নির্বাচনি ট্রেনে বিএনপি ও সমমনারা, বাকিরা শঙ্কা-শর্তের বেড়াজালে

শাহরিয়ার শরীফ
প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৫, ১৩: ১৩

অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মনেও নানা শঙ্কা ছিল। বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনের জন্য বক্তৃতা-বিবৃতিতে সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে আসছিল অনেকদিন ধরে। অবশেষে জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে ভাষণের পর তার দপ্তর থেকে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়ায় নির্বাচনি ট্রেন যাত্রা শুরু করে।

প্রধান উপদেষ্টার এ ঘোষণার পর এরই মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) জানিয়েছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হবে। এতে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা কেটে গেছে বলে মনে করছেন অনেকেই।

প্রধান উপদেষ্টা ও সিইসির এ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। অন্যদিকে আরও কিছু দল নির্বাচনের ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও জুড়ে দিচ্ছে নানা শর্ত। জামায়াত ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাম ঘরোনার কিছু দল বলছে, নির্বাচনের আগেই এসব শর্ত পূরণ করতে হবে। জুলাই সনদসহ যেসব শর্ত দেওয়া হচ্ছে তা পূরণ না হলে নির্বাচন হবে না— এমন হুঁশিয়ারিও আসছে। জুলাই সনদ সই না হওয়া পর্যন্ত তফসিল ঘোষণা না করতে কমিশনকে সতর্ক করে দিয়েছেন চরমোনাই পীর।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে দেশে যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ছিল, তা কেটে যাওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে। তবে রাজনীতিবিদরা নিজেদের অবস্থান থেকে ছাড় দিতে না পারলে আবারও ভোট নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী রাজনীতি ডটকমকে বলেন, নির্বাচনের ঘোষণায় নিশ্চয়ই স্বস্তি এসেছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ যেসব হুমকিগুলো আছে সেগুলো সবার আগে সমাধান করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এখনো ঐক্য সেভাবে গড়ে ওঠেনি। সেখানে নির্বাচন কীভাবে ঠিকঠাক করা সম্ভব হবে?

নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব ও বৈরী অবস্থান ছিল দীর্ঘ দিন। সরকারের আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে অনড় অবস্থানের বিপরীতে বিএনপি অনড় ছিল এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবিতে। অবশেষে গত জুনে যুক্তরাজ্য সফরকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। সেখানে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগেই নির্বাচন আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টা সম্মতির ইঙ্গিত দিলে বিএনপিতে স্বস্তি ফেরে।

ওই বৈঠকের নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নানা মন্তব্য করলেও তখন থেকেই নির্বাচন ইস্যু নিয়ে জোরালো আলোচনা শুরু হয়। এর মধ্যেই গত মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রোজা শুরুর আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেবেন বলে জানান। এরই মধ্যে সেই চিঠি পেয়ে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, তারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করছে।

প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রায় ৯ লাখ ২৫ হাজার ৬০৫ জন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে ইসি। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রশিক্ষণ শুরু করবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি আজ রোববার (১০ আগস্ট) খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের কথাও জানিয়েছে।

নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ১ সেপ্টেম্বর থেকে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরুর পরিকল্পনা আছে। যেখানে সাড়ে তিন হাজারের বেশি কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ নেবেন।

সম্ভাব্য তারিখ পেয়ে চাঙ্গা বিএনপি ও সমমনারা

বারবার নির্বাচন নিয়ে সরকারকে তাগাদা দেওয়া বিএনপি শুরুতেই নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা নিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। নির্বাচনের ঘোষণায় রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর হবে— এমন বক্তব্যও এসেছে নেতাদের পক্ষ থেকে।

অবশ্য নির্বাচনকে ঘিরে সংঘাত, অস্থিতিশীলতার আশঙ্কাও আছে বিএনপি নেতাদের। দলটির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও হাফিজ উদ্দিন আহমেদ একইদিনে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।

গয়েশ্বরের আশঙ্কা, পতিত আওয়ামী লীগ ও প্রতিবেশী দেশ ভারতের জন্য বাংলাদেশে দাঙ্গা তৈরি হতে পারে। এ দাঙ্গা রাজনৈতিক মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে নির্বাচন বানচাল করতে পারে।

অন্যদিকে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাচনের আগে কিন্তু দেশে অনেক গণ্ডগোল হবে। ভারতে আশ্রয় নিয়ে মাফিয়া নেত্রী শেখ হাসিনা এই দেশকে লণ্ডভণ্ড করার জন্য, নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য অনেক সহিংস ঘটনার অবতারণা করবেন।

তবে এমন শঙ্কার মধ্যেও বিএনপির নেতাকর্মীরা ঘোষিত সময়ে নির্বাচন হবে বলে আশাবাদ জানিয়েছেন। দলের যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘কোনো কনভিউশন নেই। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, যেখানে সব রাজনৈতিক দল অংশ নেবে। আমরা সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি।’

জুলাই সনদে সই ও পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দাবি প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘নির্বাচনকে প্রলম্বিত করতে অনেকেই অনেক কথা বলবে। কিন্তু এতে কাজ হবে না।’

বিএনপির সমমনা ১২ দলীয় জোটের নেতা শাহাদাত হোসেন সেলিম রাজনীতি ডটকমকে বলেন, ‘নির্বাচনি ট্রেন তো এখন পুরোদমে চলতে শুরু করছে। সিইসি এরই মধ্যে অনেকটা সুনির্দিষ্ট তারিখে নির্বাচনের কথা বলেছেন। বিএনপি সমমনা দলগুলোকে মাঠে কাজ করার নির্দেশনাও দিয়েছে।’

কী বলছেন অন্য দলের নেতারা

বিএনপি ও সমমনা দলগুলো যখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত, তখন জামায়াতে ইসলামী গত বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের নেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছে। বৈঠকে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য ‘ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান ও জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

তবে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের ঘোষিত সময় নিয়ে দলের অবস্থান এখনো স্পষ্ট করেনি জামায়াত। দলটির সেক্রেটারি জেনারেলসহ একাধিক নেতার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে চাইলেও তারা মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এদিকে নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার কবে গঠন হবে, তা জানতে চেয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। আর জাতীয় পার্টি দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার কোনো আলামত দেখছে না বলে জানিয়েছে।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী রাজনীতি ডটকমকে বলেন, 'নির্বাচনের সময় ঘোষণায় দলগুলো কিছুটা শান্ত হলেও মবের সংস্কৃতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য দৃশ্যমান হওয়ার আগে কোনো অবস্থাতেই সরকার নির্বাচন করতে পারবে না।'

অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে নিরপেক্ষতা হারিয়েছে দাবি করে দ্রুত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানিয়েছেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহীন হোসেন প্রিন্স। রাজনীতি ডটকমকে তিনি বলেন, আশা করব প্রধান উপদেষ্টা দ্রুততম সময়ে নিরপেক্ষ সরকার কবে গঠন করবেন, সেটা জানাবেন। একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য এটি জরুরি।

অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাধানের আগেই সরকার নির্বাচনি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও দলীয় মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান।

রাজনীতি ডটকমকে তিনি বলেন, জুলাই সনদ ঘোষণা হয়নি, কোনো খাতেই সংস্কার হয়নি, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েও ঐক্যমত্য হয়নি। এই অবস্থায় নির্বাচন কীভাবে হবে? আমাদের দলীয় অবস্থান, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তো করুণ অবস্থা। আশা করি সরকার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেবে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকী নির্বাচনের তারিখ ঘোষণায় খুশি হলেও তার পরামর্শ, নির্বাচন নিয়ে যেন আর কোনো শঙ্কা কাজ না করে সেভাবেই সব ব্যবস্থা করতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আবদুল লতিফ মাসুম রাজনীতি ডটকমকে বলেন, নাগরিকরা জুলাই ঘোষণার বাস্তবায়ন, জাতীয় ঐকমত্যের মাধ্যমে নির্ধারিত সংস্কার, সর্বোপরি নির্বাচনের শতভাগ নিরপেক্ষতার নিশ্চয়তা ইত্যাদি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তবে এটাও সত্য, বাংলাদেশের মতো বিভক্ত রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এক ছাতার নিচে দলগুলোকে আনা সহজ নয়। তবু জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কিছু মৌলিক সংস্কারে একমত করিয়ে একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।

'এখন নাগরিকদের চোখ নির্বাচনের দিকে, যেখানে শুধু তারিখ নয়, দরকার নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন। এই নির্বাচন ইতিহাসের মোড় ঘোরাতে পারে, আবার অন্ধকারেও ঠেলে দিতে পারে,'— বলেন ড. মাসুম।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

সংসদের ২ কক্ষেই পিআরের দাবিতে আন্দোলন করবে জামায়াত

সৈয়দ তাহের বলেন, সংসদে উচ্চ কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে ভোটের ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি। কিন্তু আমাদের দাবি, পিআর হতে হবে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ— উভয় কক্ষেই। সেই ইস্যুতে আমরা আন্দোলন করব।

১ দিন আগে

৩৬ দিনের আন্দোলনে ফ্যাসিবাদের পতন হয়নি : সালাহউদ্দিন আহমেদ

মানবাধিকার সংস্থার তথ্য তুলে ধরে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, পুলিশি নির্যাতনসহ নানা প্রতিহিংসামূলক হামলায় ৭,১৮৮ জন ভুক্তভোগী হয়েছেন। এর মধ্যে ৭০৯ জন গুমের শিকার, তার মধ্যে অনেকে এখনো ফিরে আসেননি, তারা আমার মতো সৌভাগ্যবান নয়। ২,৬৯৩ জন বিচারবহির্ভূত

১ দিন আগে

দেশ আবারও ওয়ান-ইলেভেনের দিকে যেতে পারে : নুর

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের প্রসঙ্গ টেনে নুর বলেন, ‘সেই সময় রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। যখন ছাত্রসংগঠনগুলো সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য গঠন করেছিল, তখন রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানেও রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। এখন যদি আসল কথা বলি, অনেকের সাংগঠনিক শক্তি, জনশক্তি আমার বি

১ দিন আগে

দেশের মানুষ বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে : তারেক রহমান

আজ রোববার বিকেলে রাজশাহী মহানগর বিএনপির দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন। প্রায় আধাঘণ্টার বক্তব্যে তিনি নেতা-কর্মীদের মধ্যে ঐক্যের গুরুত্ব ও রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

১ দিন আগে