঢাকার প্রবেশমুখ উত্তরা ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয়। আমি তখন পুলিশ সদর দপ্তরে অবস্থান গ্রহণ করি। ডিএমপি কমিশনারসহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ কর্মকর্তারা ঢাকা পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ছিলেন। সেখান থেকে তারা নির্দেশনা দিতে থাকেন।
তবে এসব নির্দেশনায় কাজ হয়নি। লাখ লাখ মানুষ সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে গণভবনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এই জনস্রোত আর আটকানো সম্ভব হয়নি বলে স্বীকার করে নিয়েছেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ১১টার দিকে উত্তরা থেকে লাখ লাখ লোক ঢাকার ভেতরে আসতে শুরু করেন। তখন জানতে পারি, সেনাবাহিনী তাদের বাধা দেয়নি। সেনাবাহিনীর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও বাহিনী আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেন। এর ফলে জনগণের গণভবন মুখী জনস্রোতকে দমন ও আটকানো সম্ভব হয়নি।
দুপুর সাড়ে ১২টা/১টার দিকে সরকার পতনের বিষয়টি বুঝতে পারেন বলে জানিয়েছেন সাবেক পুলিশ প্রধান। তিনি বলেন, দুপুর ১টার দিকে ঢাকার ভেতরে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পিএমও (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) থেকে আমাদের বলা হয় মহাখালী এলাকায় জনস্রোত আটকানোর জন্য। দুপুর সাড়ে ১২টা/১টার মধ্যে বুঝতে পারি, সরকারের পতন হবে। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, এটা আমি এসবির মাধ্যমে জানতে পারি। তিনি ভারতে যাবেন কি না, তা জানতে পারিনি। সেনাবাহিনী তা জানায়নি।
জুলাইয়ের শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলেও মূলত ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার চীন সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনের পর রাত থেকে সে আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। এর মধ্যে ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদসহ ঢাকা ও চট্টগ্রামে আরও পাঁচজনের প্রাণহানি আন্দোলনকে অপ্রতিরোধ্য করে তোলে। আন্দোলন দমনের কলাকৌশল ঠিক করতে ১৯ জুলাই থেকে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক হতো।
ওইসব বৈঠকে স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলম, অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক) টিপু সুলতান, অতিরিক্ত সচিব রেজা মোস্তাফা, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদ, র্যাবের মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুনুর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার মো. হাবিবুর রহমান, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকি, আনসার মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হক, এনটিএমসির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান ও ডিজিএফআই প্রধানরা উপস্থিত থাকতেন।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জবানবন্দিতে বলেন, আসাদুজ্জমান খান কামালের বাসায় ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতে ৮টা/৯টার দিকে কোর কমিটির মিটিং হতো। আমি কোর কমিটির সদস্য হিসেবে মিটিং সময়ে উপস্থিত থাকতাম। সেখানে আন্দোলন দমন থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হতো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারের বিভিন্ন নির্দশনা ও পরামর্শ আমাদের সঙ্গে করতেন।
গত বছরের ২২ জুলাই যাত্রাবাড়ী এলাকা পরিদর্শন করেন তখনকার আইজিপির দায়িত্বে থাকা চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। এ সময় এসবির প্রধান মনিরুল ইসলাম ও র্যাবের মহাপরিচালক হারুন-অর-রশিদ তার সঙ্গে ছিলেন। ছবি: সংগৃহীত
সাবেক আইজিপি জানাচ্ছেন, কোর কমিটির এমনই একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়দের আটকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়, যা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় ডিজিএফআই মহাপরিচালক ও ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদকে। ছাত্র আন্দোলনের সময় ডিবি কার্যালয়ে নাহিদ ইসলামসহ ছয় সমন্বয়ককে কয়েকদিন আটকে রাখা, তাদের দিয়ে জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা— এসব সিদ্ধান্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বলে জানিয়েছেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তার দাবি, কোর কমিটির বৈঠকে সমন্বয়কদের আটকের বিরোধিতা করেছিলেন তিনি।
আন্দোলন দমন করতে হেলিকপ্টার মোতায়েন ও মারণাস্ত্র বা প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারের পক্ষে ছিলেন না এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাকে না জানিয়েই সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জবানবন্দিতে দাবি করেছেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। এসব সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক ছিল বলেও জানান তিনি।
তার ভাষ্য, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাইতেন যেকোনো মূল্যে আন্দোলন দমন করা হোক। শেখ হাসিনা নিজেই আসাদুজ্জামান খান কামালকে আন্দোলন দমন করতে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করতে বলেছিলেন বলে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে অতি উৎসাহী ছিলেন।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে একপর্যায়ে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আন্দোলনকে নজরদারি, গুলি করা ও ভীতিকর পরিবেশ তৈরির গোপন পরিকল্পনা করা হয়। আমি পরে জানতে পারি, র্যাব মহাপরিচালকের পরিকল্পনায় ও সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় হেলিকপ্টার কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। পুলিশপ্রধান হিসাবে আমি ওই কার্যক্রমের যুক্ত ছিলাম না। মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয়।
প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার প্রসঙ্গে জবানবন্দিকে সাবেক পুলিশ প্রধান বলেন, আন্দোলন দমন করার উদ্দেশ্যে পরে সরাসরি প্রাণঘাতী অস্ত্র (লিথ্যাল উইপন) ও আন্দোলনপ্রবণ এলাকাগুলোতে এলাকা ভাগ করে ব্লক রেইড পরিচালনার সিদ্ধান্ত সরাসরি রাজনৈতিকভাবে নেওয়া হয়। আসাদুজ্জামান খান কামাল নিজে আমাকে জানান, শেখ হাসিনার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন দমন করার জন্য প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এ সময় আমার সামনে অ্যাডিশনাল ডিআইজি (হেডকোয়ার্টার) প্রলয় জোয়াদ্দার উপস্থিত ছিলেন। তার মাধ্যমে ডিএমপি কমিশনারসহ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ওই নির্দেশনা (প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার) জানতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, এ ছাড়া ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সরাসরি যোগাযোগ ছিল। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারে অতি উৎসাহী ছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাইতেন, যেকোনোভাবেই হোক আন্দোলন দমন করতে হবে। ১৮ জুলাই ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান প্রকাশ্যে চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সাবেক পুলিশ প্রধানের দাবি, ওই সময়কার মন্ত্রিসভার সদস্যসহ রাজনৈতিক নেতৃত্ব জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমন করতে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারে উসকানি দিয়েছেন। আন্দোলন নির্মূল করার জন্যও তারা তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উসকানি দিতেন। এ ক্ষেত্রে তখনকার ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানকে তিনি মারণাস্ত্র ব্যবহারের জন্য দায়ী করেছেন।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন জবানবন্দিতে বলেন, আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, সাবেক তথ্য ও সম্প্রাচার প্রতিমন্ত্রী মো. আলী আরাফাত, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ও ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন মারণাস্ত্র ব্যবহার করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে নির্মূল করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ এবং উসকানি দিতেন। দেশব্যাপী এত বেশি মানুষ মারা গেলেও তারা উসকানি বন্ধ করেননি কিংবা প্রধানমন্ত্রীকে থামতে বলেননি।
জবানবন্দিতে আরও বলা হয়েছে, ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর নৃশংস হামলা করে। সেখানে পুলিশ সঠিক ভূমিকা পালন করেনি। সেখানে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশে পুলিশ কাজ করে। ওবায়দুল কাদের ও জাহাঙ্গীর কবির নানকসহ কিছু নেতা ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেন। আন্দোলন দমন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে র্যাব ও সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনী মোতায়েন করা হয়। আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার ব্যবহার ও প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে অনেক মানুষকে হতাহত করে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ফাইল ছবি
জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে ব্যাপক বলপ্রয়োগ এবং সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানি যখন ঘটেছে তখন পুলিশ বাহিনীর প্রধান ছিলেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তবে নির্বিচারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বলপ্রয়োগ ও হত্যার জন্য নিজেকে খুব একটা দায়ী বলে জবানবন্দিতে কোথাও উল্লেখ করেননি তিনি। এ ক্ষেত্রে নিজেকে বাদ দিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল থেকে শুরু করে শীর্ষস্থানীয় কিছু পুলিশ কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা এবং এমনকি বুদ্ধিজীবী মহল ও সাংবাদিকদের দায় দেখছেন তিনি।
জবানবন্দিতে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, সরকারকে বিপথে পরিচালিত করে ও আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমন করার জন্য আওয়ামী লীগপন্থি বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, পুলিশ কর্মকর্তা সবাই আগ্রহী ছিলেন। ওবায়দুল কাদের অগ্রাসী বক্তব্য দেন। বক্তব্যের ফলে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে যায়। ওবায়দুল কাদের ও নানক সাহেব ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে নির্দেশনা দিতেন।
নিজে পুলিশপ্রধান হিসেবে সরকারি নির্দেশ পালন ও অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তাদের কার্যক্রমের জন্য অনুতপ্ত বলে জানিয়েছেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। জবানবন্দির শেষভাগে গিয়ে তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে গিয়ে সরকারের নির্দেশনায় এবং অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তা ও পুলিশ বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগ এবং জনগণের ওপর গুলি করাসহ নির্বাচারে নির্যাতন, গ্রেপ্তার ও অসংখ্য মানুষকে আহত ও হত্যা করায় সাবেক পুলিশপ্রধান হিসাবে আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ক্ষমাপ্রার্থী।
সাময়িকভাবে বরখাস্তকৃত কর্মকর্তারা হলেন চাঁদ সুলতানা চৌধুরানী, পরিচালক (চলতি দায়িত্ব), সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল, এনবিআর; মো. মামুন মিয়া, যুগ্ম কর কমিশনার, কর অঞ্চল-দিনাজপুর; মো. মেসবাহ উদ্দিন খান, যুগ্ম কর কমিশনার, কর অঞ্চল-ফরিদপুর; সেহেলা সিদ্দিকা, অতিরিক্ত কর কমিশনার, আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট
১৪ ঘণ্টা আগেনাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, গত জুনের হিসাব অনুযায়ী, তারা জেট ফুয়েল বিক্রি বাবদ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছে প্রায় ২১০০ কোটি টাকা পাবে। জুলাইয়ে কিছু বকেয়া পরিশোধ করেছে বিমান। তারপরও বকেয়ার পরিমাণ ২০০০ কোটি টাকার বেশি হবে। দেনার এ অর্থ পরিশোধ না করেই মুনাফা ঘোষণা করেছ
১৪ ঘণ্টা আগেমাইলস্টোনে বিমান দুর্ঘটনার পর এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিলম্বের ঘটনায় আলোচিত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে ২২ জুলাই প্রত্যাহার করা হয়। ২৩ জুলাই তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তি করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
১৪ ঘণ্টা আগেতথ্য অনুযায়ী, সোমবার কেন্দ্রে ৪৪২ জন মনোনয়ন নিয়েছেন। এছাড়াও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ৭১, ড. মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ হলে ৯৭, জগন্নাথ হলে ৬৬, ফজলুল হক মুসলিম হলে ৭৮, সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ৯৩, রোকেয়া হলে ৪৬, মাস্টার দা সূর্যসেন হলে ৯০, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে ৭৪, শামসুন্নাহার হলে ৩৭, কবি জসীম উদ্দিন হলে ৭৪
১৫ ঘণ্টা আগে