ফিচার

গরম ভাতে ঘি খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৫, ১৯: ৫৮
ঘিয়ের উপকারিতা ও অপকারিতা উভয়িই আছে। ছবি: এইআইয়ের সাহায্যে তৈরি

গরম ভাতে এক চামচ ঘি—বাংলা ঘরের অতি পরিচিত একটি দৃশ্য। আমাদের পূর্বপুরুষেরা নিয়মিত এইভাবে ভাত খেতেন। অসুস্থতা, অপুষ্টি কিংবা প্রসূতি নারীদের ক্ষেত্রেও এই খাবারটি দেওয়া হতো পুষ্টির উৎস হিসেবে। এক সময় এটি ছিল দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসের অংশ। কিন্তু আধুনিক যুগে এসে যখন মানুষ স্বাস্থ্য নিয়ে আরও বেশি সচেতন, তখন প্রশ্ন উঠেছে—ঘি কি আদৌ উপকারী? গরম ভাতে ঘি মিশিয়ে খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো, নাকি এতে রয়েছে বিপদের সম্ভাবনাও?

ঘি, যা মূলত গরুর দুধ থেকে তৈরি, এক ধরনের পরিষ্কার মাখন। এটি তৈরি হয় দুধ থেকে প্রথমে দই, তারপর মাখন, শেষে সেই মাখন ফেটে ঘন সোনালি বর্ণের ঘি প্রস্তুত করা হয়। এতে থাকে ভিটামিন এ, ডি, ই এবং কে, আর চর্বির একটি বড় অংশই সম্পৃক্ত। তবে এই চর্বি কতটা উপকারী বা ক্ষতিকর, তা নির্ভর করে আমরা কতটা এবং কীভাবে ঘি খাচ্ছি তার উপর।

গরম ভাত ও ঘি—এই দুই উপাদান যখন একত্র হয়, তখন তা শুধু স্বাদের দিক থেকে নয়, বরং পুষ্টিগুণেও সমৃদ্ধ হতে পারে। কলকাতার আয়ুর্বেদ চিকিৎসক ডা. শঙ্কর মুখার্জি বলেন, “গরম ভাতে এক চামচ ঘি শরীরের জন্য খুবই উপকারী। এটি ত্রিদোষ হ্রাস করে, হজমে সাহায্য করে এবং মস্তিষ্ককে শান্ত করে। বিশেষ করে গরম ভাতের উপর ঘি গলে গেলে তা সহজে হজম হয় এবং শরীরের উপকার করে।”

এই বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলিতেও বিস্তর গবেষণা হয়েছে। ২০১৮ সালে ‘জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল লিপিডোলজি’ নামের একটি চিকিৎসা সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, ঘিতে থাকা ‘কনজুগেটেড লিনোলিক অ্যাসিড’ বা সংক্ষেপে সিএলএ হৃদপিণ্ডের জন্য উপকারী হতে পারে। তবে গবেষকরা সতর্ক করেছেন, উপকারিতার বিষয়টি নির্ভর করে ঘির পরিমাণের ওপর। আমেরিকার বিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক ড. ওয়াল্টার উইলেট বলেন, “ঘি এক ধরনের সম্পৃক্ত চর্বি। তবে বিশুদ্ধ হলে এবং অল্প পরিমাণে খাওয়া হলে এটি শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়—উল্টো কিছু ক্ষেত্রে উপকারও করতে পারে।”

এক চামচ ঘিতে প্রায় ১২০ ক্যালোরি শক্তি থাকে, যার মধ্যে প্রায় ১৪ গ্রাম চর্বি এবং ৯ গ্রাম সম্পৃক্ত চর্বি থাকে। তবে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিশুদ্ধ ঘিতে রূপান্তরিত চর্বি বা ট্রান্স ফ্যাট থাকে না। এই রূপান্তরিত চর্বি হলো সেই ধরনের কৃত্রিম চর্বি, যা হৃদপিণ্ডের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর বলে বিবেচিত হয়। অনেক সময় বনস্পতি জাতীয় ঘিতে এই ট্রান্স ফ্যাট বা রূপান্তরিত চর্বি মিশে যায়।

ঘিতে থাকা ‘বিউটিরেট’ নামের একটি ফ্যাটি অ্যাসিড অন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়ক। এটি অন্ত্রের প্রদাহ কমায় এবং উপকারী ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি ঘটায়। ‘জার্নাল অফ নিউট্রিশনাল বায়োকেমিস্ট্রি’তে প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়েছে, বিউটিরেট অন্ত্রের জন্য খুবই উপকারী এবং হজমশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।

ঘি-ভাত দ্রুত শক্তি জোগায়। এর মধ্যে থাকা মাঝারি দৈর্ঘ্যের ট্রাইগ্লিসারাইড (যাকে বলে মিডিয়াম চেইন ট্রাইগ্লিসারাইড) সহজে হজম হয় এবং তাৎক্ষণিক শক্তি হিসেবে কাজ করে। তাই ছোট শিশু, দুর্বল বা অসুস্থ মানুষ, গর্ভবতী নারী—এদের জন্য এটি কখনও কখনও আদর্শ খাদ্য হতে পারে। ভারতের জাতীয় পুষ্টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউট্রিশন) গবেষক ড. আর কে শুক্লা বলেন, “মাতৃদুগ্ধের পর শিশুদের জন্য ঘি-মিশ্রিত ভাত এক আদর্শ শক্তিদায়ী খাবার হতে পারে।”

আয়ুর্বেদের মতে, ঘি শরীর ঠান্ডা রাখে এবং মানসিক চাপ কমায়। এতে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে, এমনকি উদ্বেগ ও অবসাদও কমায়। ঘি ভাতে মিশিয়ে খেলে ভাত সহজে হজম হয় এবং শরীরে চর্বির শোষণ প্রক্রিয়াও উন্নত হয়।

তবে সবকিছুর মতো এখানেও রয়েছে কিছু সতর্কতা। যাঁদের ওজন বেশি, যাঁরা অফিসে বসে কাজ করেন এবং শারীরিক পরিশ্রম কম করেন—তাঁদের জন্য প্রতিদিন ঘি খাওয়া উচিত নয়। কারণ ঘি একটি উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবার, যা অতিরিক্ত খেলে সহজেই ওজন বাড়িয়ে দিতে পারে। আবার যাঁদের কোলেস্টেরলের মাত্রা আগে থেকেই বেশি, তাঁদের জন্য ঘি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ব্রিটেনের ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশনের পুষ্টিবিদ ভিক্টোরিয়া টেইলর বলেন, “ঘিতে কিছু উপকারী চর্বি থাকলেও এটি ভুলে গেলে চলবে না যে এটি অত্যন্ত ক্যালোরিযুক্ত। বেশি খেলে ওজন এবং হৃদপিণ্ড দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”

আর একটি বড় সমস্যা হলো বাজারে মেলে ভেজাল ঘি। অনেক সময় ঘির নাম করে বনস্পতি বা হাইড্রোজেনেটেড তেল বিক্রি হয়, যাতে ট্রান্স ফ্যাট বা রূপান্তরিত চর্বি থাকে প্রচুর পরিমাণে। এই চর্বি শরীরে জমে গিয়ে ধমনিতে ব্লক তৈরি করে। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (ইউএস এফডিএ) বলেছে, “এই রূপান্তরিত চর্বি হৃদপিণ্ডের জন্য ভয়ানক হুমকি।”

এই কারণে ঘি খেতে হলে ঘরেই তৈরি ঘি ব্যবহার করা ভালো, অথবা এমন উৎস থেকে নিতে হবে যেখান থেকে বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের পুষ্টিবিদ অ্যামি জ্যামিনেট বলেন, “বিশুদ্ধ ঘি যদি একটি সুসংহত খাদ্য তালিকার অংশ হিসেবে খাওয়া হয়, তবে সেটি উপকার করতে পারে। তবে এটিকে কোনো ‘অলৌকিক খাবার’ ভাবা ভুল। ঘির উপকারিতা নির্ভর করে এটি কীভাবে তৈরি হয়েছে এবং কীভাবে খাওয়া হচ্ছে তার ওপর।”

সবশেষে বলা যায়, গরম ভাতে ঘি মিশিয়ে খাওয়ার অভ্যাসটি শুধু রুচি কিংবা ঐতিহ্যের বিষয় নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে কিছু বৈজ্ঞানিক যুক্তিও। এটি হজমে সহায়ক, শক্তি জোগায়, অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে এবং মানসিক প্রশান্তি আনে। তবে সবকিছু নির্ভর করে পরিমাণ ও বিশুদ্ধতার ওপর। অতিরিক্ত খাওয়া, ভেজাল ঘি ব্যবহার এবং শারীরিক পরিশ্রমহীন জীবনযাপন—এই তিনটি থাকলে ঘি উপকারী নয়, বরং ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। তাই পরিমিতি বোধ, সঠিক জ্ঞানে খাদ্য নির্বাচন এবং নিজের শরীরের প্রেক্ষিতে সচেতন সিদ্ধান্তই হতে পারে সুস্থতার চাবিকাঠি।

আপনার নির্দেশনা অনুযায়ী সংশোধন করেছি। চাইলে এবার এর সঙ্গে একটি প্রতীকী জলরঙ ছবি তৈরি করে দিতে পারি, যা লেখাটির সঙ্গী হতে পারে। জানাবেন যদি চান।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

লাভজনক কমিউটার ট্রেন বেসরকারি খাতে হস্তান্তরে তোড়জোড়

লাভজনক হওয়া সত্ত্বেও বেনাপোল-খুলনা-মোংলা (যশোর হয়ে) রুটে চলাচলকারী যাত্রীবাহী বেতনা কমিউটার ট্রেন বেসরকারি খাতে হস্তান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, বর্তমান আয়ের তুলনায় বেশি অর্থ পেলে নীতিমালা অনুযায়ী লিজ দেওয়া যেতে পারে। যদিও এই উদ্যোগ ঘিরে উঠেছে নানা প্রশ্ন।

১৯ ঘণ্টা আগে

ইউটিউবের নতুন মনিটাইজেশন নীতি : কী থাকছে কনটেন্ট নির্মাতাদের জন্য

আগে অনেকেই এমন করতেন—ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে যাওয়া কোনো ভিডিও বা ক্লিপ নিয়ে সেটি নিজের চ্যানেলে দিয়ে দিতেন, যাতে প্রচুর ভিউ হয় এবং সহজেই অর্থ আয় করা যায়। ইউটিউব এবার এটিকে বলছে ‘ইনঅথেন্টিকেটেড কন্টেন্ট’ বা ‘অসত্য কনটেন্ট’। এর মানে, যা নিজের নয় এবং তাতে নতুন কিছু যোগ করা হয়নি—সেই কনটেন্ট আর মানিটাইজ হবে না

২ দিন আগে

ব্যাটল অব ম্যারাথন: সভ্যতার মোড় ঘোরানো যুদ্ধ

সমস্যার শুরু যখন পারস্যের অধীনে থাকা আয়োনীয় (বর্তমান তুরস্কের উপকূলীয় অঞ্চল) কিছু গ্রিক নগররাষ্ট্র বিদ্রোহ করে এবং অ্যাথেন্স তাদের সাহায্য করে। দরিয়ুস এটাকে নিজের সাম্রাজ্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখেন এবং অ্যাথেন্সকে শিক্ষা দিতে একটি সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করেন।

২ দিন আগে

পুদিনা পাতা কেন খাবেন

পুদিনা পাতা হজমে সহায়ক। প্রাচীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় পুদিনা পাতাকে পেট ঠাণ্ডা রাখা, গ্যাস-অম্বল কমানো এবং হজমশক্তি বাড়ানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

২ দিন আগে