বিচারের কাঠগড়ায় যখন সাবেক প্রধান বিচারপতি

রায়হান হক
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫, ১২: ৪২
হাতকড়া-হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করা হয় সাবেক প্রধান বিচারপতিকে। ছবি: ফোকাস বাংলা

বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি সরাসরি খুনের মামলায় কারাগারে গেলেন। দেশের ১৯তম প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে আদালতে হাজির করার দৃশ‍্য কাছ থেকে দেখলেন সংবাদকর্মীরা।

রাজনীতি ডটকমের প্রতিনিধি রায়হান হক বৃহস্পতিবার প্রায় আট ঘণ্টা ছিলেন আদালত চত্বরে। তার দেখা ও তথ‍্য সমন্বয়ে প্রতিবেদন।

ধানমন্ডি এলাকা থেকে বৃহস্পতিবার ভোরে প্রধান বিচারপতিকে গ্রেপ্তারের পর আমাদের অপেক্ষা ছিল আদালত প্রাঙ্গণে। দুপুর ১২টা থেকে পুরান ঢাকায় মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালত চত্বরে সংবাদ কর্মীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। দুঃসহ গরমে খোলা আকাশের নিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেই অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় রাতে।

রাত তখন ৮টা ১০ মিনিট। ঢাকার সিএমএম আদালতের করিডোরে হঠাৎ সবার দৃষ্টি একদিকে। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট, পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল পরা একজন প্রবীণ মানুষকে পুলিশ নিয়ে আসছে। পালাতে যেন না পারেন, তাই হাত পিছমোড়া করে হাতকড়া পরানো। নিরাপত্তার জন‍্য মাথায় হেলমেট। বুকপিঠ রক্ষায় পুলিশের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট।

এ অবস্থায় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক দুই পুলিশ সদস্যের বাহুর ওপর ভর দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে হেঁটে উঠলেন আদালতের তৃতীয় তলায়। এরপর তাকে নেওয়া হয় আসামির কাঠগড়ায়। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

এক পুলিশ সদস্য হাতকড়া খুলে ডান হাতে ঝুলিয়ে দেন। কোর্টরুমে তখন উপচে পড়া ভিড়। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের অন্তত এক শ নেতাকর্মী উপস্থিত। ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরাও।

বাদীপক্ষের আইনজীবী খোরশেদ আলম বলেন, “এই মানুষটির কারণেই শেখ হাসিনা স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিলেন। বিচার বিভাগকে তিনি দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করেছেন।”

খোরশেদ আলম আরও বলেন, “খালেদা জিয়াকে উচ্ছেদ করার পথ করে দিয়েছিলেন তিনিই। বিচার বিভাগের মর্যাদা তিনি ভূলুণ্ঠিত করেছেন।”

ম্যাজিস্ট্রেট মো. ছানাউল্লাহ এজলাসে প্রবেশ করলে সাবেক বিচারপতি একবার তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করেন। পুরো সময় খায়রুল হক চুপচাপ। আদালতে তার পক্ষে কেউ ছিলেন না।

ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, “জামিনের কোনো আবেদন নেই, তাকে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে।”

আদেশের পর পুলিশ এগিয়ে যায়। আবার হাতকড়া পরানো হয়। মাথায় দেওয়া হয় হেলমেট। খায়রুল হক ধীরে ধীরে দুই পুলিশ সদস্যের ভর নিয়ে তিনতলা থেকে নামেন। তাকে আদালতের পেছনের গেট দিয়ে হাজতখানায় নেওয়া হয়।

রাত তখন ৯টা। সাবেক প্রধান বিচারপতিকে প্রিজন ভ্যানে করে নিয়ে পুলিশ রওয়ানা হলো কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের পথে।

দেশের ইতিহাসে এই প্রথম একজন প্রধান বিচারপতি এভাবে মাথা নিচু করে আদালত ছাড়লেন— আসামির পোশাকে, বন্দির শৃঙ্খলে।

চোখের সামনে ভাসতে থাকে, যিনি এক সময় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বসে দেশের ভাগ্য নির্ধারণকারী রায় দিয়েছেন, তিনিই আজ আসামির কাঠগড়ায়। রাষ্ট্রক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতা আর বিচারিক মর্যাদার মিলনবিন্দু থেকে তার এই পতন বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে।

গত ৬ জুলাই ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে যুবদল কর্মী আবদুল কাইয়ুম আহাদ নিহত হন জুলাই-আগস্টের আন্দোলন চলাকালে। ওই ঘটনায় খায়রুল হকসহ ৪৬৭ জনকে আসামি করে মামলা হয়। ক্ষমতাচ‍্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তৎকালীন সরকারের অনেকেই ওই মামলার আসামি।

আন্দোলনের সময় এ হত্যাকাণ্ড চলাকালে প্রধান বিচারপতি উপস্থিত ছিলেন না— এটা হয়তো বিচারের রায়ে প্রমাণিত হবে, কিন্তু তাকে হয়তো জেল খাটতে হবে এ মামলায়। অসংখ্য মিথ্যা মামলায় আসামিকে জেলে পাঠানো হয়েছে বা এখনো হয়তো হচ্ছে। বিচারক সেসব মামলায় রায় দিচ্ছেন, খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি থাকাকালেও এমন বহু মামলায় অনেকেই দণ্ডিত হয়েছেন।

খায়রুল হক অবশ্য শুধু হত্যার অভিযোগেই কাঠগড়ায় নন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে আরও দুটি মামলা। এর মধ্যে একটিতে অভিযোগ— সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় জাল করে তৈরি করা হয়েছে।

দ্বিতীয়টি দুর্নীতি সংক্রান্ত, যেখানে বলা হয়েছে— তিনি রায় দিতে গিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে, কীভাবে তিনি ‘বিধিবহির্ভূতভাবে’ একটি প্লট পেয়েছেন রাজধানীতে।

দুদক বলছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও গৃহায়ণ মন্ত্রণালয়ের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় সাবেক খায়রুল হক ওই প্লট গ্রহণ করেন। এ জন্য সাত সদস্যের একটি অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়েছে।

২০১১ সালে অবসরের পর খায়রুল হককে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয়। তিন বছরের জন্য নিয়োগ পেলেও বারবার মেয়াদ বাড়ানোয় তিনি প্রায় এক দশক দায়িত্ব পালন করেন। এমন দীর্ঘ সময় কেউ ওই পদে ছিলেন না। আইন কমিশনের মূল কাজ বিদ্যমান আইনি সংস্কারের বিষয়ে সরকারকে নানা ধরনের পরামর্শ দেওয়া। কার্যত এটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল।

২০২৪ সালের ১৩ আগস্ট, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আট দিন পর পদত্যাগ করেন তিনি।

তবে খায়রুল হকের পরিচিতি শুধু সাবেক বিচারপতি হিসেবে নয়, একজন রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রায়দাতা হিসেবেও স্থায়ী হয়ে গেছে। বিশেষ করে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায়— যেটি তার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ ৪–৩ ভোটে দেয়— তাকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।

সেই রায়ে কাস্টিং ভোট দিয়েছিলেন খায়রুল হক। তার ভোটেই বাতিল হয় তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচনব্যবস্থা। বিচারপতি মোজাম্মেল হক, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ছিলেন তার পক্ষে। বিপক্ষে ছিলেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞা, নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি এ কে এম ইমান আলী।

রায়টি প্রকাশের পর ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। বিরোধীরা দাবি করে, এই রায়ের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করার আইনি বৈধতা পেয়ে যায়।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মনে করে, এ বি এম খায়রুল হক ছিলেন আওয়ামী লীগের ‘আইনি হাতিয়ার’। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “তিনি বিচার বিভাগের একজন বড় শত্রু ছিলেন। তার শর্ট রায় আর পূর্ণাঙ্গ রায়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ ছিল।”

জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান মন্তব্য করেন, “তিনি ফ্যাসিস্ট আমলে প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তার হঠকারী রায়ের মাধ্যমে অপকর্মের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল।”

বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ১৯৪৪ সালের ১৮ মে জন্মগ্রহণ করেন মাদারীপুরের রাজৈর থানায়। ১৯৬৯ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং পরে লন্ডনের লিংকনস ইন থেকে বার অ্যাট ল’ করেন।

বিচারক হিসেবে তার যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে। পরে ২০০৯ সালে আপিল বিভাগে যোগ দেন এবং ২০১০ সালের ১ অক্টোবর দেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন।

হাইকোর্টে তার সময়কালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল, রেসকোর্স ময়দানের স্মৃতি সংরক্ষণ, ঢাকার চার নদী রক্ষা, ঢাকার ট্যানারি স্থানান্তরের মামলা ও ফতোয়ার মতো গুরুত্বপুর্ণ মামলার রায় আসে তার আদালত থেকে। তবে সব অর্জনের ছায়া দীর্ঘ করে রেখেছে একটি রায়— তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল। সেটিই ছিল রাজনৈতিক ভারসাম্য হরণকারী এক মোড়।

আজ সেই বিচারপতি খায়রুল হককে আদালতে হাজির করানো হয় রাতের অন্ধকারে, মাথায় হেলমেট পরিয়ে।

এ ঘটনা বাংলাদেশের বিচার ও রাজনীতির ইতিহাসে নজিরবিহীন। প্রধান বিচারপতির আসন থেকে অভিযুক্ত আসামির কাঠগড়ায় এভাবে কারও যাত্রা এ দেশে আগে কখনোই দেখা যায়নি।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

ট্রাম্পের শুল্কনীতি: সময় কি বাড়ছে?

এই নীতিকে “আমেরিকা ফার্স্ট” বা ‘আমেরিকা আগে’ বাণিজ্য কৌশলের মূল স্তম্ভ হিসেবে দেখা হচ্ছে। উদ্দেশ্য হলো—যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের নিজেদের বাজার আমেরিকান পণ্যের জন্য আরও উন্মুক্ত করা এবং তারা যেন নিজেদের শুল্ক হার কমায়।

৫ ঘণ্টা আগে

আওয়ামী লীগ বিরোধিতাকে পুঁজি করেই কি রাজনীতি করতে চায় এনসিপি?

জনসংযোগের জন্য পয়লা জুলাই থেকে দেশব্যাপী পদযাত্রা শুরু করে এনসিপি। তারই অংশ হিসেবে গত ১৬ই জুলাই গোপালগঞ্জে যাওয়ার ঘোষণা দেয় দলটি। তবে জেলাটির ক্ষেত্রে একই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় 'মার্চ টু গোপালগঞ্জ'।

২০ ঘণ্টা আগে

বিমান দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে আ.লীগ অপরাজনীতি শুরু করেছে: এ্যানি

শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, গত ১৫-১৬ বছরে যারা দুর্নীতি, দুঃশাসন, হত্যা, গুম, খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল, তারা একটা অপরাজনীতি শুরু করেছে। তারা পারেনি, কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র শেষ হয় নাই। দুর্ঘটনার পরদিনই সচিবালয়ে একটা মিছিল এবং মাইলস্টোন কলেজের সামনেও মিছিল হয়েছে। সেখানে তাদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও ষড

২১ ঘণ্টা আগে

শেখ হাসিনা একটি ফিটনেসবিহীন রাষ্ট্র চাপিয়ে দিয়ে গেছে : নাহিদ ইসলাম

নাহিদ ইসলাম বলেন, আপনাদের সন্তানরা যারা রাস্তায় জীবন দিয়েছে, তাদের আকাঙ্খা পূরণের জন্য হলেও এই রাষ্ট্রের ফিটনেস আমাদের তৈরি করতে হবে। এই রাষ্ট্রের মেরামত আমাদের করতে হবে। আর সেই রাষ্ট্র মেরামতের জন্যই জাতীয় নাগরিক পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

১ দিন আগে