বিজ্ঞান
ভাইরাস না ব্যাকটেরিয়া – কে আগে এসেছে?

ছোট ছোট জীবও কত বড় রহস্য তৈরি করতে পারে, তা ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়ার কাহিনি শুনলে বোঝা যায়। এই দুই অণুজীব পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে পুরনো জীবদের মধ্যে পড়ে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই দুইজনের মধ্যে কে আগে এসেছে?
এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে স্পষ্ট নয়। তবে বিভিন্ন গবেষণার সূত্র ধরে আমরা একটা ধারণা পেতে পারি।
ভাইরাস এক অদ্ভুত জিনিস, যাকে জীব বলা যায় কি না, তা নিয়েও মতভেদ আছে। ভাইরাসের শরীরে কোনও কোষ থাকে না। সে একা বেঁচে থাকতে পারে না। সে কেবল অন্য জীবের কোষে ঢুকে বেঁচে থাকতে ও বংশবৃদ্ধি করতে পারে। মানে, ভাইরাস একধরনের পরজীবী।
ভাইরাসের গায়ে থাকে শক্ত প্রোটিনের খোলস, যার ভেতরে থাকে ডিএনএ বা আরএনএ নামের জিনগত উপাদান। এই অংশই অন্য জীবের কোষে ঢুকে ভাইরাসকে বংশবৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
করোনা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, এইচআইভি – এরা সবই ভাইরাস। তারা মানুষের শরীরে ঢুকে ভয়ংকর অসুস্থতা সৃষ্টি করতে পারে। তবে সব ভাইরাসই খারাপ নয়। অনেক ভাইরাসের উপকারিতাও আছে। যেমন, ভাইরাসকে ব্যবহার করে এখন আধুনিক mRNA ভ্যাকসিন বানানো যায়, এটা আমাদের শরীরকে রোগের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে।
নোবেলজয়ী মার্কিন বিজ্ঞানী ড. ডেভিড বাল্টিমোর বলেন, "ভাইরাস একসময় কোনো জীবের ভেতরকার জিনগত উপাদান থেকে তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়। এরা জীব নয়, আবার সম্পূর্ণ অজীবও নয়। এদের অবস্থান দুয়ের মাঝখানে।"
অন্যদিকে ব্যাকটেরিয়া হলো এক ধরনের এককোষী জীব। এরা নিজেরাই খাবার তৈরি করতে পারে, বেঁচে থাকতে পারে এবং বংশবৃদ্ধি করতে পারে। মানে, এরা ভাইরাসের চেয়ে অনেক বেশি "জীবন্ত"।
বিজ্ঞানীদের মতে, ব্যাকটেরিয়া পৃথিবীতে এসেছে প্রায় ৩৫০ কোটি বছর আগে। তখন পৃথিবীতে অক্সিজেন ছিল না, সূর্যের তাপে চারদিক গরম আর প্রতিকূল পরিবেশ। তবুও ব্যাকটেরিয়া সেই কঠিন পরিবেশে বেঁচে ছিল, নিজেদের মতো করে টিকে গিয়েছিল।
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী ড. স্টিফেন মরিস বলেন, "ব্যাকটেরিয়া পৃথিবীর প্রথম জীব হতে পারে। তারা একা টিকে থাকতে পারে, খাবার তৈরি করতে পারে – এটাই প্রমাণ করে যে তারা প্রকৃত জীব।"
ব্যাকটেরিয়া শুধু রোগই সৃষ্টি করে না, বরং আমাদের শরীরের জন্য উপকারী কাজও করে। আমাদের অন্ত্রে থাকা কিছু ব্যাকটেরিয়া খাবার হজম করতে সাহায্য করে, প্রোটিন ও ভিটামিন তৈরি করে। আবার বিজ্ঞানীরা ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করে ইনসুলিনসহ নানা ওষুধ তৈরি করেন।
তাহলে কে আগে এল?
এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা যা জানতে পেরেছেন, তাতে ব্যাকটেরিয়ার আগমন আগে হয়েছে বলেই মনে হয়। কারণ ব্যাকটেরিয়া নিজেরাই বেঁচে থাকতে পারে, যা ভাইরাস পারে না।
অনেক বিজ্ঞানীর মতে, ভাইরাস আসলে পরে তৈরি হয়েছে, কোনো এক জীবের ভেতরের ডিএনএ বা আরএনএ থেকে। একে অনেকেই বলেন "জিনগত ছিটেফোঁটা" (genetic fragments) – যারা পরে নিজের খোলস তৈরি করে অন্য জীবের উপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্রের সান দিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটির ভাইরোলজিস্ট ড. ফোরেস্ট রোহার বলেন,"ভাইরাস হচ্ছে বিবর্তনের একটা জ্যান্ত দলিল। তারা অন্য জীবের অংশ থেকে তৈরি হয়েছে এবং এখন নিজের মতো করে টিকে আছে।"
ভাইরাস যেমন এমআরএনএ ভ্যাকসিন তৈরিতে কাজ দিচ্ছে, ব্যাকটেরিয়াও কাজ দিচ্ছে ওষুধ, পচন ও জৈব প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বিজ্ঞানীরা এখন ব্যাকটেরিয়ার জিন পরিবর্তন করে "রিকম্বিন্যান্ট ব্যাকটেরিয়া" বানাচ্ছেন, যেগুলো মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরি করতে পারে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান এখনো খুব সীমিত। যত বেশি গবেষণা হবে, তত নতুন নতুন তথ্য জানা যাবে। হয়তো একদিন আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারব, ভাইরাস না ব্যাকটেরিয়া—কে আগে এসেছিল।
তবে একটি বিষয় পরিষ্কার—এই দুই অণুজীব আজ আমাদের জীবনের অঙ্গ। তারা রোগের কারণ যেমন, তেমনি চিকিৎসার উপায়ও। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতেও তাদের বড় ভূমিকা আছে।
ড. অ্যানা-মারি ল্যাবার্জ, কানাডার কনকর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী, বলেন: "এই ক্ষুদ্র জীবগুলোর কারণে আমরা আজ রোগের প্রতিষেধক বানাতে পারছি, জিন থেরাপি করতে পারছি। এরা শুধু অতীতের নয়, ভবিষ্যতের দিকও বদলে দিতে পারে।"
ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়ার জন্মের ইতিহাস এখনো অনেকটা রহস্যে ঢাকা। তবে যেটুকু জানা গেছে, তা থেকেই বোঝা যায়—তারা শুধু অতীতের সাক্ষী নয়, আধুনিক বিজ্ঞানেরও গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
তারা আমাদের দেহে, আমাদের চারপাশে, এমনকি গভীর সমুদ্র বা বরফে ঢাকা মেরুতেও আছে। যত আমরা তাদের সম্পর্কে শিখব, তত আমাদের জীবন ও ভবিষ্যৎ আরও নিরাপদ ও উন্নত হবে।
সূত্র: বিবিসি