মহাকাশ

ব্ল্যাক হোলের নৃত্য : মহাবিশ্বের গোপন গাণিতিক ভাষা

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম

ব্ল্যাক হোল—এই রহস্যময় বস্তুটি মহাকাশে যতটা ভয়ংকর, ততটাই রোমাঞ্চকর বিজ্ঞানীদের কাছে। তারা শুধু মহাবিশ্বের গভীর রহস্যকেই উন্মোচন করে না, বরং কখনও কখনও এমন সব গাণিতিক কাঠামোর সাক্ষাৎ দেয়, যেগুলো আগে শুধু বইয়ের পাতাতেই ছিল। সম্প্রতি জার্মালের হুমবোল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাথিয়াস ড্রিসে ও তাঁর সহকর্মীরা এমনই এক চমকপ্রদ আবিষ্কার করেছেন—যা ব্ল্যাক হোলের গতিবিধির অজানা দিক তো প্রকাশ করেছে, সেই সঙ্গে আমাদের মহাবিশ্ব যে কতটা জটিল গাণিতিক কাঠামোয় গঠিত, তাও ইঙ্গিত দিয়েছে।

এই গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২৫ সালের ১৪ মে ‘নেচার’ নামের খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক জার্নালে। গবেষকরা বলেছেন, তারা এবার ব্ল্যাক হোল যখন একে অপরের খুব কাছ দিয়ে ঘুরে যায় কিন্তু একীভূত হয় না—এমন ঘটনার সময় কীভাবে স্থান-কাল বা স্পেসটাইম বিকৃত হয়, তা এত নিখুঁতভাবে গণনা করতে পেরেছেন যা আগে কখনও হয়নি।

এ ধরনের মিথস্ক্রিয়াকে বলা হয় ‘স্ক্যাটারিং ইভেন্ট’। আগে বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোলের একীভবনের সময় যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ তৈরি হয় তা নিয়ে বেশি কাজ করেছেন। কিন্তু এই নতুন গবেষণায় যেটা ঘটেছে, তা যেন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ গবেষণায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, দুটি ব্ল্যাক হোল যদি একে অপরের খুব কাছে দিয়ে ছুটে যায়, তাহলেও একধরনের শক্তিশালী তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে মহাবিশ্বের জুড়ে। এই তরঙ্গের নিখুঁত হিসাব করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন কোয়ান্টাম ফিল্ড থিওরি বা কণাপদার্থবিজ্ঞানের গাণিতিক কাঠামো।

গণনার ক্ষেত্রে তারা পৌঁছেছেন “ফিফথ পোস্ট-মিনকোভস্কিয়ান অর্ডার”-এ। এর মানে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের শক্তি কতটা, ব্ল্যাক হোলগুলো কতটা বাঁক নেয়, আর সংঘর্ষের পর কতটা পিছিয়ে যায়—এসব এতটাই সূক্ষ্মভাবে তারা হিসাব করতে পেরেছেন, যা আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বকে একেবারে বাস্তব পর্যায়ে পরীক্ষার সুযোগ এনে দিয়েছে।

এই গবেষণার অন্যতম সহলেখক, লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের কণা পদার্থবিজ্ঞানী ড. গুস্তাভ মোগুল স্পেস ডট কম-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এই স্তরের নির্ভুলতা এর আগে কখনও অর্জিত হয়নি। এটি আইনস্টাইনের সমীকরণের সবচেয়ে নিখুঁত সমাধান।”

গবেষণার সবচেয়ে বিস্ময়কর দিকটি আসে তখন, যখন তাঁরা দেখতে পান—এই তরঙ্গের শক্তি গণনায় হঠাৎই উঠে আসছে ছয় মাত্রিক একধরনের বিমূর্ত গাণিতিক আকৃতি, যার নাম ‘কালাবি-ইয়াউ ম্যানিফোল্ড’। এ ধরনের গাণিতিক কাঠামো এতদিন শুধু স্ট্রিং থিওরি বা তন্তু তত্ত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, এগুলো কেবল কল্পনাপ্রসূত বা গাণিতিক নিদর্শন, বাস্তবজগতে এর কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই।

কিন্তু এবার সেই কাঠামো দেখা গেল বাস্তব মহাকর্ষীয় তরঙ্গের শক্তি হিসাব করার সময়। আর এখানেই এই গবেষণার তাৎপর্য। ড. মোগুল বলেন, “এটা যেন আপনি ম্যাগনিফাইং গ্লাস থেকে সরাসরি মাইক্রোস্কোপে চলে গেছেন। এতদিন যেটা চোখে পড়েনি, এবার সেটা স্পষ্ট হল।” তাঁর ভাষায়, “এই ধরনের কাঠামোর আবির্ভাব আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে—প্রকৃতি আসলে কেমন গাণিতিক বস্তু দিয়ে তৈরি।”

গবেষক ম্যাথিয়াস ড্রিসে বলেন, তারা মূলত ধাপে ধাপে জটিলতা বাড়িয়েছেন, প্রথমে সহজতম উপায়ে শুরু করে পাঁচ স্তরের জটিল গাণিতিক মডেল ব্যবহার করেছেন। এর ফলে তারা যে ফলাফল পেয়েছেন, তা বর্তমান ও ভবিষ্যতের মহাকর্ষ তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ যন্ত্রগুলোর জন্য দারুণ সহায়ক হবে।

বর্তমানে যেসব যন্ত্র দিয়ে এই তরঙ্গ ধরা হয়—যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘লাইগো’ এবং ইউরোপের ‘ভার্গো’—তাদের ধারণক্ষমতা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতে আরও উন্নত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র যেমন ‘লাইসা’ (LISA) এবং ইউরোপের ‘আইনস্টাইন টেলিস্কোপ’ মহাকর্ষ তরঙ্গ বিশ্লেষণে নতুন যুগ আনবে। আর এই নতুন গবেষণা সেই সময়ের জন্য প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

গবেষকদের মতে, যত উন্নত যন্ত্র আসবে, তত উন্নত মডেলও লাগবে। কারণ বিশ্লেষণের জন্য শুধু তরঙ্গ ধরা নয়, বরং তা কী ধরনের ঘটনার ফল, কত শক্তি ছিল, কোন দিকে বিস্তার হয়েছে—এসব বিশদ তথ্য জানতে হলে গাণিতিক মডেল অবশ্যই নিখুঁত হতে হবে। আর সেই মডেল তৈরি করতেই দরকার এই ধরনের গবেষণা।

সব মিলিয়ে বলা যায়, এই গবেষণা শুধু মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা ব্ল্যাক হোল বোঝার ক্ষেত্রেই নয়, বরং আমাদের মহাবিশ্বের কাঠামো যে গাণিতিকভাবে কতটা জটিল ও সূক্ষ্মভাবে তৈরি—তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আগে যেসব গাণিতিক তত্ত্ব কেবল বইয়ের পাতায় ছিল, সেগুলো যে বাস্তব মহাবিশ্বে কাজ করে, এবার তার প্রমাণ পাওয়া গেল। এ যেন বিজ্ঞান আর কল্পনার সীমারেখা ঘোলাটে হয়ে যাওয়ার এক অভাবনীয় মুহূর্ত।

এই আবিষ্কার ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্য শুধু অনুপ্রেরণাই নয়, বরং মহাবিশ্বকে বোঝার দরজাও খুলে দিচ্ছে আরেকটু প্রশস্ত করে। কে জানে, এর ঠিক পরের ধাপে আমাদের সামনে আসবে আরও বিস্ময়কর কিছু?

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

নিম্নচাপ কেন হয়, এর বৈজ্ঞানিক কারণ কী

আবহাওয়াবিদদের ভাষায় নিম্নচাপ হলো একটি এমন আবহাওয়াগত পরিস্থিতি যেখানে বাতাসের চাপ চারপাশের তুলনায় কম হয়ে যায়। সাধারণত পৃথিবীর যেকোনো স্থানে বাতাস সবসময় উচ্চচাপ থেকে নিম্নচাপের দিকে প্রবাহিত হয়।

১৯ ঘণ্টা আগে

ব্যাটল অব হ্যাস্টিংসের ইতিহাস

ইংল্যান্ডের সিংহাসন তখন ছিল এক জটিল রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কেন্দ্র। ইংরেজ রাজা এডওয়ার্ড দ্য কনফেসর ১০৬৬ সালের জানুয়ারিতে উত্তরাধিকারী ছাড়াই মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল—কে ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হবেন? রাজ্যের প্রধান অভিজাতেরা হ্যারল্ড গডউইনসনকে রাজা ঘোষণা করলেন।

১ দিন আগে

খালি পেটে লেবু খাওয়া ক্ষতিকর!

সকালে ঘুম থেকে উঠেই অনেকেই অভ্যাস বশে এক গ্লাস লেবু পানি খান। বিজ্ঞাপন আর স্বাস্থ্যবিষয়ক ম্যাগাজিনে এমন ধারণা ছড়িয়ে গেছে যে খালি পেটে লেবু খেলে শরীরের টক্সিন বের হয়ে যায়, ওজন কমে, আবার হজমশক্তিও নাকি বাড়ে। কিন্তু আসলেই কি খালি পেটে লেবু খাওয়া এতটা উপকারী? বিজ্ঞানীরা বলছেন, লেবুর কিছু ভালো দিক

১ দিন আগে

কেন ভাদ্র মাসে তাল পাকে?

২ দিন আগে