ইতিহাস

আন্দিজের বন্দি: প্লেন ক্র্যাশ ও বন্য মানবতার কাহিনী

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২৫, ১৮: ১৫
চ্যাটজিপিটির চোখে আন্দিজের প্লেন ক্র্যাশ

১৯৭২ সালের ১৩ অক্টোবর। উরুগুয়ের রাজধানী মন্টেভিডিও থেকে চিলির সান্তিয়াগো শহরের উদ্দেশে উড়াল দেয় একটি চার্টার্ড বিমান। ফেয়ারচাইল্ড এফএইচ-২২৭ টাইপের ছোট এই বিমানটিতে ছিল মোট ৪৫ জন যাত্রী ও ক্রু সদস্য। যাত্রীরা ছিলেন মূলত উরুগুয়ের একটি রাগবি টিম—“ওল্ড ক্রিশ্চিয়ান্স ক্লাব”—এর খেলোয়াড় ও তাঁদের পরিবারের সদস্য। কারও চোখে ছিল বন্ধুত্বের হাসি, কারও মনে ছিল প্রতিযোগিতার উত্তেজনা। কিন্তু কে জানত, ওই বিমানযাত্রা তাদের জীবনকে চিরতরে পালটে দেবে?

বিমানটি যখন আন্দিজ পর্বতমালা অতিক্রম করছিল, তখন আবহাওয়া দ্রুত খারাপ হয়ে যায়। মেঘে ঢেকে যায় চারপাশ, কমে আসে দৃশ্যমানতা। ভুল নির্দেশনা ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে বিমানটি আন্দিজ পর্বতমালার এক উঁচু অঞ্চলে ধাক্কা খায় এবং মুহূর্তেই ভেঙে পড়ে বরফে ঢাকা পাহাড়ে। সে এক ভয়াবহ ধ্বংস। বিমানের সামনের অংশ সম্পূর্ণ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, পাইলট ও কো-পাইলট ঘটনাস্থলেই নিহত হন। অনেক যাত্রী সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণ হারান। বাকিরা অজ্ঞান অবস্থায় বা মারাত্মক আহত হয়ে পড়ে থাকেন বরফে।

দুর্ঘটনার পর যারা বেঁচে ছিলেন, তাঁদের সামনে দাঁড়ায় এক কঠিন প্রশ্ন—কীভাবে বাঁচা যাবে এই তুষারে ঢাকা মৃত্যু উপত্যকায়?

প্রথমে তাঁরা আশায় বুক বাঁধেন যে, উদ্ধারকারী দল নিশ্চয়ই খুব শিগগিরই এসে পৌঁছাবে। কিন্তু দিনে দিনে সেই আশায় ফাটল ধরে। পাহাড়ে তুষারপাত চলছিল, তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। তাদের খাবার বলতে ছিল কিছু চকোলেট, ওয়াইন আর হালকা বিস্কুট। কয়েকদিনের মধ্যেই সব ফুরিয়ে যায়। তৃষ্ণায় কেউ বরফ গলিয়ে পানি খাচ্ছিল, কেউ ঠান্ডায় হিপোথারমিয়ায় কাঁপছিল।

দিন গড়াতে থাকে। একজন, দু’জন করে মৃত্যু বাড়তে থাকে। কারও ঠান্ডায়, কারও ক্ষুধায়। কেউ আহত হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছিল। আর তখনই আসে এক ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্তের মুহূর্ত—এই মৃত্যু থেকে বাঁচতে হলে মৃত সহযাত্রীদের দেহ ব্যবহার করতে হবে খাদ্য হিসেবে।

এটা কোনো সহজ সিদ্ধান্ত ছিল না। ধর্ম, মানবতা, নৈতিকতা—সব কিছুর বিরুদ্ধে গিয়ে মৃতদের দেহ খাওয়ার চিন্তা তাদের মানসিকভাবে ভেঙে দেয়। কিন্তু সময় গড়ালে বুঝতে পারে, এটাই একমাত্র উপায়। জীবনের তাগিদে তারা সেই নিষিদ্ধ পথেই পা রাখে। মৃতদের শরীর বরফে থাকার কারণে পচেনি, বরং বরফের কারণে সংরক্ষিত ছিল। এক ধরনের আত্মগ্লানির মধ্য দিয়েই শুরু হয় তাদের বেঁচে থাকার যুদ্ধ।

এই দুর্ঘটনা ও পরবর্তী ঘটনাগুলো নিয়ে বহু বছর পর আমেরিকান গবেষক ডক্টর অ্যালান ডি. হুইটলি, যিনি সারভাইভাল সাইকোলজি নিয়ে গবেষণা করেন, বলেছিলেন, “মানুষ তখনই তার সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়ে ফেলে, যখন তাকে অস্তিত্বের গভীরতম প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। আন্দিজ দুর্ঘটনা সেটারই উদাহরণ।”

প্রথম ১০ দিন পর উরুগুয়ে ও চিলির সেনাবাহিনী উদ্ধার অভিযান বন্ধ করে দেয়। কারণ তারা ধরে নেয়, কেউ বেঁচে নেই আর। রেডিওতে খবর প্রচারিত হয়—সব যাত্রী নিখোঁজ বা মৃত।

এই খবরই যেন দ্বিতীয় মৃত্যু হয়ে আসে জীবিতদের জন্য। তাদের চোখে তখন কোনো আলোর রেখা নেই। কিন্তু সেই হতাশার মধ্যেই দুজন যুবক, ফার্নান্দো পারাদো ও রবার্টো ক্যানেসা, সিদ্ধান্ত নেয় পাহাড় পেরিয়ে লোকালয়ে যাওয়ার। তাদের কাছে ছিল না কোনো মানচিত্র, ছিল না উপযুক্ত পোশাক কিংবা জুতা। শুধু ছিল বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছাশক্তি।

তারা ১০ দিনেরও বেশি সময় ধরে বরফে হাঁটে, কখনো পাহাড় বেয়ে ওঠে, কখনো ঠান্ডায় জ্ঞান হারায়। একসময়, দূরে দেখতে পায় একটি নদী আর তার পাশে বসবাসকারী এক চিলিয়ান কৃষককে। সেই কৃষকের সহায়তায় তারা পৌঁছে যায় সান্তিয়াগোতে। তারপর দ্রুত উদ্ধারকারী দল ফিরে যায় সেই দুর্ঘটনাস্থলে। ৭২ দিন পর মোট ১৬ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।

এই ১৬ জনই বয়ে এনেছিলেন জীবনের এক নতুন সংজ্ঞা। তারা বলেছিলেন, “আমরা বুঝেছিলাম, জীবন কেবল বেঁচে থাকার জন্যই নয়, লড়াইয়েরও আরেক নাম।”

পরবর্তীতে বহু মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, এমনকি নৃবিজ্ঞানীরাও এই ঘটনা নিয়ে গবেষণা করেছেন। আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী ড. শার্লট গ্লাসার মন্তব্য করেন— “এই দুর্ঘটনা আমাদের শেখায়, সভ্যতার গভীরে প্রাণটিকে বাঁচিয়ে রাখতে যে অপ্রাকৃত সিদ্ধান্তও মানুষ নিতে পারে, সেটাই সবচেয়ে মানবিক হয়ে ওঠে। কারণ মানুষের প্রবৃত্তি সবসময়ই বাঁচার।”

এই দুর্ঘটনার ওপর ভিত্তি করেই ১৯৭৪ সালে “Survive!” নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৯৩ সালে “অ্যালাইভ” নামের একটি সিনেমা বানানো হয় হলিউডে, যেটি পুরো বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়। ফার্নান্দো পারাদো নিজেই পরবর্তীতে একটি আত্মজীবনী লেখেন—“মিরাকল ইন দ্য আন্দিজ’—যেখানে তিনি লেখেন, ‘যখন মৃত বন্ধুর শরীর খাচ্ছিলাম, আমি জানতাম, সে আমার জীবন বাঁচাচ্ছে। এটা ছিল ভালোবাসার অন্য রূপ।’

এই দুর্ঘটনার নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক আজও ডিবেটেড হয়। কেউ বলে, তারা যা করেছে তা অমানবিক। কেউ বলে, তারা করেছে বলেই আজ আমরা জানতে পারছি, মানুষের সীমা ঠিক কতটা বিস্তৃত হতে পারে।

একজন ফরাসি বায়োএথিসিস্ট, ড. ক্লারা ডি বোয়া বলেন, “যখন আইন, সমাজ বা ধর্ম কোনো সহায়তা দিতে পারে না, তখন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে প্রাকৃতিক প্রবৃত্তিই মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ দিশারী হয়ে ওঠে।”

এখনও আন্দিজ দুর্ঘটনার survivors-রা প্রতি বছর একবার সেই দুর্ঘটনাস্থলে যান, যেখানে এখন একটি ছোট স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে তারা বসে, মৃত বন্ধুদের স্মরণ করেন, অশ্রু ফেলে বলেন—“তোমরা না থাকলে আমরা আজ বেঁচে থাকতাম না।”

দুর্ঘটনার পঞ্চাশ বছর পার হয়ে গেছে। তবে এই ঘটনা এখনো বিশ্বের অন্যতম আলোচিত বেঁচে থাকার লড়াই হিসেবে বিবেচিত। এটি কেবল একটি বিমান দুর্ঘটনার গল্প নয়, এটি মানব প্রবৃত্তির, বন্ধুত্বের, আত্মত্যাগের এবং অসীম সাহসের এক অমর কাহিনি।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

বিশ্বের আলোচিত দশ বিমান দুর্ঘটনা

২০১৪ সালে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট এমএইচ৩৭০ (MH370) এক বিস্ময়কর উপায়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং যাওয়ার পথে যাত্রীবাহী বোয়িং ৭৭৭ বিমানটি উড়োজাহাজ নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে এবং আজও তা কোথাও পাওয়া যায়নি। ২৩৯ জন যাত্রী ও ক্রুর কারও কোনো হদিস মেলেনি। এটি আজও সবচেয়ে রহস্যময়

৩ দিন আগে

এফ-৭ যুদ্ধবিমান: সাফল্য ও ব্যর্থতার গল্প

এই বিমানের ইতিহাসে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত যুগান্তরের ছাপ। ১৯৬০-এর দশকে চীন যখন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে মিগ-২১ যুদ্ধবিমান কেনে। তখন থেকেই তারা এর নিজস্ব সংস্করণ তৈরির উদ্যোগ নেয়। কারণ, সোভিয়েতরা পরবর্তীতে রাজনৈতিক কারণে বিমান সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।

৩ দিন আগে

কচুরিপানায় যায় যায় নড়াইলের চিত্রা

সরেজমিন নদীটির রতডাঙ্গা, সাবেক শেখ রাসেল সেতু, আউড়িয়া এস এম সুলতান সেতু, গোবরা বাজার, শিঙ্গাশোলপুর বাজার, চুনখোলা সেতুর অংশ ঘুরে দেখা গেছে নদীতে ঘন কচুরিপানা। সেখানে পানি আছে কি না, তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। কোনো নৌযান চোখে পড়েনি। অনেক বস্তু নদীর কিছু এলাকায় কচুরিপানায় আটকা পড়ে পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পাড়ে

৩ দিন আগে

বিমান কেন বিধ্বস্ত হয় , বিজ্ঞান কী বলে?

বিমানে মানুষ চালায়। তাই মানুষের মানসিক অবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ। কেউ যদি ভয় পায় বা চাপে ভেঙে পড়ে, তবে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ড. টমাস হফম্যান বলেন, “শান্ত মন আর মাথা ঠান্ডা না থাকলে পাইলট ভুল করে ফেলতে পারেন। তখন জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন তৈরি হয়।”

৩ দিন আগে