বিবিসি বাংলা
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এক হাজার কেজি হাঁড়িভাঙা আম পাঠিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। এ সপ্তাহেই দিল্লিতে সাত নম্বর লোককল্যাণ মার্গে মোদির ঠিকানায় পৌঁছেছে সে আম। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গত বছরখানেক সময়ের যে ‘তিক্ত’ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, সেখানে ‘মিষ্টতার স্বাদ’ আনতেই যে এই আম উপহার, তা নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর অন্তত কোনো সন্দেহই নেই!
আম নরেন্দ্র মোদির সবচেয়ে পছন্দের ফল। এটা অবশ্য কোনো গোপন তথ্য নয়। মোদি আম কেটে খান, নাকি আঁটিসুদ্ধ গোটা আম চুষে খেতে পছন্দ করেন— এ প্রশ্নও একসময় ভারতে ভাইরাল হয়েছিল।
বছর কয়েক আগে বলিউড তারকা অক্ষয় কুমার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এমন প্রশ্ন করেছিলেন। সেখানেই মোদি জানান, ছোটবেলায় তাদের দরিদ্র পরিবারে বাজার থেকে আম কিনে খাওয়ার বিলাসিতা ছিল না ঠিকই, কিন্তু গ্রামে গেলেই কৃষকের আমবাগান থেকে পাকা আম পেড়ে খাওয়াটা তার খুব প্রিয় অভ্যাস ছিল!
মোদির এই আম-প্রীতির খবর ফাঁস হওয়ার কিছুকাল পর থেকেই বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি বছর দিল্লিতে গ্রীষ্মের মৌশুমে আম উপহার পাঠাতে শুরু করেন।
ওই সময় দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, নিরামিষাশী নরেন্দ্র মোদিকে পদ্মার ইলিশ পাঠিয়ে তো কোনো লাভ নেই! কিন্তু আম এমন একটি উপহার, এই পুরো উপমহাদেশে সবাই যেটা পেতে ভীষণ পছন্দ করেন।
দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির কাছেই শুধু নয়, পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরার মতো বাংলাদেশ-লাগোয়া রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের কাছেও এরপর থেকে নিয়মিত পৌঁছে যেতে শুরু করে শেখ হাসিনার পাঠানো রংপুরের হাড়িভাঙা কিংবা রাজশাহীর আম্রপালীর ঝুড়ি। শুধু ভারতে নয়, পাকিস্তানের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকেও আম উপহার পাঠিয়ে শেখ হাসিনা অনেককেই চমকে দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার পতনের পর ঢাকায় যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, তারাও যে ভারতে শেখ হাসিনার আমলের এই ‘আম কূটনীতি’র পরম্পরা অব্যাহত রাখবে, তা পর্যবেক্ষকদের অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু অবশেষে ঠিক সেটাই ঘটেছে।
মৌসুম শেষের দিকে। তবে এবার ফলন ভালো হওয়ায় এখনো বাজারে আমের সরবরাহ পর্যাপ্ত। ছবি: ফোকাস বাংলা
ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রিয়জিত দেবসরকার যেমন বললেন, আমেরিকার দিক থেকে ট্যারিফের চাপ, মধ্যপ্রাচ্যের সংকট, ঘরের পাশে মিয়ানমারের পরিস্থিতি— নানা কারণে বাংলাদেশ প্রবল চাপে আছে বলেই ড. ইউনূসকে ভারতের সঙ্গে এই আম কূটনীতির রাস্তা নিতে হয়েছে বলে আমার ধারণা। দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার কথা এখন তারা প্রকাশ্যেও বলছেন। এখন এই হাঁড়িভাঙা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কী অম্লমধুর স্বাদের রেশ রেখে যায়, দেখার বিষয় সেটাই।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানে আমকে কেন্দ্র করে কূটনীতি ও পরস্পরের মধ্যে বাণিজ্য প্রতিযোগিতা অবশ্য নতুন কিছু নয়। দিল্লি ও ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদের সেরা জাতের আম বিশ্বনেতাদের উপহার দিয়ে আসছে।
বিশ্বে যে তিনটি দেশ সবচেয়ে বেশি আম রপ্তানি করে, সেগুলো হলো— যথাক্রমে ভারত, মেক্সিকো ও পাকিস্তান। বাংলাদেশও এই তালিকায় প্রথম দশের মধ্যেই আছে। আম রপ্তানির নতুন নতুন বাজার খোঁজার চেষ্টায় এই দেশগুলোর মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতাও আছে।
পাকিস্তানে ৩৭ বছর আগে যে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট জিয়া উল হকের মৃত্যু হয়েছিল, সেই রহস্যময় ঘটনার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কয়েক বাক্স আমের নাম। ফলে বিশ্বের এই অঞ্চলে আম মানে অতি সুস্বাদু একটি ফলই শুধু নয়, আমের ঝুড়ির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে রহস্য, রাজনীতি, রেষারেষি আর কূটনীতির ঘেরাটোপ।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়। দুই দেশেরই জাতীয় ফল আম। দুই দেশই এই আমকে তাদের গ্লোবাল আউটরিচ বা কূটনীতির বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পঞ্চাশের দশকে যখনই বিদেশ সফরে যেতেন, উপহার হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যেতেন আমের বাক্স। আবার বিদেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীরা ভারত সফরে এলেও তারা পন্ডিত নেহরুর কাছ থেকে অবধারিতভাবে আম উপহার পেতেন।
জওহরলাল নেহরু ও চৌ এন লাই, ১৯৫৫তে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময়। ছবি: সংগৃহীত
১৯৫৫ সালে চীন সফরে গিয়ে পন্ডিত নেহরু চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে দশেরি ও ল্যাংড়া আমের আটটি চারা উপহার দিয়েছিলেন, যেগুলো রোপণ করা হয়েছিল গুয়াংঝৌ পিপলস পার্কে। আবার সে বছরই সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ভারত সফরে আসেন। তার মস্কোগামী ফিরতি বিমানে সঙ্গে গিয়েছিল জওহরলাল নেহরুর উপহার উত্তরপ্রদেশের বিখ্যাত মালিহাবাদী আমের অনেকগুলো ঝুড়ি।
পরে নেহরুর দৌহিত্র রাজীব গান্ধী দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৮৬তে যখন ফিলিপাইন সফরে যান, সে দেশের প্রেসিডেন্ট কোরাজন অ্যাকিনোর হাতেও তিনি উপহার হিসেবে আমের বাক্সই তুলে দিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার, ফিলিপাইনের জাতীয় ফলও আম! তবে সে আমের স্বাদ-গন্ধ ও চরিত্র অবশ্যই ভারতের আমের চেয়ে অনেক আলাদা।
আম উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানও পিছিয়ে ছিল না। চীনকে দেওয়া পাকিস্তানের আম তো সে দেশে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকেও পরিণত হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের অগাস্ট মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঁয়া আর্শাদ হুসেইন বেইজিং সফরে গিয়ে চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুংকে এক বাক্স আম উপহার দেন।
আম তখনও চীনে অপরিচিত একটি ফল। মাও নিজেও এই নতুন ফলটি চেখে দেখতে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না। ফলে তিনি দেশের বিভিন্ন কারখানা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই আমগুলো বিলি করে দেন। এরপর চীনের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কারখানায় চেয়ারম্যানের সেই উপহার নিয়ে যে মাতামাতি শুরু হয়েছিল, আমকে ফর্ম্যালডিহাইডে সংরক্ষণ করে, কাঁচের পাত্রে ও পূজার বেদীতে রেখে শ্রমিক ও ছাত্ররা যেভাবে সম্মান জানাতে শুরু করেন, তা আজও ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর চেষ্টাতেও আমকে ব্যবহার করেছে। ১৯৮১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়া উল-হক ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এমন এক আমের বাক্স উপহার পাঠান, যে প্রজাতিটি পাকিস্তানে ‘আনোয়ার রাতাওল’ নামে পরিচিত।
‘রাতাওল’ নামে ভারতের উত্তরপ্রদেশেও একটি গ্রাম আছে। আর সেই আমের উৎপত্তি আসলে ভারতে না পাকিস্তানে, তখন সেই বিতর্ক ছাপিয়ে গিয়েছিল উপহারের সৌজন্যকে।
২০০৮ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে আমের বাক্স উপহার পাঠিয়েছিলেন। তবে তার কিছুদিন পরেই মুম্বাইতে ২৬/১১’র হামলা সেই উষ্ণতায় জল ঢেলে দেয়।
সাত বছর পর ২০১৫ সালে পাকিস্তানের তখনকার নেতা নওয়াজ শরিফ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ও বিরোধী দলীয় নেতা সোনিয়া গান্ধীকে আমের বাক্স পাঠান। দুই দেশের সংঘাত নিরসনে সেই উপহারও খুব একটা কাজে আসেনি!
জার্নাল অব এশিয়ান অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে প্রকাশিত এক নিবন্ধে গবেষক জাহিদ শাহাব আহমেদ ও মহম্মদ জাহানজাইব দাবি করেছেন, আম নিয়ে কূটনীতি আর বাণিজ্যের দৌড়ে পাকিস্তান কিন্তু ভারতকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে।
ভারতে প্রায় ১২০০ জাতের আম উৎপন্ন হয়, যেখানে পাকিস্তানের আম হয় মোটামুটি ৪০০ জাতের। ফলনের পরিমাণও ভারতে অনেক বেশি। তবে আম যেভাবে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্য, ভারতের ক্ষেত্রে সেটি ততটা নয়। কোভিড মহামারির আগের বছরেও পাকিস্তান ১২৭ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের আম রফতানি করেছিল।
ওই দুই গবেষক বলছেন, আম রপ্তানির ক্ষেত্রে পাকিস্তানের একটি সুচিন্তিত স্ট্র্যাটেজি আছে। বিদেশে নিয়মিত ‘আম উৎসব’ বা ‘আম প্রদর্শনী’র আয়োজন করে, বিদেশের নেতা-মন্ত্রী-নীতিনির্ধারকদের আম খাইয়ে ও উপহার দিয়ে তারা পাকিস্তানি আমের একটা দারুণ বাজার তৈরি করতে পেরেছেন।
চীনে একটি আমকে সামনে রেখে চেয়ারম্যান মাওয়ের প্রশস্তিসূচক পোস্টার, ১৯৬৮ সালের। ছবি: সংগৃহীত
আম বিক্রির জন্য চিরাচরিতভাবে বিশ্বের যে বাজারগুলোতে নজর দিয়ে আসা হয়েছে, তার একটি হলো আমেরিকা, আরেকটি চীন। পাশাপাশি ইউরোপেও দক্ষিণ এশিয়ার আমের একটা বড় বাজার আছে। তবে চীনে আম রপ্তানি করতে ভারতের চেষ্টা কখনোই তেমন সফল হয়নি।
২০০৪ সালেই চীন ভারতীয় আমের জন্য তাদের মার্কেট অ্যাকসেস খুলে দেয়। তারপরও ভারতের রপ্তানিকারকরা সেখানে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেননি। ২০১৫-১৬ সালে ভারতের ব্যবসায়ীরা সারা বিশ্বে ৩১৭ কোটি রুপিরও বেশি দামের আম রফতানি করেছিলেন, সেখানে চীনে রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ২৪ হাজার রুপির আম। বাংলাদেশ অবশ্য মাত্র এ বছর চীনে আম রপ্তানি শুরু করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ভারতের আম রপ্তানি প্রায় দীর্ঘ দুই দশক ধরে নিষিদ্ধ ছিল। ২০০৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ভারত সফরে গেলে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেটাকে তখন ‘ম্যাংগো ইনিশিয়েটিভ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, প্রেসিডেন্ট বুশ নাকি দিল্লিতে গিয়ে ভারতের আম খেতে খুবই উদগ্রীব ছিলেন। তার ব্যক্তিগত আগ্রহেই আম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
এরপর যখন ২০০ সালের ১৭ এপ্রিল নিউ ইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্টে ভারতীয় আমের ১৫০ কার্টন গিয়ে নামল, নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, ‘ইতিহাসে বোধহয় এটাই সবচেয়ে প্রতীক্ষিত কোনো ফলের ডেলিভারি!’
ওদিকে ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের দূতাবাসও নিয়মিত মার্কিন সিনেটর বা নেতা-মন্ত্রীদের আম উপহার পাঠিয়ে থাকে। তাদের দূতাবাসের লনে ‘ম্যাংগো পার্টি’ও হামেশাই হয়ে থাকে।
রপ্তানির জন্য পাকিস্তানি আমের চাহিদা কেন তুলনামূলকভাবে বেশি, দিল্লিতে আম বিশেষজ্ঞ প্রতীপ কুমার দাশগুপ্ত তার আবার একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, আসলে যে আমের ‘শেলফ লাইফ’ যত বেশি, মানে বেশিদিন যে আমটা ভালো থাকে, রপ্তানির জন্য সেটাই বেশি উপযুক্ত। কারণ ফলের বাগান থেকে লন্ডন-নিউইয়র্কের দোকানে পৌঁছতে একটা আমের পাঁচ-সাত দিন লেগেই যায়। ততদিন পর্যন্ত সেই আমটায় এতটুকুও পচন ধরা চলবে না।
অথচ ভারতের কোঙ্কন উপকূল ও মহারাষ্ট্রের আলফানসো ছাড়া বেশির ভাগ প্রজাতির আমেই আঁশ বা ফাইবার বেশি। ফলে সেগুলোতে পচনও ধরে তাড়াতাড়ি, যদিও স্বাদে-গন্ধে সেগুলো হয়তো কোনো অংশেই কম নয়।
পাকিস্তানের শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে সেখানকার আমে আবার আঁশ খুব কম, ‘শেলফ লাইফ’ও বেশি। প্রতীপ কুমার দাশগুপ্ত বলেন, ঠিক এ কারণেই ভারতের আলফানসো ছাড়া অন্য প্রজাতির আম কমই রপ্তানি হয়। অন্যদিকে পশ্চিমা বাজারে পাকিস্তানের সিন্ধ্রি, চৌসা বা আনোয়ার রাতাওলের এত কদর।
এ বছরই প্রথম চীনে আম রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। গত ২৮ মে চীনে পাঠানোর জন্য আমের চালান বিমানবন্দরে পরীক্ষা করে দেখছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। ছবি: বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
১৯৮৮ সালের ১৭ অগাস্ট পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরে একটি সামরিক ট্যাংক বহরের রুটিন প্যারেড প্রদর্শন করে রাজধানীতে ফেরার জন্য বিমানে চাপেন দেশের প্রেসিডেন্ট তথা সামরিক শাসক জেনারেল মুহাম্মদ জিয়া উল-হক। প্রেসিডেন্টকে বহনকারী ওই সি-১৩০ হারকিউলিস এয়ারক্র্যাফটটি পরিচিত ছিল ‘পাক ওয়ান’ নামে।
সেদিন ফেরার সময় ওই বিমানে প্রেসিডেন্ট ছাড়াও সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ছিলেন। আর ছিলেন পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্নল্ড র্যাফেল। ফিরতি বিমানে বাহাওয়ালপুর থেকে প্রেসিডেন্ট ও অন্য অতিথিদের জন্য উপহার হিসেবে কিছু আমের বাক্সও তুলে দেওয়া হয়েছিল। মসৃণ টেক-অফের কিছুক্ষণ পরেই ‘পাক ওয়ানে’র সঙ্গে কন্ট্রোল টাওয়ারের সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা পরে জানিয়েছেন, বিমানটি ভীষণ এলোমেলোভাবে উড়ছিল, তারপরই সেটাতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে ও বিমানটি মুখ থুবড়ে পড়ে। জেনারেল জিয়া উল-হক ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ বিমানের মোট ৩১ জন যাত্রীই সে দিন নিহত হন।
এই ‘দুর্ঘটনা’ ঠিক কীভাবে ঘটেছিল, এতে কোনো নাশকতার ছাপ ছিল কি না— সেই রহস্য আজও পুরোপুরি উদ্ঘাটিত হয়নি।তবে জেনারেল জিয়া উল-হকের এই মৃত্যু নিয়ে যথারীতি অনেকগুলো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা কনস্পিরেসি থিওরি চালু আছে। এমনই একটা থিওরি হলো— বাহাওয়ালপুর থেকে বিমানে উঠিয়ে দেওয়া আমের বাক্সেই লুকোনো ছিল বোমা আর বিস্ফোরক!
‘পাক ওয়ান’ ক্র্যাশ করার সেই সত্যি ঘটনার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে জিয়া উল-হকের মৃত্যুর ঠিক ২০ বছর পর একটি উপন্যাস বা আধা-ফিকশন লিখেছিলেন পাকিস্তানি লেখক মোহামেদ হানিফ। বেস্টসেলার বইটির নাম ছিল ‘আ কেস অব এক্সপ্লোডিং ম্যাংগোজ’।
মোহামেদ হানিফ নিজে এক সময় ছিলেন পাকিস্তানি এয়ারফোর্সের সদস্য ও ফাইটার জেটের পাইলট ছিলেন। পরে সাংবাদিকতায় এসে তিনি লন্ডনে বিবিসি উর্দু বিভাগের প্রধান হিসেবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। লন্ডনে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের একদা আইকনিক সদর দপ্তর বুশ হাউজে তিনি ছিলেন সহকর্মী।
পরে ঘরোয়া আড্ডায় সামরিক বাহিনীর একজন ‘ইনসাইডার’ বা ভেতরের লোক হিসেবে তার কাছে জেনারেল জিয়া উল-হকের মৃত্যু নিয়ে কী খবর ছিল জানতে চাইলে মোহামেদ হানিফ সবসময়ই হেসে প্রশ্ন এড়িয়ে যেতেন। কখরনা হয়তো বলতেন, ‘আমার বইটা আবার ভালো করে পড়ুন, তাহলেই উত্তর পেয়ে যাবেন!’
আমের ঝুড়িকে কেন্দ্র করে রহস্যের জট তাতে যথারীতি খোলেনি। বরং আরও বেড়েছে। পাশাপাশি এটিও স্পষ্ট হয়েছে— এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতেও আম কখনোই ‘আম’ নয়, বরং ‘খাস’ হিসেবেই চিরকাল নিজের জায়গা করে নিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এক হাজার কেজি হাঁড়িভাঙা আম পাঠিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। এ সপ্তাহেই দিল্লিতে সাত নম্বর লোককল্যাণ মার্গে মোদির ঠিকানায় পৌঁছেছে সে আম। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গত বছরখানেক সময়ের যে ‘তিক্ত’ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, সেখানে ‘মিষ্টতার স্বাদ’ আনতেই যে এই আম উপহার, তা নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর অন্তত কোনো সন্দেহই নেই!
আম নরেন্দ্র মোদির সবচেয়ে পছন্দের ফল। এটা অবশ্য কোনো গোপন তথ্য নয়। মোদি আম কেটে খান, নাকি আঁটিসুদ্ধ গোটা আম চুষে খেতে পছন্দ করেন— এ প্রশ্নও একসময় ভারতে ভাইরাল হয়েছিল।
বছর কয়েক আগে বলিউড তারকা অক্ষয় কুমার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এমন প্রশ্ন করেছিলেন। সেখানেই মোদি জানান, ছোটবেলায় তাদের দরিদ্র পরিবারে বাজার থেকে আম কিনে খাওয়ার বিলাসিতা ছিল না ঠিকই, কিন্তু গ্রামে গেলেই কৃষকের আমবাগান থেকে পাকা আম পেড়ে খাওয়াটা তার খুব প্রিয় অভ্যাস ছিল!
মোদির এই আম-প্রীতির খবর ফাঁস হওয়ার কিছুকাল পর থেকেই বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতি বছর দিল্লিতে গ্রীষ্মের মৌশুমে আম উপহার পাঠাতে শুরু করেন।
ওই সময় দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, নিরামিষাশী নরেন্দ্র মোদিকে পদ্মার ইলিশ পাঠিয়ে তো কোনো লাভ নেই! কিন্তু আম এমন একটি উপহার, এই পুরো উপমহাদেশে সবাই যেটা পেতে ভীষণ পছন্দ করেন।
দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির কাছেই শুধু নয়, পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরার মতো বাংলাদেশ-লাগোয়া রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের কাছেও এরপর থেকে নিয়মিত পৌঁছে যেতে শুরু করে শেখ হাসিনার পাঠানো রংপুরের হাড়িভাঙা কিংবা রাজশাহীর আম্রপালীর ঝুড়ি। শুধু ভারতে নয়, পাকিস্তানের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকেও আম উপহার পাঠিয়ে শেখ হাসিনা অনেককেই চমকে দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার পতনের পর ঢাকায় যে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে, তারাও যে ভারতে শেখ হাসিনার আমলের এই ‘আম কূটনীতি’র পরম্পরা অব্যাহত রাখবে, তা পর্যবেক্ষকদের অনেকের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু অবশেষে ঠিক সেটাই ঘটেছে।
মৌসুম শেষের দিকে। তবে এবার ফলন ভালো হওয়ায় এখনো বাজারে আমের সরবরাহ পর্যাপ্ত। ছবি: ফোকাস বাংলা
ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রিয়জিত দেবসরকার যেমন বললেন, আমেরিকার দিক থেকে ট্যারিফের চাপ, মধ্যপ্রাচ্যের সংকট, ঘরের পাশে মিয়ানমারের পরিস্থিতি— নানা কারণে বাংলাদেশ প্রবল চাপে আছে বলেই ড. ইউনূসকে ভারতের সঙ্গে এই আম কূটনীতির রাস্তা নিতে হয়েছে বলে আমার ধারণা। দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করার কথা এখন তারা প্রকাশ্যেও বলছেন। এখন এই হাঁড়িভাঙা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কী অম্লমধুর স্বাদের রেশ রেখে যায়, দেখার বিষয় সেটাই।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানে আমকে কেন্দ্র করে কূটনীতি ও পরস্পরের মধ্যে বাণিজ্য প্রতিযোগিতা অবশ্য নতুন কিছু নয়। দিল্লি ও ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন ধরেই নিজেদের সেরা জাতের আম বিশ্বনেতাদের উপহার দিয়ে আসছে।
বিশ্বে যে তিনটি দেশ সবচেয়ে বেশি আম রপ্তানি করে, সেগুলো হলো— যথাক্রমে ভারত, মেক্সিকো ও পাকিস্তান। বাংলাদেশও এই তালিকায় প্রথম দশের মধ্যেই আছে। আম রপ্তানির নতুন নতুন বাজার খোঁজার চেষ্টায় এই দেশগুলোর মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতাও আছে।
পাকিস্তানে ৩৭ বছর আগে যে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট জিয়া উল হকের মৃত্যু হয়েছিল, সেই রহস্যময় ঘটনার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কয়েক বাক্স আমের নাম। ফলে বিশ্বের এই অঞ্চলে আম মানে অতি সুস্বাদু একটি ফলই শুধু নয়, আমের ঝুড়ির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে রহস্য, রাজনীতি, রেষারেষি আর কূটনীতির ঘেরাটোপ।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়। দুই দেশেরই জাতীয় ফল আম। দুই দেশই এই আমকে তাদের গ্লোবাল আউটরিচ বা কূটনীতির বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পঞ্চাশের দশকে যখনই বিদেশ সফরে যেতেন, উপহার হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যেতেন আমের বাক্স। আবার বিদেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীরা ভারত সফরে এলেও তারা পন্ডিত নেহরুর কাছ থেকে অবধারিতভাবে আম উপহার পেতেন।
জওহরলাল নেহরু ও চৌ এন লাই, ১৯৫৫তে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের সময়। ছবি: সংগৃহীত
১৯৫৫ সালে চীন সফরে গিয়ে পন্ডিত নেহরু চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে দশেরি ও ল্যাংড়া আমের আটটি চারা উপহার দিয়েছিলেন, যেগুলো রোপণ করা হয়েছিল গুয়াংঝৌ পিপলস পার্কে। আবার সে বছরই সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ভারত সফরে আসেন। তার মস্কোগামী ফিরতি বিমানে সঙ্গে গিয়েছিল জওহরলাল নেহরুর উপহার উত্তরপ্রদেশের বিখ্যাত মালিহাবাদী আমের অনেকগুলো ঝুড়ি।
পরে নেহরুর দৌহিত্র রাজীব গান্ধী দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৮৬তে যখন ফিলিপাইন সফরে যান, সে দেশের প্রেসিডেন্ট কোরাজন অ্যাকিনোর হাতেও তিনি উপহার হিসেবে আমের বাক্সই তুলে দিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার, ফিলিপাইনের জাতীয় ফলও আম! তবে সে আমের স্বাদ-গন্ধ ও চরিত্র অবশ্যই ভারতের আমের চেয়ে অনেক আলাদা।
আম উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানও পিছিয়ে ছিল না। চীনকে দেওয়া পাকিস্তানের আম তো সে দেশে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকেও পরিণত হয়েছিল। ১৯৬৮ সালের অগাস্ট মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঁয়া আর্শাদ হুসেইন বেইজিং সফরে গিয়ে চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুংকে এক বাক্স আম উপহার দেন।
আম তখনও চীনে অপরিচিত একটি ফল। মাও নিজেও এই নতুন ফলটি চেখে দেখতে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না। ফলে তিনি দেশের বিভিন্ন কারখানা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই আমগুলো বিলি করে দেন। এরপর চীনের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা কারখানায় চেয়ারম্যানের সেই উপহার নিয়ে যে মাতামাতি শুরু হয়েছিল, আমকে ফর্ম্যালডিহাইডে সংরক্ষণ করে, কাঁচের পাত্রে ও পূজার বেদীতে রেখে শ্রমিক ও ছাত্ররা যেভাবে সম্মান জানাতে শুরু করেন, তা আজও ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে উত্তেজনা কমানোর চেষ্টাতেও আমকে ব্যবহার করেছে। ১৯৮১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়া উল-হক ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে এমন এক আমের বাক্স উপহার পাঠান, যে প্রজাতিটি পাকিস্তানে ‘আনোয়ার রাতাওল’ নামে পরিচিত।
‘রাতাওল’ নামে ভারতের উত্তরপ্রদেশেও একটি গ্রাম আছে। আর সেই আমের উৎপত্তি আসলে ভারতে না পাকিস্তানে, তখন সেই বিতর্ক ছাপিয়ে গিয়েছিল উপহারের সৌজন্যকে।
২০০৮ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারিও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে আমের বাক্স উপহার পাঠিয়েছিলেন। তবে তার কিছুদিন পরেই মুম্বাইতে ২৬/১১’র হামলা সেই উষ্ণতায় জল ঢেলে দেয়।
সাত বছর পর ২০১৫ সালে পাকিস্তানের তখনকার নেতা নওয়াজ শরিফ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ও বিরোধী দলীয় নেতা সোনিয়া গান্ধীকে আমের বাক্স পাঠান। দুই দেশের সংঘাত নিরসনে সেই উপহারও খুব একটা কাজে আসেনি!
জার্নাল অব এশিয়ান অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে প্রকাশিত এক নিবন্ধে গবেষক জাহিদ শাহাব আহমেদ ও মহম্মদ জাহানজাইব দাবি করেছেন, আম নিয়ে কূটনীতি আর বাণিজ্যের দৌড়ে পাকিস্তান কিন্তু ভারতকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে।
ভারতে প্রায় ১২০০ জাতের আম উৎপন্ন হয়, যেখানে পাকিস্তানের আম হয় মোটামুটি ৪০০ জাতের। ফলনের পরিমাণও ভারতে অনেক বেশি। তবে আম যেভাবে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান রপ্তানিমুখী কৃষিপণ্য, ভারতের ক্ষেত্রে সেটি ততটা নয়। কোভিড মহামারির আগের বছরেও পাকিস্তান ১২৭ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের আম রফতানি করেছিল।
ওই দুই গবেষক বলছেন, আম রপ্তানির ক্ষেত্রে পাকিস্তানের একটি সুচিন্তিত স্ট্র্যাটেজি আছে। বিদেশে নিয়মিত ‘আম উৎসব’ বা ‘আম প্রদর্শনী’র আয়োজন করে, বিদেশের নেতা-মন্ত্রী-নীতিনির্ধারকদের আম খাইয়ে ও উপহার দিয়ে তারা পাকিস্তানি আমের একটা দারুণ বাজার তৈরি করতে পেরেছেন।
চীনে একটি আমকে সামনে রেখে চেয়ারম্যান মাওয়ের প্রশস্তিসূচক পোস্টার, ১৯৬৮ সালের। ছবি: সংগৃহীত
আম বিক্রির জন্য চিরাচরিতভাবে বিশ্বের যে বাজারগুলোতে নজর দিয়ে আসা হয়েছে, তার একটি হলো আমেরিকা, আরেকটি চীন। পাশাপাশি ইউরোপেও দক্ষিণ এশিয়ার আমের একটা বড় বাজার আছে। তবে চীনে আম রপ্তানি করতে ভারতের চেষ্টা কখনোই তেমন সফল হয়নি।
২০০৪ সালেই চীন ভারতীয় আমের জন্য তাদের মার্কেট অ্যাকসেস খুলে দেয়। তারপরও ভারতের রপ্তানিকারকরা সেখানে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেননি। ২০১৫-১৬ সালে ভারতের ব্যবসায়ীরা সারা বিশ্বে ৩১৭ কোটি রুপিরও বেশি দামের আম রফতানি করেছিলেন, সেখানে চীনে রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ২৪ হাজার রুপির আম। বাংলাদেশ অবশ্য মাত্র এ বছর চীনে আম রপ্তানি শুরু করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ভারতের আম রপ্তানি প্রায় দীর্ঘ দুই দশক ধরে নিষিদ্ধ ছিল। ২০০৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ভারত সফরে গেলে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেটাকে তখন ‘ম্যাংগো ইনিশিয়েটিভ’ বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে, প্রেসিডেন্ট বুশ নাকি দিল্লিতে গিয়ে ভারতের আম খেতে খুবই উদগ্রীব ছিলেন। তার ব্যক্তিগত আগ্রহেই আম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
এরপর যখন ২০০ সালের ১৭ এপ্রিল নিউ ইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্টে ভারতীয় আমের ১৫০ কার্টন গিয়ে নামল, নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, ‘ইতিহাসে বোধহয় এটাই সবচেয়ে প্রতীক্ষিত কোনো ফলের ডেলিভারি!’
ওদিকে ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের দূতাবাসও নিয়মিত মার্কিন সিনেটর বা নেতা-মন্ত্রীদের আম উপহার পাঠিয়ে থাকে। তাদের দূতাবাসের লনে ‘ম্যাংগো পার্টি’ও হামেশাই হয়ে থাকে।
রপ্তানির জন্য পাকিস্তানি আমের চাহিদা কেন তুলনামূলকভাবে বেশি, দিল্লিতে আম বিশেষজ্ঞ প্রতীপ কুমার দাশগুপ্ত তার আবার একটা ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, আসলে যে আমের ‘শেলফ লাইফ’ যত বেশি, মানে বেশিদিন যে আমটা ভালো থাকে, রপ্তানির জন্য সেটাই বেশি উপযুক্ত। কারণ ফলের বাগান থেকে লন্ডন-নিউইয়র্কের দোকানে পৌঁছতে একটা আমের পাঁচ-সাত দিন লেগেই যায়। ততদিন পর্যন্ত সেই আমটায় এতটুকুও পচন ধরা চলবে না।
অথচ ভারতের কোঙ্কন উপকূল ও মহারাষ্ট্রের আলফানসো ছাড়া বেশির ভাগ প্রজাতির আমেই আঁশ বা ফাইবার বেশি। ফলে সেগুলোতে পচনও ধরে তাড়াতাড়ি, যদিও স্বাদে-গন্ধে সেগুলো হয়তো কোনো অংশেই কম নয়।
পাকিস্তানের শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে সেখানকার আমে আবার আঁশ খুব কম, ‘শেলফ লাইফ’ও বেশি। প্রতীপ কুমার দাশগুপ্ত বলেন, ঠিক এ কারণেই ভারতের আলফানসো ছাড়া অন্য প্রজাতির আম কমই রপ্তানি হয়। অন্যদিকে পশ্চিমা বাজারে পাকিস্তানের সিন্ধ্রি, চৌসা বা আনোয়ার রাতাওলের এত কদর।
এ বছরই প্রথম চীনে আম রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। গত ২৮ মে চীনে পাঠানোর জন্য আমের চালান বিমানবন্দরে পরীক্ষা করে দেখছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। ছবি: বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
১৯৮৮ সালের ১৭ অগাস্ট পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুরে একটি সামরিক ট্যাংক বহরের রুটিন প্যারেড প্রদর্শন করে রাজধানীতে ফেরার জন্য বিমানে চাপেন দেশের প্রেসিডেন্ট তথা সামরিক শাসক জেনারেল মুহাম্মদ জিয়া উল-হক। প্রেসিডেন্টকে বহনকারী ওই সি-১৩০ হারকিউলিস এয়ারক্র্যাফটটি পরিচিত ছিল ‘পাক ওয়ান’ নামে।
সেদিন ফেরার সময় ওই বিমানে প্রেসিডেন্ট ছাড়াও সেনাবাহিনীর বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও ছিলেন। আর ছিলেন পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্নল্ড র্যাফেল। ফিরতি বিমানে বাহাওয়ালপুর থেকে প্রেসিডেন্ট ও অন্য অতিথিদের জন্য উপহার হিসেবে কিছু আমের বাক্সও তুলে দেওয়া হয়েছিল। মসৃণ টেক-অফের কিছুক্ষণ পরেই ‘পাক ওয়ানে’র সঙ্গে কন্ট্রোল টাওয়ারের সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা পরে জানিয়েছেন, বিমানটি ভীষণ এলোমেলোভাবে উড়ছিল, তারপরই সেটাতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে ও বিমানটি মুখ থুবড়ে পড়ে। জেনারেল জিয়া উল-হক ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ বিমানের মোট ৩১ জন যাত্রীই সে দিন নিহত হন।
এই ‘দুর্ঘটনা’ ঠিক কীভাবে ঘটেছিল, এতে কোনো নাশকতার ছাপ ছিল কি না— সেই রহস্য আজও পুরোপুরি উদ্ঘাটিত হয়নি।তবে জেনারেল জিয়া উল-হকের এই মৃত্যু নিয়ে যথারীতি অনেকগুলো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বা কনস্পিরেসি থিওরি চালু আছে। এমনই একটা থিওরি হলো— বাহাওয়ালপুর থেকে বিমানে উঠিয়ে দেওয়া আমের বাক্সেই লুকোনো ছিল বোমা আর বিস্ফোরক!
‘পাক ওয়ান’ ক্র্যাশ করার সেই সত্যি ঘটনার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে জিয়া উল-হকের মৃত্যুর ঠিক ২০ বছর পর একটি উপন্যাস বা আধা-ফিকশন লিখেছিলেন পাকিস্তানি লেখক মোহামেদ হানিফ। বেস্টসেলার বইটির নাম ছিল ‘আ কেস অব এক্সপ্লোডিং ম্যাংগোজ’।
মোহামেদ হানিফ নিজে এক সময় ছিলেন পাকিস্তানি এয়ারফোর্সের সদস্য ও ফাইটার জেটের পাইলট ছিলেন। পরে সাংবাদিকতায় এসে তিনি লন্ডনে বিবিসি উর্দু বিভাগের প্রধান হিসেবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। লন্ডনে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের একদা আইকনিক সদর দপ্তর বুশ হাউজে তিনি ছিলেন সহকর্মী।
পরে ঘরোয়া আড্ডায় সামরিক বাহিনীর একজন ‘ইনসাইডার’ বা ভেতরের লোক হিসেবে তার কাছে জেনারেল জিয়া উল-হকের মৃত্যু নিয়ে কী খবর ছিল জানতে চাইলে মোহামেদ হানিফ সবসময়ই হেসে প্রশ্ন এড়িয়ে যেতেন। কখরনা হয়তো বলতেন, ‘আমার বইটা আবার ভালো করে পড়ুন, তাহলেই উত্তর পেয়ে যাবেন!’
আমের ঝুড়িকে কেন্দ্র করে রহস্যের জট তাতে যথারীতি খোলেনি। বরং আরও বেড়েছে। পাশাপাশি এটিও স্পষ্ট হয়েছে— এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতেও আম কখনোই ‘আম’ নয়, বরং ‘খাস’ হিসেবেই চিরকাল নিজের জায়গা করে নিয়েছে।
এই যুদ্ধের পটভূমি বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে তার আগের দশকগুলোতে। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালের আশপাশে পারস্য সাম্রাজ্য তখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্য। বর্তমান ইরান, ইরাক, তুরস্ক, আফগানিস্তান, মিশরসহ এক বিশাল এলাকা জুড়ে পারস্যের শাসন বিস্তৃত ছিল।
১ দিন আগেপিরিয়ড মানেই নারীর শরীরে নানা ধরনের হরমোনের ওঠানামা। ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন ইত্যাদি হরমোনের তারতম্যের ফলে শারীরিক ও মানসিক নানা পরিবর্তন ঘটে। পেটব্যথা, মাথাব্যথা, ক্লান্তি, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, হজমের সমস্যা—এই সবই পিরিয়ডের সময় অনেক নারীর নিত্যসঙ্গী।
১ দিন আগেলাভজনক হওয়া সত্ত্বেও বেনাপোল-খুলনা-মোংলা (যশোর হয়ে) রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী বেতনা কমিউটার ট্রেন বেসরকারি খাতে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, বর্তমান আয়ের তুলনায় বেশি অর্থ পেলে নীতিমালা অনুযায়ী লিজ দেওয়া যেতে পারে। যদিও এই উদ্যোগ ঘিরে উঠেছে নানা প্রশ্ন।
১ দিন আগেআগে অনেকেই এমন করতেন—ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে যাওয়া কোনো ভিডিও বা ক্লিপ নিয়ে সেটি নিজের চ্যানেলে দিয়ে দিতেন, যাতে প্রচুর ভিউ হয় এবং সহজেই অর্থ আয় করা যায়। ইউটিউব এবার এটিকে বলছে ‘ইনঅথেন্টিকেটেড কন্টেন্ট’ বা ‘অসত্য কনটেন্ট’। এর মানে, যা নিজের নয় এবং তাতে নতুন কিছু যোগ করা হয়নি—সেই কনটেন্ট আর মানিটাইজ হবে না
২ দিন আগে