স্বাস্থ্য

পেঁপের পুষ্টিগুণ

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ২৪ মে ২০২৫, ১৩: ৫৬

পেঁপে আমাদের আশপাশে খুবই সহজলভ্য একটি ফল। গ্রামের বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে শহরের ছাদবাগান—প্রায় সব জায়গাতেই পেঁপে গাছ চোখে পড়ে। দামেও সস্তা, চেনা স্বাদে মিষ্টি, অথচ এই সাধারণ ফলটির গুণাগুণ এত বেশি যে, চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে পুষ্টিবিদ—সবার নজর কেড়েছে বহু বছর ধরে। পাকা পেঁপে যেমন সুস্বাদু ফল, তেমনি কাঁচা পেঁপেও উপকারী সবজি। রোজকার খাবারের তালিকায় যদি পেঁপে রাখা যায়, তাহলে শরীরের নানা উপকার হতে পারে—যা বহু গবেষণায় প্রমাণিত।

বিশ্বজুড়ে পেঁপে নিয়ে গবেষণা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড টি.এইচ. চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর পুষ্টিবিদ ড. উইলিয়াম লি বলেন, “পেঁপে এমন একটি ফল যা শুধু হজম শক্তি বাড়ায় না, বরং দেহে নানা উপকারী এনজাইমের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।” তাঁর মতে, পেঁপেতে থাকা প্যাপেইন নামের এনজাইম আমাদের দেহের প্রোটিন হজমে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ফলে গ্যাস, অজীর্ণ, বদহজম বা পেট ফাঁপার মতো সমস্যা অনেকটাই কমে আসে।

পেঁপেতে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি। এই ভিটামিন শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে। একটি মাঝারি আকৃতির পেঁপেতে যে পরিমাণ ভিটামিন সি থাকে, তা একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক চাহিদার দ্বিগুণ পূরণ করে। ফলে পেঁপে খেলে সর্দি-কাশি, ভাইরাস সংক্রমণ কিংবা সাধারণ ফ্লু হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। এ বিষয়ে লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালের গবেষক ড. মিরিয়াম স্টোন এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, “শরীরে ভিটামিন সি-এর পর্যাপ্ততা বজায় রাখলে ভাইরাল ইনফেকশন অনেকটা প্রতিহত করা যায়, আর পেঁপে এই ভিটামিনের খুব ভালো উৎস।”

পেঁপের আরেকটি বড় গুণ হলো এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ক্যারোটিনয়েড নামের এই উপাদানটি শরীরের কোষকে রক্ষা করে, ত্বকের বয়স ধীর করে, এমনকি ক্যানসার প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে বলে মনে করেন গবেষকরা। আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ-এর একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতিদিন পেঁপে খেলে শরীরে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল নামের ক্ষতিকর উপাদানগুলোর প্রভাব কমে যায়। এটি দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যেমন—হৃদরোগ, ডায়াবেটিস বা ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, যারা হজমজনিত সমস্যায় ভোগেন, তাঁদের জন্য কাঁচা পেঁপে দারুণ উপকারী। কাঁচা পেঁপেতে থাকা প্যাপেইন এবং চাইমো-প্যাপেইন নামের এনজাইম দেহের হজমশক্তি বাড়ায়। ভারতের দিল্লিভিত্তিক ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউট্রিশন’-এর পুষ্টিবিদ ড. সুনীতা আগরওয়াল বলেন, “কাঁচা পেঁপেতে এমন কিছু প্রাকৃতিক উপাদান আছে, যা পাকস্থলীর অ্যাসিডের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধে কাজ করে।”

পেঁপে শুধু পেট বা হজম নয়, রক্তচাপ এবং হৃদরোগের ক্ষেত্রেও উপকারী। এতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ পটাশিয়াম, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। বিশেষ করে উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা যদি নিয়মিত পেঁপে খান, তাহলে ওষুধের পরিমাণ কমানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়। ব্রাজিলের ইউনিভার্সিটি অব সাও পাওলোর হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ড. রিকার্ডো মোরাইস বলেন, “পেঁপের প্রাকৃতিক পটাশিয়াম হৃদপিণ্ডের ধ্বংসপ্রাপ্ত কোষগুলোকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। এটি হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।”

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও পেঁপে উপকারী। এতে থাকা আঁশ বা ফাইবার রক্তে চিনির পরিমাণ কমিয়ে আনে। পাকা পেঁপেতে চিনির পরিমাণ কম থাকায় তা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নিরাপদ। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির নিউট্রিশনাল মেডিসিন বিভাগের পুষ্টিবিদ ড. এলেন রোজম্যান বলেন, “পেঁপেতে থাকা প্রাকৃতিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও আঁশ শরীরের ইনসুলিন ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করে। ফলে ডায়াবেটিস রোগীরা চাইলে এটি নিয়মিত খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন।”

ত্বকের সৌন্দর্য রক্ষায়ও পেঁপের ব্যবহার রয়েছে। পাকা পেঁপে শুধু খাওয়ার জন্য নয়, ফেসপ্যাক হিসেবেও ব্যবহার হয়। এতে থাকা ভিটামিন এ ও সি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়, দাগ কমায় এবং বয়সের ছাপ প্রতিরোধ করে। এমনকি ত্বকের মৃতকোষ পরিষ্কার করতেও পেঁপে ব্যবহার হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার স্কিন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. জিন হুং পার্ক বলেন, “পেঁপেতে থাকা প্রাকৃতিক এনজাইম প্যাপেইন ত্বকের মৃতকোষ অপসারণে কার্যকর। এটি স্কিন এক্সফোলিয়েটর হিসেবে খুবই জনপ্রিয়।”

পেঁপে খেলে যকৃৎ বা লিভারের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, কাঁচা পেঁপে যকৃতের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে। এমনকি গ্যাস্ট্রিক আলসার বা পাকস্থলীর ক্ষতের ক্ষেত্রেও এটি উপকারী হতে পারে। তাই অনেকে সকালে খালি পেটে এক টুকরো পেঁপে খাওয়ার পরামর্শ দেন।

এছাড়া নারীদের ক্ষেত্রে পেঁপের বিশেষ কিছু গুণাগুণ রয়েছে। মাসিক অনিয়ম, পেটের ব্যথা, হরমোন ভারসাম্যের সমস্যা—এই ধরনের সমস্যায় কাঁচা পেঁপে খাওয়া উপকারী হতে পারে বলে মত দিয়েছেন ভারতীয় আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ ড. অনুপমা জোশি। তিনি বলেন, “কাঁচা পেঁপেতে থাকা প্রাকৃতিক ফাইটোকেমিক্যালস নারীদের হরমোন ব্যালেন্সে সাহায্য করে। তবে গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে কাঁচা পেঁপে খাওয়া উচিত নয়।”

সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই পুষ্টিকর ফলটি পাওয়া যায় সারা বছর, প্রায় সব জায়গায়, খুবই কম দামে। কোনো বিশেষ পরিবেশে চাষ করতে হয় না, কীটনাশকের ব্যবহারও তুলনামূলকভাবে কম। ফলে পেঁপে একটি নিরাপদ ও সহজলভ্য স্বাস্থ্যবান্ধব খাদ্য।

আজ যখন আমরা স্বাস্থ্য সচেতন জীবনযাপন নিয়ে ভাবছি, তখন খুব সাধারণ এই ফলটি হয়ে উঠতে পারে অসাধারণ এক সহায়ক। নিয়মিত খাদ্যতালিকায় পেঁপে রাখলে ওষুধের ওপর নির্ভরতা কমবে, বাড়বে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। আর সেই সঙ্গে আমাদের নিজেদের চেনা-জানা পেঁপে হয়ে উঠবে একটি স্বাস্থ্যবান্ধব জীবনের সঙ্গী।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

অ্যাপোস্টিল সার্ভিস: সহজ হয়েছে প্রামাণিকরণ

সানজানা মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখাতে দেখাতে বলল, ‘অ্যাপোস্টিল হলো এমন একটা সার্টিফিকেট, যেটা দিয়ে আমার দলিল আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাবে। কোনো দূতাবাসে দৌড়ঝাঁপ করতে হবে না।

১ দিন আগে

বিদায় মদিনা, বিদায়

সবুজ গম্বুজ তলে সবুজ ঝালরে গোলকের মায়াবী নিশানা ঢেউ তোলে বারবার মনের গহীনে

২ দিন আগে

দুপুরের মধ্যে ৭ অঞ্চলে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস

দেশের ৭ অঞ্চলের ওপর দিয়ে ৬০ কিমি বেগে ঝড় হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। শুক্রবার (২৩ মে) ভোরে নদীবন্দরের জন্য দেওয়া সতর্কবার্তায় এ কথা জানানো হয়।

২ দিন আগে

শিক্ষাজীবন: বাবা-ছেলের দুই সময়ের গল্প

খরচ হতো অনেক। ঢাকায় আসাযাওয়া ও থাকার খরচ জোগাড় করে যাত্রা শুরু করতে হতো। রিয়াদ বললো, “আমরা তো এখন অনলাইনে ফরম পূরণ করি। মোবাইল দিয়েই জমা দিয়ে দিই।

২ দিন আগে