বিএনপি বনাম জামায়াত-এনসিপি-বাম— বিরোধ এবার নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে

শাহরিয়ার শরীফ
প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫, ১০: ৩০
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ। রাজনীতি ডটকম ফাইল ছবি

আলোচিত লন্ডন বৈঠকের তিন সপ্তাহের মাথায় ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের তারিখ নিয়ে আলোচনা যতটা কমেছে, ততটাই বেড়েছে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্ক। নতুন এই পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা ও বিতর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর অনড় অবস্থান নির্বাচন আয়োজনকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এই বিতর্কের একদিকে আছে বিএনপি ও সমমনা কয়েকটি দল। এই পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তোলার মধ্যে নতুন ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছে দলগুলো। তাই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিপক্ষে তাদের অবস্থান। আর অন্যদিকে আছে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল। এমনকি বাম দলগুলোও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের পক্ষে।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন না হলে ছোট দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা কঠিন। এ পদ্ধতিতে ইসলামি দল বা বাম দল, এমনকি নতুন দল এনসিপিরও সংসদে কিছু আসন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ থাকায় এবং জাতীয় পার্টিকে সরকার এড়িয়ে চলায় পিআর পদ্ধতি সম্পর্কে রাজনীতিতে তাদের মতের প্রতিফলন এখন পর্যন্ত নেই।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ জেসমিন টুলী রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে ভোট করার ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে। অনেক দেশ এ পদ্ধতিতে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে। তবে বাংলাদেশে এই আলোচনা শুরু হওয়াটা ভালো দিক। কিন্তু আগামী নির্বাচনেই এটি বাস্তবায়ন করতে হবে কিংবা করা যাবে— এমন চিন্তা করা কঠিন। কারণ আইন করাসহ সার্বিক প্রস্তুতির জন্য ছয় থেকে সাত মাস সময় অবশ্যই লাগবে।’

এর মধ্যে গত শনিবার সংস্কার, বিচার ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে মহাসমাবেশ করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। সেখানে যোগ দিয়ে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, খেলাফত মজলিসের নেতারাও পিআর পদ্ধতিতে ভোটের পক্ষে কথা বলেন। এ পদ্ধতিতে ভোটের বিরোধিতা করা বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে এই কর্মসূচিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, যা স্বীকার করেছেন ইসলামী আন্দোলনের নেতারাই।

সমাবেশে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। সংসদের প্রস্তাবিত উভয় কক্ষেই এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হতে হবে। এটি হলে কোনো দল জালেম হওয়ার সুযোগ পাবে না।’

একই অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ছাড়া বাংলার মানুষ কোনো নির্বাচন গ্রহণ করবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন।

ইসলামি আন্দোলনের সমাবেশে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের প্রস্তাবে এরই মধ্যে প্রায় সব দল একমত হয়েছে। দুয়েকটি দলের কারণে এটি করা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশকে নতুন কাঠামোতে পরিচালিত করতে হলে অবশ্যই পিআর পদ্ধতি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে।

বিভিন্ন দলের পিআর পদ্ধতিতে ভোটের দাবির পেছনে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র দেখছে বিএনপি। দলটির নেতাদের আশঙ্কা, নির্বাচন নিয়ে নতুন নতুন ইস্যু সামনে নিয়ে এলে পতিত আওয়ামী লীগই আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে।

মঙ্গলবার (১ জুলাই) জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পিআর পদ্ধতির ভোটে ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার শঙ্কার কথা জানান। রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা দেশে ঐক্যের পরিবর্তে বিভক্তি তৈরি করতে পারে।’

তারেক রহমান আরও বলেন, ‘বিদ্যমান বাস্তবতায় ও ভৌগোলিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য এই সংখ্যানুপতিক নির্বাচনব্যবস্থা কতটুকু উপযোগী অথবা উপযোগী কি না, সেটি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে আমি সবার প্রতি অনুরোধ রাখব।’

জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে যখন ইতিবাচক কথাবার্তা হচ্ছে তখন নতুন একটি ভোটের পদ্ধতি সামনে এনে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটি আসলে নির্বাচনকে পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। কারণ যারা এ দাবি তুলছেন তাদের অনেকে সারা দেশে প্রার্থীও দিতে পারেননি অতীতে। এমন হলে তো দেশ আবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে।’

পিআর পদ্ধতির বিরোধিতা করে আসছে ১২-দলীয় জোটও। এই জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘ঐক্যমত্য কমিশন প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী সংসদ নির্বাচন বর্তমান পদ্ধতিতেই হবে। বর্তমানে যে সভা চলছে সেখানে বিষয়টি যেহেতু সেটেল্ড, তাই পিআর পদ্ধতি এজেন্ডায় আসেনি।’

বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনের বাস্তবতা নেই উল্লেখ করে শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘পিআর দাবি নিয়ে নির্বাচন পেছানোর কোনো সম্ভাবনা নাই। এটা একটা সাময়িক ইস্যু, যা অচিরেই চাপা পড়ে যাবে।’

তবে ইসলামী আন্দোলন পিআর পদ্ধতিতে ভোটের বিষয়ে অনড়। দলটির যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান রাজনীতি ডকটমকে বলেন, ‘গণহত্যার বিচার ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। আওয়ামী লীগের মতো ভবিষ্যতে অন্য কেউ যেন একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, সে জন্য এ পদ্ধতির বিকল্প নেই।’

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পক্ষে অবস্থান জানিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি প্রবর্তন করা উচিত। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে আমরা বিষয়টি জানিয়েছি।’ তবে সিপিবি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের পক্ষে নয় বলে জানান তিনি।

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব কী

সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি এমন এক ধরনের নির্বাচনব্যবস্থা, যেখানে একটি রাজনৈতিক দল কত শতাংশ ভোট পেয়েছে, সে হিসাব অনুযায়ী সংসদে আসন পায়। একটি নির্বাচনে কোনো দল মোট ভোটের ২৫ শতাংশ পেলে তারা সংসদেও মোট আসনের ২৫ শতাংশ পাবে।

এটিই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির মূল ভিত্তি, ইংরেজিতে যাকে বলে Proportional Representation, সংক্ষেপে PR। এ পদ্ধতির একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো— এতে নির্বাচন হয় সাধারণত দলভিত্তিক। এ পদ্ধতির ভোটে ব্যালটে প্রার্থী থাকবেন না। ভোট হবে দলীয় প্রতীকে। ফলে মানুষ ব্যক্তিকে নয়, ভোট দেয় দলকে। সেই দলের মোট ভোট সংখ্যার ভিত্তিতে দলটি কয়টি আসন পাবে, সেটা নির্ধারিত হয়।

পিআর পদ্ধতির ইতি-নেতি

ডান ও বাম দলগুলো বলছে, আনুপতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোট কাজে লাগে এবং প্রতিটি ভোট সংসদে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করে। এ পদ্ধতিতে স্বৈরাচার বা কর্তৃত্ববাদী হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু সরাসরি ভোটে কোনো দল ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করলে বাকি ৪৯ শতাংশ ভোট পাওয়া দলগুলোকে বাদ দিয়ে একক অধিপত্য বিস্তার করতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, পিআর পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হলো— সর্বসাধারণের মতামতের একটি সঠিক প্রতিচ্ছবি সংসদে তুলে ধরা। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার পাশাপাশি সংখ্যালঘু বা ছোট দলগুলোর মতামতও উপেক্ষিত হয় না। ফলে পিআর পদ্ধতিতে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে। এ পদ্ধতিতে একটি নির্বাচনে দেওয়া প্রতিটি ভোট কাজে লাগে এবং প্রতিটি ভোট সংসদে সমানভাবে প্রতিনিধিত্ব করে।

নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমীন টুলী বলেন, ‘এ পদ্ধতিতে ভোট হলে কারও পক্ষে অতীতের মতো স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে সরকার পরিচালনার সুযোগ থাকবে না। কারণ সরকার গঠন করতে গিয়ে ছোট দলগুলোকেও কাছে টানতে হবে। কোনো কারণে এই দলগুলো সরে গেলে সরকারের বিপদে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেবে।’

তবে এই পদ্ধতির সমালোচনাও রয়েছে। কারণ এ পদ্ধতিতে সরকার গঠনের জন্য প্রায়ই বিভিন্ন দলের মধ্যে জোট করার প্রয়োজন হয়। এসব ক্ষেত্রে ছোট দলগুলোর গুরুত্ব বাড়লেও অনেক সময় ছোট দলগুলোর অন্যায্য দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় বড় দলগুলো। তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো প্রকৃত অর্থে দায়িত্বশীল হয়ে না উঠতে পারলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, কখনো কখনো অচলাবস্থাও তৈরি হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য ছাড়া এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা কঠিন। বিশেষ করে সরকার গঠনে এক পা এগিয়ে থাকা বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলের আপত্তির মুখে এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন আদৌ সম্ভব হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় আছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার গঠন নিয়ে সেই বিতর্কের মতো নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে শুরু হওয়া নতুন এই বিতর্ক রাজনীতির বিভক্তি বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনবিরোধী শক্তির পক্ষে যায় কি না, সেটিও দেখার বিষয়।

বাংলাদেশে ভিন্ন আরেকটি দিক হচ্ছে, নির্বাচন ঘিরে রাজনীতিতে মেরুকরণ হয় জোটগতভাবে। ছোট দলগুলো বড় একটি দলের জোটে আশ্রয় নিয়ে আসন ভাগাভাগি করে ভোটে অংশ নেয়। জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতি কীভাবে কার্যকর করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি ও বর্তমান ব্যবস্থার পার্থক্য

দেশের বর্তমান সংসদীয় নির্বাচনব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো ৩০০ আসনে আলাদা প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। এ পদ্ধতিতে কোনো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী যতজনই হোক, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বাকি প্রার্থীরা যতই ভোট পান, তা জামানত রক্ষা ছাড়া আর কোনো কাজে আসে না।

অন্যদিকে পিআর হচ্ছে নির্বাচনি ব্যবস্থার এমন একটি পদ্ধতি, যেখানে আসন বণ্টন হয় রাজনৈতিক দলের পাওয়া মোট ভোটের আনুপাতিক হারে। অর্থাৎ যদি কোন দল সব আসন মিলিয়ে মোট ভোটের ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবে।

বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে প্রতিটি আসনে রাজনৈতিক দলগগুলোকে সুনির্দিষ্ট প্রার্থী ঘোষণা করতে হয়। একটি দলের সব প্রার্থী একই প্রতীকে নির্বাচন করলেও প্রতিটি আসনে প্রার্থীকে স্বতন্ত্রভাবেই ভোট চাইতে হয়।

অন্যদিকে পিআর পদ্ধতিতে সবাইকে কেবল দলীয় প্রতীকে ভোট দিতে হয়। ভোটের মাঠে ভোটারের সঙ্গে প্রার্থীর সেই সম্পর্ক থাকে না। কোন আসনে কোন দল প্রার্থী দিতে পারবে বা সেই আসনটি পেলে কাকে সংসদ সদস্য করবে, তা পুরোপুরি অনিশ্চিত। ফলে জাতীয়ভাবে ভোটারদের মতামতের প্রতিফলন থাকলেও সুনির্দিষ্ট একটি আসনে ভোটারদের মতামতের প্রতিফলন না-ও দেখা দিতে পারে বলে সমালোচনা রয়েছে এ পদ্ধতির।

সংখ্যানুপাতেও অনেক পদ্ধতি

তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে ৯১টি দেশে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চালু রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল ও শ্রীলঙ্কা এবং ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়।

তবে এত দেশে পিআর পদ্ধতি অনুসৃত হলেও সেগুলোর পদ্ধতিতেও রয়েছে ভিন্নতা। এসব ভিন্নতাকে সাধারণভাবে তিনটিস শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। সে হিসাবে পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন মোটা দাগে তিন ধরনের—মুক্ত, গোপন ও মিশ্র। এগুলোর মধ্যেও বাস্তবায়ন পর্যায়ে দেশে ভিন্নতা রয়েছে।

যেসব দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ রয়েছে, সেগুলোতে কোনো কোনোটিতে দুই কক্ষেই রয়েছে পিআর পদ্ধতি। আবার কোনো কোনো দেশে নিম্নকক্ষে রয়েছে আমাদের দেশের বর্তমান ব্যবস্থার মতো প্রত্যক্ষ নির্বাচন। তবে উচ্চকক্ষের নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে। তিন ধরনের পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের সমন্বয়ও আছে কোনো কোনো দেশে। ফলে পিআর পদ্ধতিতে জটিলতারও কমতি নেই।

বাংলাদেশেও নির্বাচন নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময় আনুপাতিক হারে নির্বাচন পদ্ধতি চালুর সুপারিশ করেছিলেন। তবে তা কখনো আলোর মুখ দেখেনি। এবারই এ পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিষয়টি জোর আলোচনায় এসেছে।

আসন বণ্টন নিয়ে জটিলতা

পিআর পদ্ধতি প্রবর্তন নিয়ে কয়েকদিন ধরে আলোচনা হলেও এ পদ্ধতিতে সংসদে আসন বণ্টন কীভাবে হবে তা নিয়ে সে অর্থে আলোচনা হয়নি।

মহসমাবেশ ডেকে পিআর পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান তুলে ধরা ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান রাজনীতি ডটকমকে বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হলে আসন বণ্টনের পদ্ধতিও রাজনৈতিক দলগুলো বসে ঠিক করতে পারবে। আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। একেক দেশে একেকভাবে আসন বণ্টন হয়ে থাকে। আমরা বাংলাদেশের উপযোগী করে চিন্তা করতে চাই।

গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে সারা দেশ হতে পারে একটি ভোটার এলাকা। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হবে। এর আগে দলগুলো তাদের প্রার্থী তালিকা নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেবে। ভোটের পরে দলগুলো সংখ্যানুপাতিক হারে যত আসন পাবে সে অনুযায়ী তাদের প্রার্থীর গুরুত্ব, আঞ্চলিক গুরুত্ব বিবেচনা করে কমিশনকে অবহিত করবে। এভাবে আসন বণ্টন হতে পারে।’

‘আবার অনেক দেশে প্রদেশভিত্তিক নির্বাচন হয়। আমাদের দেশে বিভাগভিত্তিক ভোট হতে পারে। প্রত্যেক বিভাগ থেকে তখন ভোটের হার অনুযায়ী দলগুলো আসন পেতে পারে। যদি সবাই এ পদ্ধতি সমর্থন করে এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আসন বণ্টনে সমস্যা হবে না,’— বলেন ইসলামী আন্দোলনের এই মুখপাত্র।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ জেসমীন টুলী আসন বণ্টন প্রসঙ্গে বলেন, ‘নির্বাচনের আগে কমিশনের কাছে প্রতিটি দল প্রার্থী তালিকা দেবে, যা সিলগালা করে রাখবে কমিশন। ভোট শেষে কে কত আসন পাবে সেই হিসাবে তালিকা থেকে সংসদ সদস্যপদ দেওয়া হবে। এই প্রক্রিয়া যেহেতু বাংলাদেশে নেই, সেহেতু আলোচনা-পর্যালোচনা ও ঐক্যমতের ভিত্তিতে বিষয়টি সমাধান করতে হবে।’

জেসমীন টুলী আরও বলেন, ‘এখনই এটা বাস্তবায়ন না হলেও আলোচনা চলতে পারে। ঐকমত্য হলে উচ্চকক্ষের জন্য যে দল যত ভোট পায় সেই অনুযায়ী আসন দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মূল বিষয় হলো— এ পদ্ধতিতে আমরা যাব কি না। সেই সিদ্ধান্ত হলে কোন প্রক্রিয়ায় আসন বণ্টন হবে তা ঠিক করার অনেক উপায় ও দৃষ্টান্ত রয়েছে।’

Muhammad Yunus Tareq Rahman Meeting In London 13-06-2025 (1)

গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ছবি: প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর

চাপা পড়েছে নির্বাচনের তারিখ প্রসঙ্গ

লন্ডনে অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠক শেষে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়ে যৌথ বিবৃতি এলেও বুধবার পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) বা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে এমন তথ্য অবহিত করা হয়নি। ইসি জানিয়েছে, কমিশনের স্বাভাবিক প্রস্তুতি চলছে।

গত ১৩ জুনের ওই বৈঠকের পর পর বিএনপি নেতাদের বক্তব্যে এমন ধারণা তৈরি হয়েছিল, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে গেছে। নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতেই হচ্ছে— এটা ধরে নিয়ে বিএনপিসহ দলগুলো নির্বাচনমুখী তৎপরতাও শুরু করে।

এর মধ্যে পিআর পদ্ধতি সামনে আসার পর ভোটের ব্যাপারে নতুন করে সন্দেহ, সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন প্রলম্বিত করার চিন্তা সরকারের ভেতরে নেই বলা হলেও রাজনৈতিক মহলে এমনকি সাধারণ মানুষও এ নিয়ে নিঃসন্দেহ হতে পারছে না।

ad
ad

ঘরের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

নির্বাচন সামনে রেখে টেলিকম নীতিমালা প্রণয়নে বিএনপির উদ্বেগ

জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে টেলিকম নীতিমালা প্রণয়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকারের এমন সব পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, যা দেশ ও জনগণের কল্যাণ বয়ে আনে।

৬ ঘণ্টা আগে

জাতীয় ঐকমত্য গঠনে বিএনপি সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে: সালাহউদ্দিন

সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আজকে আলোচনার বিষয় ছিল সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির মধ্যে কি সংশোধনী আনা যায়, এতে বিচার বিভাগকে না রেখে উত্তম কোনো প্রস্তাব আছে কি না? সে বিষয়ে সবার মতামত।’

১ দিন আগে

বিচার-সংস্কার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না এনসিপি : নাহিদ

এনসিপির এই আহ্বায়ক বলেন, ‘ভারত অন্যায্যভাবে আমাদের নদীর পানির হিস্যা বুঝিয়ে দেয় না। জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃত্বে নদী ও সীমান্ত সুরক্ষা আন্দোলন শিগগিরই শুরু হবে। আমরা এ অঞ্চলের মানুষের নদীর অধিকার, সীমান্তে বেঁচে থাকার অধিকার আদায় করে ছাড়ব।’

১ দিন আগে

বড় দল হিসেবে বিএনপির দায়িত্ব অনেক, স্যাক্রিফাইসটাও বেশি: তারেক রহমান

সংস্কার প্রশ্নে বিএনপি ছাড় দিয়েছে জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করছে সরকার। প্রত্যেকটি দলেরই নিজস্ব আদর্শ ও লক্ষ্য রয়েছে। কিছু মিডিয়ার বিএনপি সংস্কার মানছে না, এমনটা বলা হচ্ছে। কিন্তু সত্যটা হলো সংস্কার প্রশ্নে বিএনপি অনেক বিষয়ে ছাড় দিয়ে

১ দিন আগে