ইতিহাস
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ : ইতিহাসের রক্তক্ষয়ী বাঁক

ভারতের ইতিহাসে যুদ্ধের পাতাগুলো যতবার উল্টানো হয়, ততবারই একটি নাম চোখে পড়ে—পানিপথ। এই নাম যেন কেবল একটি জায়গা নয়, বরং একের পর এক রাজনীতির পালাবদলের সাক্ষী। তিনটি বিখ্যাত যুদ্ধ হয়েছে এই মাটিতে, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন, এবং সম্ভবত সবচেয়ে সিদ্ধান্তমূলক ছিল পানিপথের প্রথম যুদ্ধ। এটি সংঘটিত হয়েছিল ১৫২৬ সালের ২১শে এপ্রিল, মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর ও দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদির মধ্যে। এই যুদ্ধে শুধু দুইটি সেনার মুখোমুখি লড়াই হয়নি, মুখোমুখি হয়েছিল দুইটি সভ্যতা, দুইটি কৌশল, আর দুইটি ঐতিহাসিক ধারা।
১৫২৬ সালের আগে ভারতের শাসক ছিল দিল্লি সালতানাতের লোদি বংশ। এই বংশের তৃতীয় সুলতান ছিলেন ইব্রাহিম লোদি। কিন্তু তাঁর শাসন কঠোর, স্বেচ্ছাচারী এবং সৈন্যদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণে পরিপূর্ণ ছিল। তাঁর প্রশাসনকে ঘিরে অসন্তোষ বাড়ছিল। বহু রাজপুত, আফগান, এমনকি তাঁর নিজের আত্মীয়রাও চুপিসারে অন্য বিকল্প খুঁজছিল।
এই সময়েই আফগানিস্তানের কাবুল থেকে এক ব্যক্তি ভারতের দিকে আগ্রসর হচ্ছিলেন—তাঁর নাম জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর। তিনি ছিলেন তৈমুর লং ও চেঙ্গিস খানের বংশধর। তাঁর চোখ ছিল ভারতের বিপুল সম্পদ আর দুর্বল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে। বাবর ভারতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন বহু আগেই। তিনি পাঁচবার ভারত অভিযানে আসেন, কিন্তু পঞ্চমবারেই ঘটল সবচাইতে বড় পরিবর্তন।
১৫২৬ সালের এপ্রিলে পানিপথ নামক এক সমতল ময়দানে দাঁড়িয়েছিল বাবরের প্রায় ১২ হাজার সৈন্য, বিপরীতে ইব্রাহিম লোদির ১ লক্ষের বেশি সৈন্য ও ১০০০টি হাতি। বাহ্যিকভাবে এটা অসম যুদ্ধ ছিল। কিন্তু ইতিহাস কখনও সংখ্যায় লেখা হয় না, লেখা হয় কৌশলে।
বাবর তাঁর সেনাকে তিন ভাগে ভাগ করে সাজান এবং “তুলঘমা” নামক মধ্য এশিয়ার এক পুরনো কৌশল ব্যবহার করেন। তাছাড়া তিনি ভারী কামান ও তুর্কি বন্দুকধারীদের ব্যবহার করেন—যা ভারতীয় যুদ্ধক্ষেত্রে একেবারেই নতুন। কামান আর বন্দুকের শব্দে ইব্রাহিম লোদির হাতিরা ভীত হয়ে নিজেদের সৈন্যদের ওপরই চড়াও হয়।
এই যুদ্ধ চলেছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শেষে ইব্রাহিম লোদির মৃত্যু হয়, তাঁর ২০ হাজার সৈন্য নিহত হয়। বাবরের জন্য এটি ছিল শুধু একটি জয় নয়, বরং একটি যুগের শুরু।
এই যুদ্ধ নিয়ে বহু বিদেশি গবেষক বিশ্লেষণ করেছেন। কেউ একে "পূর্ব ও পশ্চিমের সংঘর্ষ" বলেছেন, কেউ দেখেছেন "কৌশলের জয়" হিসেবে।
ভারতীয় উপমহাদেশের সামরিক ইতিহাসবিদ ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ স্যার জর্জ বেকিংহাম বলেন: ‘অর্থাৎ, পানিপথ ছিল কেবল এক যুদ্ধ নয়, বরং মধ্যযুগীয় ভারতীয় যুদ্ধনীতি থেকে আধুনিক গানপাউডার সাম্রাজ্যের দিকে এক মোড়।’
বাবর দ্য ফাউন্ডার অব দ্য মুঘর এম্পায়ার ড. স্ট্যানলি লেন-পুল , বইয়ের লেখক, বলেন: বাবরের কৃতিত্ব ছিল তাঁর সংখ্যায় নয়, বরং ভবিষ্যৎ কল্পনায়। তিনি বিশৃঙ্খলায় শৃঙ্খলা এনেছিলেন।
আরও একজন গবেষক, জার্মান ঐতিহাসিক ইউলরিখ হারমেন তাঁর এক গবেষণাপত্রে লিখেছেন: ‘প্রথম পানিপথ যুদ্ধ মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তিগত কিংবদন্তি তৈরি করেছিল, যেখানে এক বিদেশি শাসক বলপ্রয়োগ ও গ্রহণযোগ্যতার মাধ্যমে স্থানীয় রাজা হয়ে উঠেছিলেন।’
ইব্রাহিম লোদির মৃত্যুর পর বাবর দিল্লি ও আগ্রা দখল করেন। কিন্তু মুঘল শাসন শুধু যুদ্ধ জিতে টিকে থাকেনি। বাবর তাঁর শাসনব্যবস্থায় তুলনামূলক স্থিতি, আইন, সংস্কৃতি ও সেনানীতি আনেন। যদিও বাবরের শাসনকাল ছিল মাত্র চার বছর, তবুও তাঁর ছেলেমেয়েরা এবং পরবর্তী প্রজন্ম ভারতীয় ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু করে—মুঘল সাম্রাজ্য, যা পরবর্তী দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে টিকে থাকবে।
বিরোধ ও সমালোচনা: শুধু বাহাদুরি নয়, রক্তও ছিল পানিপথের যুদ্ধ নিয়ে অনেক ঐতিহাসিক বলেন, এটি ছিল এক ‘বহিরাগত কর্তৃক দেশীয় শক্তিকে পদানত করার’ দৃষ্টান্ত। অনেকে বলেন, বাবরের আগমন শুধুই সাহস নয়, বরং স্থানীয় দুর্বল নেতৃত্ব ও বিভাজনের সুযোগ। যেমন ভারতীয় ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার লিখেছেন: ‘বাবরের জয় তাঁর বিদেশি সাহসিকতার জন্য নয়, বরং ভারতীয় রাজাদের একত্রিত না হওয়ার ফল।’
পানিপথ মানেই যেন রক্ত, ধুলো আর বিজয়ের উল্লাস। কিন্তু এর পেছনে থাকে পরাজয়ের বেদনা, পেছনে পড়ে থাকা মৃত সৈনিকদের গল্প, সম্পর্কের বিচ্ছেদ আর ইতিহাসের পৃষ্ঠা ওলটানোর শব্দ। পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সেই ধ্বনি যার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এক সাম্রাজ্য, এবং বন্ধ হয়েছিল এক বংশের ইতিহাস।
আজকের পাঠক বা ছাত্রছাত্রীর কাছে পানিপথ হয়তো একটি অধ্যায়, একটি প্রশ্নের অংশ। কিন্তু এই যুদ্ধ আসলে একটি আলাদা সময়ের দরজা খুলে দেয়—যেখানে ভারতে এসেছিল কামান, বন্দুক আর কৌশল; যেখানে রাজার আসন নির্ধারণ করেছিল সাহস আর সময়জ্ঞান।
সূত্র: হিস্ট্রি ডট কম