বিজ্ঞান
সুপারফুড আখরোটের উপকারিতা

আখরোট- বাদাম জাতীয় এক পরিচিত। দেখতে একটু অদ্ভুত হলেও এর ভেতরের খোসায় মোড়া বাদামি রঙের অংশটাই আসল রত্ন। শুধু স্বাদেই নয়, গুণেও অসাধারণ এই বাদামটি। পুষ্টিবিদরা একে বলেন 'সুপারফুড', কারণ এর ভেতরে রয়েছে এমন কিছু উপাদান যা শরীর ও মনের সুস্থতায় অনন্য ভূমিকা রাখে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা রোগ, টেনশন আর ব্যস্ততার মাঝে আখরোট হতে পারে এক নির্ভরযোগ্য খাদ্যসঙ্গী।
আখরোট মূলত এক ধরনের বাদাম জাতীয় ফল, যেটি গ্রিক ও রোমান সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক পশ্চিমা বিশ্বেও স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসেবে বহুদিন ধরেই স্বীকৃত। বর্তমানে আমেরিকা, চীন ও ইরান হলো আখরোট উৎপাদনে শীর্ষ দেশ। তবে এশিয়ার বহু দেশেই এখন এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পুষ্টিবিদ ও গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে এর উপকারিতা নিয়ে কাজ করে চলেছেন। তাঁদের গবেষণা বলছে, প্রতিদিন মাত্র কয়েকটি আখরোট খাওয়ার অভ্যাস শরীর ও মনের জন্য এক বিশাল উপকারী হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ‘টিএইচ চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথ’-এর গবেষক ড. ফ্র্যাঙ্ক হু বলেন, ‘আখরোট হলো এমন একটি খাবার যা হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষায় সরাসরি ভূমিকা রাখে। এতে রয়েছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং খারাপ কোলেস্টেরল কমায়।’
ড. হু আরও বলেন, ‘দিনে মাত্র ২৮ গ্রামের মতো আখরোট খাওয়ার অভ্যাস করলে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।’
হুর সঙ্গে একমত যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির নিউট্রিশন বিশেষজ্ঞ ড. সুজান রিডও। তিনি বলেন, ‘আখরোট শুধু রক্তচাপ কমায় না, এটি মস্তিষ্কের কোষকে সক্রিয় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’
আসলে আখরোটের এই উপকারিতার পেছনে রয়েছে এক বিস্ময়কর রাসায়নিক উপাদানসমষ্টি। এতে রয়েছে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যেমন ভিটামিন ই, পলিফেনলস ও মেলাটোনিন। এসব উপাদান শরীরের কোষকে রক্ষা করে, বার্ধক্যজনিত ক্ষয় প্রতিরোধ করে এবং ক্যানসারের সম্ভাবনা কমাতে সাহায্য করে। বিশেষ করে কোলন এবং স্তন ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে আখরোটের ভূমিকা এখন নানা গবেষণায় প্রতিষ্ঠিত।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য নিউট্রিশন সোসাইটি’-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, আখরোট নিয়মিত খেলে শরীরের ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ে, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। ওই গবেষণার প্রধান গবেষক ড. এলেন মার্টিন জানান, “আমরা ৬ মাস ধরে শতাধিক ডায়াবেটিস রোগীর ওপর পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখেছি, যারা প্রতিদিন ৩০ গ্রামের মতো আখরোট খেয়েছেন, তাঁদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্থিতিশীল থেকেছে এবং ওজনও নিয়ন্ত্রণে ছিল।”
আখরোট শুধু শরীর নয়, মনকেও সুস্থ রাখে। আধুনিক জীবনে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ যেন নিত্যসঙ্গী। কিন্তু আশার কথা হলো, আখরোটে থাকা ওমেগা-৩ এবং সেরোটোনিন উৎপাদনকারী উপাদান মস্তিষ্ককে প্রশান্ত রাখে এবং হতাশা কমাতে সাহায্য করে। ২০২৩ সালে কানাডার টরন্টো ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় জানা যায়, নিয়মিত আখরোট খাওয়া তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপ ও বিষণ্নতার হার অনেক কম দেখা গেছে। গবেষক দলের প্রধান, মনোবিজ্ঞানী ড. লরেন কুপার বলেন, ‘যেসব কিশোর-কিশোরী প্রতিদিন কিছু পরিমাণ আখরোট খেয়েছে, তাদের মনোযোগের ক্ষমতা, ঘুমের মান এবং আত্মবিশ্বাস তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল।’
শরীরের গাঁট ব্যথা, হাড় ক্ষয় কিংবা বাতের সমস্যা অনেকের জন্য নিয়মিত যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়ায়। আখরোটে থাকা ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম হাড়ের গঠন মজবুত করে এবং প্রদাহজনিত ব্যথা কমাতে সহায়তা করে। এই কারণে বয়স্ক মানুষদের জন্য আখরোট এক আদর্শ খাদ্য হতে পারে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, আখরোটে রয়েছে উচ্চমাত্রার ফাইবার, যা হজমে সাহায্য করে এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। ফাইবারযুক্ত খাবার নিয়মিত খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা কমে এবং শরীর থেকে টক্সিন বা বিষাক্ত পদার্থ বেরিয়ে যায় সহজে।
এত সব উপকারের কথা শুনে অনেকে ভাবতেই পারেন, তাহলে বেশি বেশি আখরোট খেলেই তো ভালো! কিন্তু এখানে একটু সচেতন হতে হবে। আখরোটে ফ্যাট বা চর্বি থাকলেও তা স্বাস্থ্যকর চর্বি, তবে পরিমাণে খাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। দিনে ৭-৮টি আখরোটই যথেষ্ট। বেশি খেলে ওজন বাড়ার আশঙ্কা থাকে।
আখরোট খাওয়ার নানা উপায় রয়েছে। কেউ কেউ কাঁচা খেতে পছন্দ করেন, কেউ আবার দুধে ভিজিয়ে খান। সকালের নাশতায় ওটস কিংবা স্যালাডে আখরোট যোগ করলে খাবার যেমন সুস্বাদু হয়, তেমনি স্বাস্থ্যকরও হয়। এমনকি মিষ্টি জাতীয় খাবারেও আখরোট ব্যবহার করা যায়।
একসময় শুধু অভিজাতদের খাবার হিসেবে দেখা হলেও, আজকের দিনে সচেতন মানুষের খাদ্যতালিকায় জায়গা করে নিচ্ছে এই আখরোট। বিশ্বজুড়ে পুষ্টিবিদরা যেমন একে স্বীকৃতি দিয়েছেন, তেমনি সাধারণ মানুষও এর উপকারিতা উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন।
সঠিক খাদ্যাভ্যাসই আমাদের সুস্থ ও সতেজ রাখতে পারে। সেই জায়গা থেকে দেখলে, আখরোট নিঃসন্দেহে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় থাকা উচিত। শরীর, মন আর মস্তিষ্ক—এই তিনের একত্র স্বাস্থ্যরক্ষায় ছোট্ট এই বাদামটি যেন এক বড় আশীর্বাদ।
সূত্র: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ, যুক্তরাষ্ট্র