মতামত

ট্রাম্পের শুল্কনীতি: সময় কি বাড়ছে?

মো. ফেরদাউস মোবারক
প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৫, ১৩: ২৩

১ আগস্ট ২০২৫ সময়সীমা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে—ট্রাম্প প্রশাসন কি আবারও তার প্রতিশোধমূলক শুল্কনীতি কার্যকর করার সময়সীমা বাড়াবে, নাকি এবার কঠোর অবস্থান নেবে?

এই নীতিটি প্রথম চালু হয়েছিল চলতি বছরের এপ্রিল মাসে, আন্তর্জাতিক জরুরি অর্থনৈতিক ক্ষমতা আইন (আইইইপিএ)-এর আওতায়। নীতিমালায় বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে আসা সব পণ্যের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে এবং যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (ট্রেড সারপ্লাস) চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের ওপর আরও বেশি হারে দেশভিত্তিক শুল্ক আরোপ করা হবে।

এই নীতিকে “আমেরিকা ফার্স্ট” বা ‘আমেরিকা আগে’ বাণিজ্য কৌশলের মূল স্তম্ভ হিসেবে দেখা হচ্ছে। উদ্দেশ্য হলো—যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের নিজেদের বাজার আমেরিকান পণ্যের জন্য আরও উন্মুক্ত করা এবং তারা যেন নিজেদের শুল্ক হার কমায়।

এই পর্যন্ত দুই দফায় সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে—প্রথমবার ৯ এপ্রিল এবং দ্বিতীয়বার ৮ জুলাই। মূলত মিত্র দেশগুলোর চাপ, বাজারে অস্থিরতা, এবং চলমান বাণিজ্য আলোচনার সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই এসব সময়সীমা বাড়ানো হয়েছিল। এই সময়সীমা বৃদ্ধি সুযোগ দিয়েছে যুক্তরাজ্য, ভারত, জাপানসহ কয়েকটি দেশকে আলোচনায় অংশ নেওয়ার, অনেকে ইতোমধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ ছাড়ও দিয়েছে। যেমন গাড়ি আমদানির ওপর শুল্ক কমানো বা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে আরও বেশি প্রতিশ্রুতি দেওয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন, যেসব দেশ “গঠনমূলক আলোচনায়” অংশ নিচ্ছে, তাদের জন্য হয়তো আরও সময় বাড়ানো হতে পারে। এই নমনীয় অবস্থান ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের কৌশলের সঙ্গে মিল রেখেছে—তিনি শুল্ককে একটি আলোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন, স্থায়ী কোনো নীতি হিসেবে নয়।

তবে ট্রাম্প আবার প্রকাশ্যেই হুমকি দিয়েছেন, “আর কোনো সময়সীমা বাড়ানো হবে না।” এমনকি তার প্রশাসন এরই মধ্যে ব্রাজিল ও কানাডার ওপর নতুন শুল্ক আরোপ করেছে—যথাক্রমে ৫০ শতাংশ ও ৩৫ শতাংশ হারে—যা এক ধরনের কূটনৈতিক পথ থেকে কঠোর প্রয়োগের দিকে ঝুঁকির ইঙ্গিত দেয়।

এই জটিলতায় আরেকটি মাত্রা যোগ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আদালতের একটি রায়। সেখানে বলা হয়েছে, আইইইপিএ-র ভিত্তিতে আরোপিত শুল্কগুলো আইনসম্মত নয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে এবং শুনানি হওয়ার কথা ৩১ জুলাই। ফলে যদি সময়সীমা আবারও বাড়ানো হয়, তাহলে হোয়াইট হাউসের কাছে বিকল্প আইনি ভিত্তি খোঁজার সময় থাকবে—যেমন সেকশন ২৩২ বা সেকশন ৩০১ ধারা, যেগুলোর মাধ্যমে এই নীতিকে টিকিয়ে রাখা যেতে পারে।

অর্থনীতিবিদরা বিষয়টি নিয়ে সতর্ক অবস্থানে আছেন। এপ্রিলের মূল ঘোষণার পর বাজারে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল, বিশেষ করে চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাল্টা শুল্কের ফলে আমেরিকান রপ্তানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মুডিজ-এর মার্ক জান্ডি ও জেপি মরগ্যানের মাইকেল ফেরোলি-এর মতো বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন যে, এখনই এই শুল্ক কার্যকর করা হলে তা যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে এবং এমনকি একটি বৈশ্বিক মন্দার সম্ভাবনাও তৈরি হতে পারে। ব্যবসায়ী মহলও উদ্বিগ্ন, তারা প্রশাসনকে আহ্বান জানিয়েছে যেন পদক্ষেপ নেওয়া পিছিয়ে দেওয়া হয়, যাতে করে আমেরিকান কৃষি, প্রযুক্তি ও উৎপাদন খাত রক্ষা পায়।

তবুও প্রশাসনের ভেতরেই মতবিরোধ আছে বলে মনে হচ্ছে। একদিকে, ট্রাম্পের বাণিজ্য উপদেষ্টারা বলছেন, সময় বাড়ালে আলোচনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরও জোরালো হবে, বিশেষ করে যেসব দেশ আলোচনার আগ্রহ দেখাচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে। অন্যদিকে, রাজনৈতিকভাবে ট্রাম্প হয়তো তার দেশের অভ্যন্তরীণ সমর্থকদের কাছে দৃঢ় অবস্থান প্রদর্শন করতে চাইবেন, যাতে তিনি দেখাতে পারেন—তিনি অসহযোগী দেশগুলোর বিরুদ্ধে শুল্ক প্রয়োগে পিছপা হননি।

অ্যাটলান্টিক কাউন্সিলের জোশ লিপস্কি-এর মতে, সময়সীমা বাড়ানো হতে পারে বেছে বেছে—যেমন ভারতের মতো দেশগুলোকে কিছুটা ছাড় দেওয়া যেতে পারে, আবার অন্যদের ওপর শাস্তিমূলক শুল্ক চাপানো হতে পারে। সাবেক ইউএস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর)-এর প্রধান আইন উপদেষ্টা গ্রেটা পেইশ বলছেন, আলোচনার কাজ এত বিশাল যে অন্তত আরও ৯০ দিনের সময় দেওয়া উচিত। আর এই নীতির সমালোচক অর্থনীতিবিদ অ্যানসন সডারবেরি বলছেন, শুল্ক হিসাব করার পদ্ধতিটা অত্যন্ত সরলীকৃত এবং কার্যকর প্রয়োগের জন্য আরও সময় দরকার।

তবে বিশ্ববাণিজ্যে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি। তিনি জানিয়েছেন, আগামী ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশের পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে, তার সর্বনিম্ন হার হবে ১৫ শতাংশ। অর্থাৎ, শুল্ক হার ১৫ শতাংশের নিচে নামবে না বলে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন তিনি। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ এ তথ্য জানিয়েছে।

স্থানীয় সময় বুধবার (২৩ জুলাই) ওয়াশিংটনে আয়োজিত এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, 'আমাদের একটি সোজাসাপ্টা এবং সহজবোধ্য শুল্ক কাঠামো থাকবে, যার হার ১৫ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে হবে।' তিনি আরও বলেন, 'কিছু দেশের ক্ষেত্রে এই হার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত যেতে পারে। কারণ, আমরা তাদের সঙ্গে ইতিবাচক বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারিনি।'

ট্রাম্পের এই বক্তব্য তার প্রশাসনের শুল্কনীতি আরও কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। বিশেষ করে, যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে বা যাদের সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপোড়েন চলছে, তাদের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ হতে পারে।

শেষ পর্যন্ত, তৃতীয় দফায় সময়সীমা বাড়ানো হবে কিনা, তা নির্ভর করছে আলোচনার অগ্রগতি ও আদালতের রায়ের ওপর। যদিও পুরোপুরি শুল্ক কার্যকর করা এখনো সম্ভব, কিন্তু অধিকাংশ বিশ্লেষক মনে করছেন, প্রশাসন হয়তো লক্ষ্যভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণ করবে—কিছু দেশের জন্য সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হবে, আবার কিছু দেশের ওপর শুল্ক কার্যকর করা হবে।

এই ১ আগস্ট কী ঘটে, তার ওপরই নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বাণিজ্য সম্পর্ক কেমন হবে এবং ট্রাম্পের কৌশল আসলে সংঘাতমুখী না কি কৌশলী আপসনির্ভর—তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৮ জুলাই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠানো চিঠিতে আগামী ১ আগস্ট থেকে নতুন শুল্কহার কার্যকরের কথা জানান। নতুন করে এই শুল্ক কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে গড় শুল্কহার দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কবৃদ্ধির এই ধাক্কা কেবল বাংলাদেশে তৈরি পোশাকশিল্পেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এর ঢেউ পুরো রপ্তানি খাত এবং সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এই পরিস্থিতিতে শুল্ক নিয়ে টানাপোড়েন প্রশমনে বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হয়েছে এবং কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। এই প্রক্রিয়ায় কৃষি, বিমান চলাচল ও জ্বালানি খাতে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু বাণিজ্যিক সুবিধা দেওয়ার কথা আলোচিত হচ্ছে।

আনুষ্ঠানিক বার্তা না পেলেও ট্রাম্প প্রশাসনের ৩৫ শতাংশ পালটা শুল্ক হার শেষ পর্যন্ত কিছুটা কমবে বলে আশা করছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বুধবার সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, আমরা আশা করছি হয়তো কিছু কমাবে। কারণ, আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি খুবই কম, ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কহার কমিয়ে আনার ব্যাপারে দুই দফা আলোচনা হলেও এখনো দৃশ‍্যমান অগ্রগতি হয়নি।

পাল্টা শুল্ক কার্যকরের আর কয়েকদিন বাকি। তার আগে দেশটির সঙ্গে আরেক দফা আলোচনা করতে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা রয়েছে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে একটি দল। তৃতীয় দফার আলোচনার জন্য ২৬-২৭ জুলাই সময় চেয়েছিল বাংলাদেশ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রধান বাণিজ্য আলোচনাকারী সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) বাংলাদেশকে আগামী ২৯ জুলাই তৃতীয় ও চূড়ান্ত শুল্ক আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রাতে বাসসকে এ কথা জানান। আমরা আশা করি এবারের আলোচনায় বাংলাদেশ ট্রাম্প আরোপিত শুল্ক বিপদ কাটিয়ে উঠবে।

লেখক: সাংবাদিক

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

পুরোনো আইনে দেশকে আর চলতে দেওয়া হবে না: নাহিদ

বাহাত্তরের সংবিধানকে মুজিববাদী সংবিধান আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশের সংস্কার ও উন্নয়নে সেই সংবিধানের সংস্কার প্রয়োজন। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি থাকবে। তবে বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি বাহাত্তরের সংবিধানকে রক্ষায় রাজপথে নামছে। এর বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকতে হবে।’

৭ ঘণ্টা আগে

পরিবেশ ধ্বংসকারীরা বিএনপির মনোনয়ন পাবে না: আমীর খসরু

আমীর খসরু বলেন, শেখ হাসিনা পালানোর পর জনগণের মনে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। রাজনীতিবিদদের সেই মনোভাব ধারণ করতে না পারলে, তাদের সামনে কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

৭ ঘণ্টা আগে

'রাতারাতি সবকিছু বদলে ফেলা সম্ভব নয়'

রাতারাতি সবকিছু বদলে ফেলা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবার সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচার সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত গ্রন্থ প্রকাশ ও আলোচনা সভায় তিনি এই মন্তব্য করেন।

৯ ঘণ্টা আগে

খানুয়ার যুদ্ধ: ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ভাগ্য গড়ে দিয়েছিল

খানুয়ার যুদ্ধ হয়েছিল আগ্রার কাছে খানুয়া নামের এক সমতল অঞ্চলে। এই অঞ্চল ছিল বাবরের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি দিল্লি ও আগ্রার মাঝামাঝি এবং রানা সাঙার আগমন পথের কাছাকাছি।খানুয়ার যুদ্ধ হয়েছিল আগ্রার কাছে খানুয়া নামের এক সমতল অঞ্চলে। এই অঞ্চল ছিল বাবরের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি

১০ ঘণ্টা আগে