স্বাস্থ্য

কফির উপকারিতা ও অপকারিতা

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
আপডেট : ১০ জুলাই ২০২৫, ১৭: ০০

সকালে ঘুম ভাঙার পর কিংবা সন্ধ্যায় ক্লান্তি ঝরাতে অনেকেরই প্রথম পছন্দ এক কাপ গরম কফি। কেউ খায় তীব্র তেতো স্বাদের জন্য, কেউ আবার নেশার মতো অভ্যাসে। কফি নিয়ে বিশ্বজুড়ে রয়েছে আগ্রহ, গবেষণা আর বিতর্ক। অনেকেই বলেন, কফি শরীরের জন্য ভালো। আবার অনেকে এটিকে মনে করেন একটি ধীর বিষ—যা ধীরে ধীরে শরীরের ক্ষতি করে। কিন্তু আসলে কী সত্যি? কফি কি আমাদের শরীরের বন্ধু, নাকি অজান্তেই হয়ে উঠছে শত্রু?

কফির প্রধান উপাদান হলো ক্যাফেইন। এই ক্যাফেইনই আমাদের সজাগ রাখে, মাথা হালকা করে, ক্লান্তি দূর করে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড টি.এইচ. চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. ওয়াল্টার উইলেট বলেন, “মিতবিহীন মাত্রায় কফি খেলে এটি শরীরের জন্য উপকারী হতে পারে। এতে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, পলিফেনল ও অন্যান্য জৈব উপাদান শরীরের কোষগুলিকে রক্ষা করে।” তিনি আরও বলেন, “কফি হৃদ্‌রোগ, টাইপ-টু ডায়াবেটিস ও কিছু কিছু ক্যানসার থেকে রক্ষা করতে পারে।”

একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ২-৩ কাপ কফি খাওয়া মানুষেরা অন্যদের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘজীবী হন। ২০১৮ সালে ‘জার্নাল অফ আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’-এ প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণে বলা হয়, কফিপ্রেমীদের মৃত্যুহার কিছুটা কম। এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের গবেষক ড. নেভিন ঝাং, যিনি বলেন, “আমরা ৫ লাখ মানুষের উপরে গবেষণা চালিয়ে দেখতে পাই, যাঁরা নিয়মিত কফি পান করেন, তাঁদের মধ্যে হূদরোগ, লিভার সমস্যা এবং স্নায়বিক রোগে মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম।”

তবে কফির উপকারিতা নির্ভর করে ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা, বয়স, অন্যান্য খাদ্যাভ্যাস এবং দিনে কত কাপ খাচ্ছেন তার উপর। যেমন, গর্ভবতী নারীদের জন্য বেশি কফি খাওয়া ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ অতিরিক্ত ক্যাফেইন ভ্রূণের বিকাশে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।

এছাড়া, কফি যখন অতিরিক্ত খাওয়া হয়—বিশেষ করে দিনে ৪ কাপ বা তার বেশি—তখন এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। বেশি ক্যাফেইন অনিদ্রা তৈরি করে, মেজাজ খিটখিটে করে দেয়, মাথাব্যথা ও নার্ভাসনেস বাড়ায়। আবার যাঁরা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কফি হঠাৎ রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে।

যুক্তরাজ্যের কিংস কলেজ লন্ডনের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. রেবেকা স্যান্ডার্স বলেন, “ক্যাফেইন সরাসরি স্নায়ু উদ্দীপিত করে। এটা সাময়িকভাবে কাজে আসে ঠিকই, কিন্তু যাঁরা খুব সহজে উদ্বেগে ভোগেন বা ঘুমের সমস্যা রয়েছে, তাঁদের জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ।”

তবে কফি যে সবসময় ক্ষতিকর এমন নয়। এতে থাকা ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড, কফেইন অ্যাসিড, ম্যাগনেশিয়াম এবং নায়াসিন প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের শরীরকে সক্রিয় রাখে। এমনকি কিছু কিছু গবেষণা বলছে, কফি আলঝেইমার ও পার্কিনসন রোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। ২০১৯ সালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন এজিং-এর গবেষক ড. মারিয়া রিভেরা বলেন, “ক্যাফেইনযুক্ত কফি নিউরোট্রান্সমিটারে কিছু ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা স্মৃতিশক্তি রক্ষা করে এবং বয়ঃজনিত মস্তিষ্কের অবক্ষয়কে ধীর করে দেয়।”

তবে কফির সঙ্গে যা মেশানো হচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন অনেকেই দুধ, চিনি, ক্রিম মিশিয়ে কফিকে ভারী পানীয় বানিয়ে ফেলেন। এতে ক্যালোরি ও ফ্যাটের মাত্রা বেড়ে গিয়ে ওজন বাড়তে পারে, রক্তে শর্করার ভারসাম্যও বিঘ্নিত হতে পারে। তাই কফি খাওয়ার সময় শুধু পরিমাণই নয়, পদ্ধতিও গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে এখন কফি পান করার প্রবণতা দ্রুত বাড়ছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে ক্যাফে সংস্কৃতির কারণে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কফি একটি রুচিশীল অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাঁরা কী জানেন কফির উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে? বহু তরুণ-তরুণী দিনে পাঁচ-ছয় কাপ পর্যন্ত কফি খেয়ে থাকেন—যা দীর্ঘমেয়াদে তাঁদের ঘুম, হরমোন ও হজমের সমস্যার কারণ হতে পারে।

কফির আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক দিক হলো, এটি অনেকের মধ্যে এক ধরনের আসক্তি তৈরি করে। কেউ কেউ কফি ছাড়া সকালে ঘুম ভাঙে না, মাথা কাজ করে না, এমনকি মাথাব্যথাও শুরু হয়ে যায়। এটি আসলে একধরনের ‘ক্যাফেইন ডিপেন্ডেন্সি’। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী ড. হ্যারি স্ট্যানফোর্ড বলেন, “ক্যাফেইন একটি মৃদু স্নায়ু-উদ্দীপক ড্রাগ। এটি নির্দিষ্ট মাত্রায় উপকারি, কিন্তু এতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে তা ছাড়া থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে।”

অন্যদিকে, অনেকেই কফি দিয়ে ডায়েট বা ওজন কমানোর চেষ্টা করেন। সত্যি বলতে, কফিতে কিছু পরিমাণে বিপাকক্রিয়া বাড়ানোর গুণ রয়েছে। এটি সাময়িকভাবে শরীরের ক্যালোরি পোড়ানোর হার বাড়াতে পারে। কিন্তু এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। আর কফির চেয়ে ব্যায়াম ও সুষম খাবার বরং বেশি কার্যকর ও নিরাপদ উপায়।

সবশেষে বলা যায়, কফি আমাদের জীবনের একটি অংশ হয়ে গেছে। এক কাপ কফি মানেই একটুখানি বিরতি, নিজের সঙ্গে সময় কাটানো কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। এটি যেমন স্বাদের বিষয়, তেমনি অভ্যাসেরও। তবে কফির পেছনে থাকা বিজ্ঞানের দিকগুলো না জানলে, ভালোবাসার এই পানীয়ও আমাদের শরীরের ক্ষতি করে ফেলতে পারে।

তাই কফি খাবেন নিশ্চিন্তে, তবে মাত্রায় ও সচেতনভাবে। সকালবেলায় এক কাপ কালো কফি আপনাকে যেমন সতেজতা দেবে, তেমনি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এক কাপ কফি হতে পারে নিদ্রাহানির কারণ। কফি তাই একাধারে উপকারি এবং অপকারি—এর নিয়ন্ত্রণই বলে দেয়, কোন পথে আপনি হাঁটছেন।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

নিম্নচাপ কেন হয়, এর বৈজ্ঞানিক কারণ কী

আবহাওয়াবিদদের ভাষায় নিম্নচাপ হলো একটি এমন আবহাওয়াগত পরিস্থিতি যেখানে বাতাসের চাপ চারপাশের তুলনায় কম হয়ে যায়। সাধারণত পৃথিবীর যেকোনো স্থানে বাতাস সবসময় উচ্চচাপ থেকে নিম্নচাপের দিকে প্রবাহিত হয়।

১০ ঘণ্টা আগে

ব্যাটল অব হ্যাস্টিংসের ইতিহাস

ইংল্যান্ডের সিংহাসন তখন ছিল এক জটিল রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্র। ইংরেজ রাজা এডওয়ার্ড দ্য কনফেসর ১০৬৬ সালের জানুয়ারিতে উত্তরাধিকারী ছাড়াই মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল—কে ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হবেন? রাজ্যের প্রধান অভিজাতেরা হ্যারল্ড গডউইনসনকে রাজা ঘোষণা করলেন।

১ দিন আগে

খালি পেটে লেবু খাওয়া ক্ষতিকর!

সকালে ঘুম থেকে উঠেই অনেকেই অভ্যাস বশে এক গ্লাস লেবু পানি খান। বিজ্ঞাপন আর স্বাস্থ্যবিষয়ক ম্যাগাজিনে এমন ধারণা ছড়িয়ে গেছে যে খালি পেটে লেবু খেলে শরীরের টক্সিন বের হয়ে যায়, ওজন কমে, আবার হজমশক্তিও নাকি বাড়ে। কিন্তু আসলেই কি খালি পেটে লেবু খাওয়া এতটা উপকারী? বিজ্ঞানীরা বলছেন, লেবুর কিছু ভালো দিক

১ দিন আগে

কেন ভাদ্র মাসে তাল পাকে?

১ দিন আগে