বিজ্ঞান
চুল পড়া কি বন্ধ করা সম্ভব? বিজ্ঞান কী বলছে?

চুল পড়া এখনকার সময়ে এমন এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রায় সবাইকে কখনো না কখনো ভোগাতে শুরু করে। কারো ক্ষেত্রে এটা ধীরে ধীরে ঘটে, কারো ক্ষেত্রে হঠাৎ করেই চুলের গোছা গোছা পড়ে যাওয়া শুরু হয়। মাথার সামনের দিকটা ফাঁকা হতে থাকে, বা কখনো মাথার মাঝখানেই চুল পাতলা হতে শুরু করে। অনেকেই এই পরিবর্তন মানসিকভাবে নিতে পারেন না, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। তখন প্রশ্ন জাগে—এই চুল পড়া কি পুরোপুরি থামানো যায়? বিজ্ঞান কী বলে এই বিষয়ে?
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, প্রতিদিন কিছু পরিমাণ চুল পড়া একেবারেই স্বাভাবিক। একজন মানুষের প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০টি পর্যন্ত চুল পড়ে যেতে পারে, আর এটাই শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। পুরনো চুল পড়ে যায়, নতুন চুল গজায়। কিন্তু যখন এই চুল পড়া মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় এবং নতুন চুল আর গজায় না, তখনই সেটা হয় সমস্যা। এর পিছনে থাকতে পারে নানা কারণ—জিনগত প্রভাব, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, মানসিক চাপ, অপুষ্টি, কিংবা কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগ বা ওষুধের প্রভাব।
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন গবেষণা এবং চিকিৎসা প্রক্রিয়া চুল পড়া নিয়ে বিস্তর কাজ করছে। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির চর্মরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর জেরি শাপিরো বলেন, হরমোনজনিত এবং বংশগত কারণে যে ধরনের টাক পড়ে তাকে পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়, তবে এটি ধীর করা কিংবা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। তাঁর মতে, উপযুক্ত চিকিৎসা এবং জীবনযাপনের পরিবর্তনের মাধ্যমে অনেকেই ভালো ফল পেয়ে থাকেন।
চুল পড়া ঠেকাতে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় মিনোক্সিডিল এবং ফিনাস্টেরাইড নামের দুটি ওষুধ। মিনোক্সিডিল একটি তরল জাতীয় ঔষধ যা মাথার স্ক্যাল্পে ব্যবহার করা হয়। এটি চুলের গোঁড়ায় রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেয় এবং চুলের ফলিকলকে সক্রিয় রাখে। ২০১৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ডারমাটোলজিতে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, পাঁচ শতাংশ মিনোক্সিডিল ব্যবহারে প্রায় চল্লিশ থেকে ষাট শতাংশ পুরুষের ক্ষেত্রে চুল গজানোর উন্নতি দেখা গেছে। তবে এ ধরনের ওষুধ নিয়মিত ব্যবহার না করলে তা কোনো সুফল দেয় না, বরং হঠাৎ বন্ধ করলে চুল পড়া আরও বেড়ে যেতে পারে।
অন্যদিকে ফিনাস্টেরাইড একটি মুখে খাওয়ার ওষুধ, যা পুরুষদের দেহে ডিহাইড্রোটেস্টোস্টেরন নামের এক হরমোনের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এই হরমোনই মূলত চুল পড়ার জন্য দায়ী। তবে এই ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে, যেমন যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া, মাথা ঘোরা, অথবা কিছু ক্ষেত্রে মানসিক অস্বস্তি। কর্নেল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডক্টর নীল সাধিকি বলেন, চুল পড়া পুরোপুরি বন্ধ করা যায় না, তবে নির্দিষ্ট চিকিৎসা ও সময়মতো ব্যবহার করলে ছয় থেকে বারো মাসের মধ্যে চুল পড়া অনেকটাই কমে যেতে পারে এবং নতুন চুলও গজাতে দেখা যায়।
সম্প্রতি চুল পড়া রোধে নতুন কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্লেটলেট রিচ প্লাজমা থেরাপি, যাকে সংক্ষেপে পি আর পি বলা হয়। এই পদ্ধতিতে রোগীর নিজের রক্ত থেকে প্লেটলেট আলাদা করে তা মাথার স্ক্যাল্পে ইনজেকশন হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। এতে চুলের ফলিকল নতুন উদ্দীপনা পায় এবং চুল গজানোর হার বাড়ে। ২০২১ সালে রোমের ইউনিভার্সিটি অব রোমা ত্রের গবেষকরা জানান, এই থেরাপির মাধ্যমে চুলের ঘনত্ব ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
এছাড়াও স্টেম সেল থেরাপি নামের আরেকটি সম্ভাবনাময় চিকিৎসা নিয়ে গবেষণা চলছে, যেখানে বিশেষ ধরনের কোষ ব্যবহার করে মাথার ত্বকের কোষগুলোর পুনর্জন্ম ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। যদিও এটি এখনো গবেষণার পর্যায়ে, তবে বিজ্ঞানীরা আশাবাদী, ভবিষ্যতে এটি চুল পড়া রোধে বড় ভূমিকা রাখবে।
চুল পড়া পুরোপুরি বন্ধ করা না গেলেও জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন আনলে এবং যত্নবান হলে চুল অনেকটাই সুস্থ রাখা যায়। খাদ্যাভ্যাসে পর্যাপ্ত প্রোটিন, আয়রন, জিঙ্ক, ভিটামিন ডি ও বি কমপ্লেক্স রাখলে চুলের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ধ্যান বা ব্যায়াম সাহায্য করতে পারে। এছাড়া চুলে অতিরিক্ত হিট, রং করা বা রাসায়নিক ব্যবহার কমিয়ে আনাই উত্তম। নিয়মিত চুল পরিষ্কার রাখা, তেল দিয়ে হালকা ম্যাসাজ করাও উপকারী হতে পারে।
সবশেষে বলা যায়, চুল পড়া একদিকে যেমন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ, তেমনি অতিরিক্ত হলে সেটি শারীরিক কিংবা মানসিক সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। তবে আশার কথা, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে এখন অনেক ধরনের সমাধান আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে। চুল পড়া শুরু হলে আতঙ্কিত না হয়ে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া, নিয়মিত যত্ন নেওয়া এবং নিজের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার দিকে মনোযোগ দেওয়াই সবচেয়ে কার্যকর পথ।
আপনার যদি চুল পড়া নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো সমস্যা থাকে কিংবা ওষুধ-বিষয়ক প্রশ্ন থাকে, আমি সেগুলো নিয়েও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে পারি। বলবেন?
সূত্র: বিবিসি